`জীবনের পথে গল্প অনেক....`
সেই প্রিয় পথ
বুলবুল দে
সেই যে সেই সুদূর অতীতে ফেলে আসা, শৈশবেই হারিয়ে যাওয়া,যেন দ্যুতিময় হীরক খন্ডে গাঁথা মালার মত জাজ্বল্যমান সেই রাস্তাটি , স্মৃতির মণিকোঠার ঝাঁপিতে নয়, পশ্চিম দিগন্তাভিমুখে ধাবমান এই নশ্বর জীবনে এই আমার কণ্ঠেই দোদুল্যমান। যখন তখন মাথা নুয়ে তাকাতেই যেন সে দৃশ্যমান, প্রতিনিয়ত যেন তার স্পর্শে মন তরঙ্গায়িত। সে যে আমার ছোট্ট বেলার জলপাইগুড়ির হাকিম পাড়ার সেই ভারাবাড়ির সামনের রাস্তাটি! যার এক মাথা অল্প দূরেই করলা নদীর পাড়ে গিয়ে সালাম ঠুকেছে আর একটা কাঠের পুলের মধ্যস্থতায় অপর পাড়ের সাথে নিগূঢ় বন্ধনে আবদ্ধ হয়েছে। সেই দূরের পাড়টা আমার ছোট্ট মনটাকে রহস্য রোমাঞ্চে ভরিয়ে তুলত। নদীতে কদাচিৎ হঠাৎ নৌকো দেখতে পেলে একেবারে আত্মহারা ! যদিও ওদিকটায় যাওয়া বারণ ছিল তবুও বন্ধুর দলের সাথে খেলার উচ্ছ্বাসে কখন যে ওর কাছাকাছি চলে যেতাম! রাস্তার অপর প্রান্ত সোজা বেশ অনেকটা দূরে জেলা স্কুলের পাশ দিয়ে গিয়ে তিস্তার বাঁধের পাদদেশে ঠেকেছে। এই সেই রাস্তা যা ছয় সাড়ে ছয় বছর বয়সেই হারিয়ে গিয়েছিল আমার জীবন থেকে,যার বিচ্ছেদ সারা জীবন আমার মনটাকে বেদনার্দ্র করে রেখেছে। আসলে এটাই নিয়ম, কোনও প্রিয় জিনিস নাগালের বাইরে চলে গেলে তা প্রিয়তর হয়ে ওঠে আর তার জন্যই মনটা আকুলি বিকুলি করতে থাকে। বাবার ট্রান্সফারের সুবাদে ঐ বয়সে আমাকে কোচবিহারে চলে আসতে হয়েছিল। আর এখানে পাড়ায় একটাও বন্ধু ছিলনা। যদিও তখনও ভাগ না হয়ে যাওয়া একান্নবর্তী পরিবারের ভাই বোনেরা মিলে প্রচুর হুটোপুটি খেলাধুলো হত, কিন্তু তবুও পাকাপাকি ভাবে কোচবিহারে চলে আসার পর যেন বুঝতে পারি কত ভাল, কত বিচিত্র পরিবেশের সম্ভারে পূর্ণ ছিল ঐ রাস্তাটি। ঐটুকু জায়গার মধ্যেই একদিকে বাঁধ একদিকে নদী এমনকি চারদিকে বাড়ি ঘরের ভিড়ে আমাদের বাড়ির উল্টো দিকে রাস্তার ঐ পাড়ে রাস্তা থেকে অনেকটা নীচে একটা ছবির মত ধানক্ষেতও ছিল, লাল ফ্রক পরা জবা দিদিদের ধানক্ষেত। আমাদের ঘরের পাশে যে ঘাসে ভরা মেঠো সরু গলিটা এঁকেবেঁকে ঐ দূরে মিলিয়ে গেছে যার শেষটা কখনও দেখিনি ঐদিক দিয়েই জবা দিদি কাস্তে হাতে আসত। ঐ রাস্তার ধারেও কিছুটা জায়গায় ওরা ধান লাগাত। বন্ধুদের সাথে সেই কচি ধানের শীষ থেকে দুধ খেতে গিয়েই তো আমার আল জিভে ধান আটকে ধুন্ধুমার কাণ্ড! শেষে হাসপাতালে গিয়ে বের করতে হয়েছিল। কখনও রাস্তার ধারে ক্ষেতের পাশে দাঁড়িয়ে জমিতে লাঙ্গল চালানো দেখতে দেখতে ফুরফুর করে বেরিয়ে আসা মাটির মত ফুরফুরে মন নিয়ে সেই লাঙ্গলে চড়ার প্রবল ইচ্ছা জেগে উঠত, কখনও জানলা দিয়ে বৃষ্টিতে ভিজে হাঁটু জলে দাঁড়িয়ে ওদের ধান চারা বোনা দেখতে দেখতে আনন্দে মনটা আমার ছুট্টে ওদের মাঝে চলে যেত।
আহা ! ঐ তো ফুটফুটে পুঁচকে দেখতে কার্তিক ঐ রাস্তা দিয়ে এসে আমাদের বাড়িতে ঢুকে ডাকছে---
" বুইবুই বুইবুই খেলতে যাবিনা?"
