`যে পথ চিনিয়েছে রূপ ও রং....`
চৌপথি: আমার স্মৃতির চারি পথ
সুদীপ দাস
ছোট বেলায় বড়োদের কাছে শুনেছি মানুষের জীবনে একটি পথ বন্ধ হলে নাকি হাজারো পথ খুলে যায়। আমার জীবনেও তাই হলো, জীবনের এই সন্ধিক্ষণে অনেক পথ পেরিয়ে আসতে হলো। হয়তো আরো অনেক পথ চলতে হবে। অনেক ফেলে আসা পথে আর কোনদিন হয়তো যাওয়া হবে না। আবার কখনো নতুন নতুন পথের সন্ধানে বেরিয়ে পড়তে হবে বহুদূর। জীবনে বহু পথ পাড়ি দিলেও আমার স্মৃতির চারি পথের সন্ধান দিলাম।
(১)
নব্বই এর দশক। উঁচু উঁচু ঢিবি সমগ্র প্যারেড গ্রাউন্ড জুড়ে। সবুজ ঘাসের গালিচায় এবড়ো খেবড়ো পথ। এ পথ এখনকার মতো মাঠের ভেতরকার চারদিকে কংক্রিটের পথ নয়। এই পথ মাঠের মাঝখান দিয়ে এঁকে বেঁকে গিয়েছিল। দীর্ঘদিন পা মারিয়ে যাতায়াতের ফলে সৃষ্টি হওয়া এক ফালি পথ বলা চলে। এই পথ পেরিয়েই খুব তাড়াতাড়ি পৌঁছে যাওয়া যেত কলেজহল্টে বা মেইন রোডে। আমরা বন্ধুরা স্কুলেও যেতাম এই একফালি মেঠো পথ পেরিয়ে। এই পথটিকে মানুষের সম্পর্কের গভীরতার সাথে তুলনা করা যেতে পারে। দীর্ঘ মেয়াদী পারস্পরিক সম্পর্ক গুলোতে যোগাযোগের মাত্রা কমতে থাকলে সম্পর্কের মসৃণ পথ গুলো যেমন অস্পষ্ট থেকে অস্পষ্ট তর হয়ে ওঠে, তেমনি এই মেঠোপথে মানুষের যাতায়াত কমতে থাকলে ঘাস গজিয়ে ওঠে। পথ বুজে যায়। বহু স্মৃতি বিজড়িত এই মেঠোপথ অনেক দিন হলো বন্ধ হয়ে গেছে।
(২)
এই পথ আকাশপথ, জলপথ কিংবা পিচের চাদর জড়ানো কোনো কংক্রিটের পথ নয়। এই পথ ছিল বিশ্বাসের। যত বড়ো হতে থাকলাম এই পথে চলতে গিয়ে বারবার শুধু হোঁচট খেতে হলো। যত্ন করে তৈরি হওয়া বিশ্বাসের রাস্তায় কখন যে কারা কাঁটা বিছিয়ে দিয়ে চলে গেছে তা আর বোঝা হয়ে উঠলো না। তাই বলে কী এই পথ বন্ধ হয়ে গেছে! না। এভারেস্ট শিখরে পৌঁছনোর কঠিন পথের ন্যায় মানুষের জীবনে বিশ্বাসের রাস্তাটিও বড্ড কঠিন, সবাই এই পথের পথিক হয় না।
(৩)
বিষয় যখন প্রিয় পথ তখন একটি পথের কথা বলতে ভীষণ ইচ্ছে করছে। দুই পাশে সবুজ জঙ্গলকে সঙ্গী করে কালো বিছের মতো এঁকে বেঁকে চলেছে রাস্তা। ডুয়ার্স রাণী আলিপুরদুয়ার এর দমনপুর শেষ করে জয়ন্তীর দিকে ধাবমান, যা রাজাভাতখাওয়া স্পর্শ করে ডীমা ব্রীজ যাবার একটি মনোরম পথ। চারিদিক সবুজ আর সবুজ। এই পথকে এসি পথ বললেও ভুল হবে না। গ্রীষ্মকালীন তীব্র গরমে এই পথে গাছের ছায়া তলের আরামের জুড়ি মেলা ভার। হাতির এই করিডোরে রেললাইন বরাবর সান্ধ্যকালীন দুলকি চাল মাঝে মাঝেই চোখে পড়ে। ময়ূরের অবাধ বিচরণ এই পথ প্রিয় হবার আরও একটি কারণ। হরেক পাখির কলতান, ঝিরঝির বাতাস আর ছোট্ট নদীর জলপ্রবাহ এই পথকে আরও মনোরম করে তোলে। এই পথেই প্রেমিক প্রেমিকা মোটরবাইকের ধোঁয়া উড়িয়ে সুর তোলে "এই পথ যদি না শেষ হয় তবে কেমন হতো"।
(৪)
পার্ক রোড। তখন ম্যাক উইলিয়াম উচ্চ বিদ্যালয়ের ছাত্র আমি। বিদ্যালয়ের উল্টো দিকেই পার্ক এবং পার্ক রোড । পার্ক এর কথা বলছি আর পার্ক দাদুর কথা বলব না, তা কী আর হয়! এই রাস্তাই দাদুর সঙ্গে এক অম্ল মধুর সম্পর্ক তৈরি করে দিয়েছিলো। যখন খুশি তখন পার্কে গিয়ে জ্বালাতন কার ভালো লাগে। পার্কের দাদু বকাঝকা করলেও তিনিও যে আমাদের পথ চেয়ে থাকতেন তা আর বলার অপেক্ষা রাখে না। প্রতিদিন টিফিনের সময় পার্ক এবং পার্ক রোড থাকত আমাদের দখলে। রাস্তার একধারে ছিল জঙ্গল। কুল, পেয়ারা, আমলকি, জামরুল, পানিয়াল, জলপাই, চালতা, লিচু, বাতাবি লেবুর গাছ ছিল ঐ জঙ্গলে। আর এই সব ফল সংগ্রহের জন্য জন্য পার্ক রোড সংলগ্ন এলাকায় চলত আমাদের বন্ধুদের টহলদারি। আজ এখানে বড়ো বড়ো বিল্ডিং বাড়ি। পার্কে রঙিন ফোয়ারা, অনেক আলোর রোশনাই। দাদুর গত হবার খবরও কোন দিন রাখা হয়নি।
সত্যি এই পথ গুলো হারিয়ে গেছে, যে পথ গুলো একদিন পথ দেখিয়ে নিয়ে গেছে। চিনিয়েছে জীবনের বহু রূপ ও রং। আজ স্মৃতির পথ ধরে সেই সব পথ খুঁজতে গিয়ে ভীষন ক্লান্তি নেমে আসে।
No comments:
Post a Comment