`হৃদয়ের বকুল বিছানো সেইসব পথে.....`
এ পথের অর্ধেকটা গিয়েছেন রবীন্দ্রনাথ
রাজর্ষি দত্ত
একজন আগাগোড়া পথভ্রষ্ট মানুষের পথের কথা বলা দাবীর মধ্যে পড়ে না – তবে পথ
চাওয়ার আনন্দে ‘পথহারা তুমি পথিক’ অনেক প্যাঁচাল পারতে পারে।অতএব পথে নেমেই পথ হারানো
যাক ! তাই বলে যত ‘পথ’ আছে-তত ‘মত’ চালালে কিন্তু কেউ শুনবে
না!
বিগত অর্ধ শতাব্দীর
কাছাকাছি যেসব পথে বেড়িয়েছি তার কিয়দংশও আজ সেইভাবে
পাওয়া যাবে কিনা সন্দেহ! অবশ্যই সেসব পথ জলপথ,
ট্রেন বা বিমানপথ
নয় – পায়ে হাঁটা, সাইকেল, গরুর গাড়ি, রিকশা, ভ্যান,
বাইক কিংবা মোটরগাড়িতে অতিক্রম করা। সেগুলির মধ্যে একটি নয় – একাধিক পথ আমার
মনকে ছুঁয়ে গেছে
(একথা
না বললে সত্যের অপলাপ
!)। হৃদয়ের
বকুল বিছানো সেইসব
পথে আবার ফিরে যেতে চায় মন, কিন্তু মনই দেয় বাঁধা। বলে,কি
হবে গিয়ে? যা ভেতরে আছে তাই থাক না! বাদলবেলায় এত বদল দেখে বিসন্নকুমার না হয়ে ঘরে
বসে জাবড় কাটাই শ্রেয় নয় কি? টাটকা স্মৃতিকে বাসি করার এই অ-কামটি কি না করলেই নয়?
তবে ভয়ে বলবো, না নির্ভয়ে–আমার
একটি প্রিয় রাস্তা আছে (জাতীয় সড়কের তকমা লাগানো)। আজও তার অনেকখানি খুঁজে পাই। সেবকের
রেলসেতু থেকে করোনেশন ব্রিজ পার হয়ে মংপং অবধি পাহাড়ি পথটি। সবাই জানেন এবং গেছেনও
সেখানে। আমার খুব ছোটবেলায়(বয়স মনে নেই)মায়ের পিসির বাড়ি মালবাজারে বেড়াতে আসতাম
শিলিগুড়ি থেকে বাসে চেপে। তিস্তার সবুজ জল, পাহাড়ি ঝর্না, খাড়া নেমে যাওয়া খাদের
গা ছমছমে রোমাঞ্চ, উল্টোদিকে গ্রানাইটের শক্ত প্রাচীর বেয়ে নেমে আসা অগুন্তি
নাম-না-জানা লতা-পাতা, ফার্ন আর দৃষ্টিকে আরাম দেওয়া অসংখ্য প্রজাতির গাছ। পাখিদের
কলতানের সাথে শোনা যায় বর্ষায় নদীর ডাক আর থেকে থেকে ঠাণ্ডা হাওয়ার ঝাপটা। এককথায় বায়োডাইভার্সিটির
সুন্দর প্যাকেজ। তখনও ড্যাং-গ্যাং-ক্যাং (দার্জিলিং-গ্যাংটক-কালিম্পং) যাওয়া হয়নি,
তাই পাহাড়ি পথের অমোঘ আকর্ষণ বলতে ছিল এই মিনিট কুড়ির মিষ্টি জার্নিটা। টানা
বৃষ্টির পর নামে ধ্বস, তখন চাঙড় চাঙর কাদামাটির সাথে গড়িয়ে পড়ে অজস্র নুড়িপাথর।
বন্ধ রাস্তার পাশে সার বেঁধে দাঁড়িয়ে থাকে প্রত্যাশী বাঁদরকুল (ওরা এখানে মানুষের
স্তরে উন্নীত-খাদ্যাভাস ও পরজীবীয়তায়)। সেই থেকে অনেকবার আসা যাওয়া এই পথে। চব্বিশ
ঘণ্টার মধ্যে কোন সময়ই হয়তো বাকি নেই। সে কাকভোর হোক কিংবা মাঝরাত! নানা সময়ে এর
নানা রূপ দেখে মিলিয়ে যায়নি মুগ্ধতার রেশ! তাই আজও বালক বয়সের মত একচুলও কমেনি এর
আকর্ষণ।
সেবকের দ্বিতীয় সেতু নিয়ে চলছে
তোড়জোর। যদি কোনদিন সে কাজ সম্পন্ন হয়, তবে এ রাস্তার গুরুত্ব কমে গিয়ে খুব নির্জন
হয়ে যাবে। আমার অন্তরের বাসনাও তাই। তখন ফ্লোরা আর ফনা আরও নিবিড় উল্লাসে আঁকড়ে
ধরুক পথটিকে। রাজপথ পরিবর্তিত হোক সংকীর্ণ গলিতে। মহানন্দা অভয়ারণ্য থেকে দু-একটা কেঁদো
বাঘ মাঝেমধ্যে তাদের ডোরাকাটা হলকা দেখিয়ে যাক। নেওরা ভ্যালি ফরেস্টের ভালুক নিশ্চিন্তে
ঘুমিয়ে থাকুক রাস্তার পাশে। পাখিদের কিচিরমিচিরে কানে লেগে যাক তালা। প্রিয় পথের
বিবর্তন হোক...উল্টোদিকে!
কল্পনার রংপেন্সিলগুলি এবার
একটু দূরে সরিয়ে রাখি...
এখন শুধু স্বপ্ন দেখি সেই সব
সম্পর্কের গলিগুলির। সম্পর্কের বাঁধন
ছিঁড়ে যায় বলে কত প্রিয় পথে মানুষ আর দ্বিতীয়বার পা ফেলে না! কালের আবর্তনে
'তোমার পথ', 'আমার পথের' থেকে যেমন বেঁকেও যায়, তেমন একটা বয়সে এসে 'সাথিহারার
গোপন ব্যাথা, বলবো কারে সেজন কোথা' এই মানসিক আবর্তেও হাবুডুবু খেতে হয়।
তাই লিজার টাইমে "Most of my best memories come from some old dirt
road"(কে বলেছিল জানিনা বাবা!) –এর চর্বিতচর্বণ আর কাজের টাইমে যুগের/পেটের
দাবিতে লিজার্ডের মত 'ধরা যাক দু-একটা পোকা এবার' হয়ে উঠুক আমাদের জীবনের ক্ষণিকের
যাপন।
No comments:
Post a Comment