" দাঁড়া আসছি -ই " বিছানার পাশের আলমারির মাথায় বসে সাজুগুজু করতে করতে আমি সাড়া দিচ্ছি। তারপর একে একে পাপিয়া, নন,মাম্পি, শর্বরী আর ওর ভাই সবাই মিলে সারা পাড়া জুড়ে,কখনও রাস্তায় কখনও এর ওর বাড়ি ঢুকে, চলত আমাদের আনন্দ উচ্ছ্বাসে ভরা খেলাধুলো। খেলতে খেলতে কখনও করলা নদীর ধার ঘেঁষা কানাই কাকুদের বাড়ির ঝকঝকে লেপা উঠোনের মৌরি গাছ থেকে কাঁচা মৌরি তুলে খাওয়া,কখনও সেই অর্ধেক তৈরি পুরনো বাড়িটায় ভূত ভূত খেলা।কখনও বাঁধের দিকে যেতে প্রথম মোড়টার বাদিকের রাস্তার বাপ্পাদিত্তদের নীচু ডালপালা ছড়ানো কাঁঠালীচাপা গাছে দুদ্দার হুটোপুটি। একদিন আবিষ্কার করলাম ক্ষেতে ধান গাছের ফাঁকে ফাঁকে আমার খুব প্রিয় লাল শাক হয়ে আছে,আমিতো আহ্লাদে আটখানা, বন্ধুদের রাজি করিয়ে সেই প্রথম ক্ষেতে নেমে কেবল তিন চারটে গাছ তুলেছি, হঠাৎ কোত্থেকে জবা দিদি আবির্ভূত হয়ে তাড়া করতেই আমরা চো- চা দৌড়ে সেখান থেকে হাওয়া। সেই ছোট্ট আমি আর একদিন খেলতে খেলতে অবাক বিস্ময়ে পাপিয়াদের বাগানে রঙিন লাল সাদা হলুদ কালো ছিট্ ছিট্ কচুপাতা দেখতে পেয়ে আনন্দে উদ্বেলিত-- কচু পাতাও এত সুন্দর হয় ! আর ঐ যে দেখতে পাচ্ছি, ছুটির নিশ্চুপ দুপুরে বন্ধুদের দলে দাঁড়িয়ে আছি রাস্তার মোড়ে, হঠাৎ শর্বরীর দুষ্টু ভাইটা আমার পিঠে দুমদুম করে কিল মেরে দৌড়ে পালিয়ে গেল! রাগে দুঃখে বাড়িতে ছুটে এসে ঘুমন্ত বাবাকে নালিশ করে সেরকম কোনও প্রতিক্রিয়া না পেয়ে প্রচণ্ড অভিমানে বারান্দায় এসে একটা কাঠি দিয়ে বারান্দা ও সিঁড়ির কোণার মাটিটাকে খোঁচাচ্ছি, ,তখনই ঘটল আশ্চর্য ঘটনাটা-- মাটির ভেতর থেকে একের পর এক কতগুলো ছোটো ছোটো ব্যাঙ বেরিয়ে এসেই ফুলতে শুরু করল। ফুলে যাচ্ছে তো ফুলেই যাচ্ছে! একেবারে যেন টসটসে স্বচ্ছ গোল ছোট ছোট বেলুন হয়ে গেল। এক অদ্ভুত জিনিস আবিষ্কার করে বিস্মিত হতবাক আমি দৌড়ে ঘরে ঢুকে জোর করে বাবাকে ঘুম থেকে তুলে এনে দেখাতেই বাবা দেখলাম তেমন আশ্চর্য না হয়ে হেসে ওটার নাম ভায়া ব্যাঙ না কি যেন একটা বললেন ঠিক মনে নেই তবে কয়েকদিন আমি যেন ঘোরের মধ্যে ছিলাম। আবার দেখার আশায় মাঝে মাঝেই সিঁড়ি কোণার মাটি খুঁড়েও জীবনে আর কোনোদিন কোথাও তাদের দেখা পাইনি। ওমা! ঐযে পুঁচকে আমি নতুন জামা, মায়ের বানানো ফুলের মালা, কপালে চন্দনের টিপ পরে খুশিতে লাফাতে লাফাতে প্রিয়বন্ধু পাপিয়াকে বাড়িতে ডেকে এনে জোর করে নিজের হাতে বড় একটা হাঁড়িতে বানিয়ে রাখা পায়েস দিতে গিয়ে সম্পুর্নটা ওর জামায় ফেলে দিয়ে কাঁচুমাচু মুখে দাঁড়িয়ে আছি! মা ওর জামাটা মুছতে মুছতে বলছেন, "কথা না শুনলে কি হয় দেখলি তো? যা সব বন্ধুদের ডেকে নিয়ে আয় সবাই একসাথে বসে খাবি।" তারপর সবাইকে ডেকে এনে সহজ সরল লুচি পায়েসের অনাড়ম্বর জন্মদিনের অনাবিল আনন্দে ডুবে গেলাম।
