`.....পথ হয়েছে শ্রীহীন`
প্রিয় পথ
বেলা দে
এমন একদিন গেছে যেদিন পথ সত্যিই বেঁধে দিয়েছিল বন্ধনহীন গ্রন্থি, শৈলরানীর দেশে যখন ইচ্ছে যতটা ইচ্ছে বনবাদাড়ে টইটই। যত্রতত্র রসনা তৃপ্তিসুখ সমতলে যা পাইনি এতদিন অর্থাৎ ষাটের দশকের শেষদিকে ১৯৬৯-এ, মোমো চাউমিনের চাইনিজ রেস্তোরাঁ সেদিন কোথায়? প্রথমটায় ধোয়া ওঠা চাউমিন দেখে কি গা ঘিনঘিন। বন্ধুরা বুঝিয়ে বাজিয়ে খাইয়ে দিয়েছে ফেরিওয়ালার জলবরফ খেয়ে অভ্যেস, সেখানে আইস্ক্রিম পার্লার পিৎজা হাটের মুখরোচক খাবার, আত্মপ্রকাশ করেওনি রকমারি কেক। ছোট্ট এক অঞ্চল শহর থেকে গিয়ে ঠকেছি বারবার, একদিন বিস্কুট আইসক্রিম থেকে আইসক্রিম চেটে খেয়ে বিস্কুটের অংশটুকু ফেলেই দিয়েছি ওদের হো হো হাসিটুকুও খুব অপমানে লেগেছিল।
ফালাকাটায় তখন কলেজ হয়নি বোর্ডের পরীক্ষায় পাশ করে মাত্র পনেরোয় দাদার সঙ্গে যাব শৈলরানীর দেশে দার্জিলিং গভর্নমেন্ট কলেজে পড়তে। সমতলের শীতবেলায় যদি কখনো মেঘ সরলে একটু আধটু পাহাড় চুড়োও দেখা গেছে সোল্লাসে চেঁচিয়ে উঠেছি ওরে দেখ দেখ কাঞ্চনজঙ্ঘা, ভাবতাম কবে দেখবো সেই পাহাড়ি পথ।ভাবতেই পারিনি একদিন আকস্মিকভাবেই চলে যাব শৈলরানীর শহরে, সবেমাত্র আটষট্টির বন্যায় বিপর্যস্ত উত্তরবঙ্গ, সে পথে চলতে চারবার বাসা বদল করে অবশেষে ছুঁয়েছি পাহাড়ি পথ, খাড়াই উতরাই পাকদণ্ডী মৌনি পথকেই তাহলে পাহাড় বলে, যতই উঠছি আর অভিভূত বিহ্বল হয়ে দেখছি চারপাশ।
দুইধারে সাজানো মনোরম ইচ্ছেফুলের গাছ রঙিন করে রেখেছে পাহাড়, থেকে থেকে ঝর্ণার উত্তাল জলরাশির কলধ্বনি, বাদরের সংসার,খাঁজে খাঁজে ঝুলে থাকা কুটিরের চেকনাই। চাঁদমারিতে দাদা থাকে আর চাঁদনিচক মূল শহর। বন্ধুরা বলতো চল মোমো খেয়ে আসি কাছেই তো সে পথ আমার কাছে লেগেছে অনেকটা। ওদের সাথে কলেজপথে পিছিয়ে পড়েছি প্রতি রোজ হাফ ধরেছে চলতে চলতে, কালভার্টে বসে খানিকটা বিশ্রাম করতে গিয়ে দেখি ওরা নেই আমি তো হারিয়ে ফেলি খেই, মেঘ কুয়াশার আড়াল ঢেকে ফেলেছে ওদের। লেবং মিনিস্ট্রি যাব একদিন। ওরা বলে চল না এইটুকুই তো পথ ওরেব্বাস শীতের রাজ্যেও আমার রীতিমতো ঘাম ঝরছে ওদের সামান্য আমার কাছে অসামান্য পথ।
কলেজ ছুটির দিন অথবা ক্লাস না থাকার ফাঁকফোকড়ে চষে নিয়েছি দশে মিলে এ পথ ও পথ, কোনদিন কাকঝোরা সরলদন্ডি গাছের পথ ভেঙে ভেঙে একেবারে উপরে ঝোরার ধারে,কোনদিন বোটানিকাল গার্ডেনে রকমারি অর্কিড আর ফুলের সাম্রাজ্যে আবার আচার্য্য জগদীশ চন্দ্র বসুর ইন্সটিটিউটে, সেদিন নির্দিষ্ট কোনো পথ নেই সেখানে যাবার অত্যন্ত খাড়াই পথেই ছুটেছি বয়:সন্ধির নবোদ্যম আবেগে লতাপাতা শেকড়বাকড় ধরে নিয়ে খাঁজ বেয়ে বেয়ে উঠেছি তবুও ছড়ে গিয়ে রক্তাক্ত হয়ে। আবার ম্যাল মহাকালের পথ হেঁটে কোনো সময় মাইলি দিদিদের নৈমিত্তিক শীতসম্ভারের বিপননে। গল্ফ মাঠে, স্টেডিয়ামের পথে, খেলা দেখেছি কলেজ পালিয়ে সাথীরা মিলে। নিয়েছি "চুনি গোস্বামীর " অটোগ্রাফ। ইচ্ছে হলে ঝিরিঝিরি বৃষ্টিপথে ছুটেছি পাকদণ্ডী ঘিরে। দাদা টুরে গেলে বান্ধবীর বাড়ি ভিক্টরিয়া ফলসের কাছাকাছি সেখান থেকে তিন কি মি পথ কলেজ। খাড়াই পথে উঠতে দম বেরিয়ে গেলেও পথসৌন্দর্যে চলার আনন্দে সে শ্রম ভুলেই গিয়েছি। প্রতিদিনের ছন্দ যেন একেবারে নতুন একেবারে আলাদা, আমার জীবনের অতিপ্রিয় বয়:সন্ধির সে পথ ছেড়ে যেদিন তল্পিতল্পা গুটিয়ে ফিরে এসেছি সমতলে মনে হয়েছে পিঞ্জরের অর্ধেক অংশ রেখে এলাম সে পথে আবার একবার গেলাম মধ্যবেলায় চিনতে পারছি না আমার প্রিয়তম পথের আঁকাবাঁকা রেখার রাস্তা সেজেগুজে থাকা সুন্দরী শৈলরানী আজ কোথায়, কংক্রিট ঢেকে ফেলেছে তার শ্যামলসুন্দর অবয়ব। অট্টালিকা মুড়েছে তার কুয়াশা মাখা জৌলুষ। পথ দাঁড়িয়ে আছে শ্রীহীন, আত্মহননের কাছে। আমার পায়ে হাঁটা প্রিয় পথ কিন্তু তার কেতা নিয়েই আছে।
No comments:
Post a Comment