আমার ছোট্ট শিশুমন তখন বিস্মিত চোখে সুন্দর পৃথিবীর রূপ রস গন্ধ নিত্য নতুন আবিষ্কার করে চলেছে--- আর তার প্রথম পটভূমি সেই প্রিয় রাস্তাটি। এই রাস্তাতেই তো আমার বিবেকানন্দ দর্শন হয়েছিল!! একদিন সকালে বারান্দায় বসে চাবি দেওয়া সবুজ কামানটা নিয়ে খেলছি-- এমন সময়ে রাস্তায় তাকাতেই আমি স্তম্ভিত! একি দেখছি আমি? একেবারে বিবেকানন্দের অনুকরণে গেরুয়া পোশাক পরা একজন দূর থেকে হেঁটে আসছে, ঠিক একইরকম মাথার পাগড়ি, কোমরে একখণ্ড কাপড় বাঁধা, পায়ে খড়ম, হাতদুটো বুকে ভাঁজ করা, মৃদু হাসি মুখে দীপ্ত ভঙ্গিতে ধীর পদক্ষেপে হেঁটে আসছে! আমার সারা শরীরে তখন আনন্দ আর এক অদ্ভুত অনুভূতির শিহরণ! ঘরের ছবির বিবেকানন্দের মতই তো অবিকল মুখ। এ কি করে সম্ভব? ঐ বয়সে বাবার গল্পের সুবাদে আমি জানতাম যে তিনি অনেক আগের মহাপুরুষ এবং এখন বেঁচে নেই। কতক্ষণ স্থানু হয়ে বসে ছিলাম জানিনা, দেখি বিবেকানন্দ আমার দিকে তাকিয়ে হাসছেন। কি যে করব বুঝে উঠতে না পেরে এক দৌড়ে ঘরে ঢুকে রান্নায় ব্যস্ত মাকে সব বলে, দেখার জন্য টেনে নিয়ে যখন বাইরে এলাম তখন তিনি আর নেই। দৌড়ে গেটের কাছে গিয়ে রাস্তার এপ্রান্ত থেকে ওপ্রান্তে তাকিয়ে কোত্থাও তাকে দেখতে পেলেম না । এভাবে অদৃশ্য হয়ে যাওয়ায় আমার আরও দৃঢ় প্রত্যয় হল যে আমি বিবেকানন্দকেই দেখেছি। "পাগল মেয়ে কি দেখতে কি দেখেছিস " বলে মা তো রান্নাঘরে ঢুকে গেল কিন্তু অনেক বড় বয়স অবধি আমার এই বিশ্বাস অটুট থাকল যে আমি বিবেকানন্দ কেই দেখেছি। কোনও দিনও যুক্তি দিয়ে বিশ্লেষণ করিনি। মাত্র কয়েক বছর আগে এক দুপুরে ঐ ব্যাপারটা নিয়ে ভাবতে ভাবতে এই সহজ যুক্তি দিয়ে তার সমাধান করলাম যে উনি নিশ্চই একই রকম পোশাকে সজ্জিত ও প্রায় একই মুখাবয়বের কোনও সন্ন্যাসী ছিলেন । মাকে ডেকে আনার সময়টুকুর মধ্যেই হয়ত উনি কোনও বাড়িতে ঢুকে গিয়েছিলেন তাই তাঁকে আর দেখতে পাইনি। ঐ সরল বিশ্বাসটায় চির ধরায় মনটা খুব খারাপ হয়ে গেছিল।
অঘটনও কিছু ঘটে ছিল। ঐ রাস্ততেই এক দাদার সাথে সাইকেলে দোকান যাওয়ার সময় স্পোকে পা ঢুকে গিয়ে এতটা আঘাত পেয়েছিলাম যে দু তিনদিন হাসপাতালে থাকতে হয়েছিল। সেই রাস্তারই ড্রেনে পড়ে গিয়ে গুটিগুটি পায়ে কেবল হাঁটতে শেখা ভাইয়ের কোনও ক্রমে চোখটা বেঁচে গিয়ে কপালে কাচ ঢুকে গিয়েছিল।
এখনও চোখে ভাসছে, মায়ের থেকে দশ পয়সা নিয়ে লম্বা রাস্তা ধরে দৌড়াতে দৌড়াতে কানু কাকুর দোকানে যাচ্ছি হজমি কিনতে , আসল উদ্দেশ্য ওর সাথে পাওয়া প্লাস্টিকের ঝকঝকে রঙিন সব ঠাকুরের ফটো সংগ্রহ করা। রোজ একের পর এক ফটো সংগ্রহ করছি আর নিজেকে প্রচুর বৈভবশালী মনে করছি। তখন তো রাস্তায় একটা দুটো সাইকেল ও রিক্সা ছাড়া কোনও গাড়িই থাকত না। রাস্তা দিয়ে যাওয়ার সময় জেলা স্কুলের গেটে মাঝেমাঝে জলপাই রঙের পোশাক পরা সি.আর পি এফ আর্মিরা দাঁড়িয়ে থাকত। কি কারনে যেন ওরা তখন ঐ স্কুলেই থাকত। আমাকে দেখলেই ওদের একজন ডাকত, "খোঁকি খোঁকি ইধর আও।" প্রথম প্রথম ভয় পেলেও যখন দেখলাম উল্টো দিকের বাড়ির আমার মত ছোট্ট মেয়েটাও ওখানে যায় আর ওর বাবা বারান্দায় দাঁড়িয়ে থাকে তখন আমিও যেতাম। হিন্দী তে আমার নাম, বাবার নাম, কি করেন জিজ্ঞেস করে যখন জানল বাবা ঐ স্কুলেরই শিক্ষক তখন আরও বেশি ভালবাসত। কত কথা বলত হিন্দিতে, বেশিটাই বুঝতাম না। গান করতে বললে, "চল চল চল মেরে সাথী ও মেরে হাতি---" দু লাইন গেয়ে দিলে ওরা যে কি খুশি হত। কিন্তু এই নির্মল খুশিতে বাদ সাধল বাড়িতে নতুন নিযুক্ত হওয়া এক কাজের মেয়ে। একদিন ওর সাথে ঐ রাস্তা দিয়ে যাওয়ার সময় আর্মি কাকুটা ডাকলে ও কিছুতেই আমাকে যেতে দিলনা। ওরা দেখলাম ম্লান মুখে তাকিয়ে আছে। এরপর একদিন সেই আর্মি কাকু আমাদের বাড়িতে এসে বাবার সাথে সামনের ঘরে কি সব কথাবার্তা বলল, আর বাবা আমাকে ডেকে বলল যে আমি কেন ওর ডাকে সারা দেইনি, ওরা অনেক দিন হল বাড়ি ছেড়ে এখানে আছে, বাড়িতে ফেলে আসা ছোট্ট মেয়ের কথা ভেবেই আমাকে স্নেহ করে। আমি কারণটা বলেছিলাম। এরপর ঐ রাস্তা দিয়ে গেলে ওরা আর আমাকে ডাকতনা, দূর থেকেই হাসত। আমার খুব কান্না পেত। একেবারেই ছোট আমি জীবনের জটিলতার সাথে যে তখনও অপরিচিত ছিলাম। বড় হয়ে কাবুলিওয়ালা মিনির গল্পটা পড়ে অবাক হয়ে ভাবি এতো অনেকটা আমার জীবনেরই গল্প!
এভাবেই একদিন জলপাইগুড়িকে ছেড়ে যাওয়ার দিন এসে গেল। ঐ তো বাড়ির সামনে বড় ট্রাকটা এসে দাঁড়িয়েছে।ঘরের সমস্ত মালপত্র একে একে তোলা হল তাতে, তারপর আমিও এক বুক কষ্ট নিয়ে বাবা মায়ের সাথে চড়ে বসলাম মটরগাড়িতে। আসলে জীবনটাও তো একটা গাড়ি। কখনও টানা মসৃণ ভাবে এগিয়ে যাওয়া তো কখনও ব্রেক কষে ঝাঁকুনি খাওয়া, আর যেতে যেতে দুপাশের জানলায় পৃথিবীর বিচিত্রতা অবলোকন করা এবং তার জন্য চাই কোনও না কোনও রাস্তা।
গাড়ি চলতে শুরু করল---- দূরে ক্রমশ দূরে সরে যাচ্ছে ঐ রাস্তার পাশে মালা দিদির তৈরি করা ছাদনা তলা, আমার মেয়ে পুতুলের সাথে যেখানে নন র ছেলে পুতুলের বিয়ে হয়েছিল কালই। ক্ষেতের পাকা ধানগুলোও হেলেদুলে বিদায় জানাতে জানাতে অদৃশ্য হয়ে গেল, মিলিয়ে গেল সহজ সরল স্নিগ্ধ মায়া মাখানো সেই রাস্তাটি। এগিয়ে চললাম জীবনের আর এক অধ্যায়ের দিকে-- যার পটভূমি আর এক রাস্তা।
No comments:
Post a Comment