`কুচকুচে কালো মসৃণ আরেকটি কানেক্টার`
বন্ধনহীন গ্রন্থি
মৌসুমী চৌধুরী
নাহ্ ... কোন রাজপথ নয়, গ্রাম ছাড়িয়ে অদূরের কোন রাঙামাটির পথ নয়, সবুজ অন্ধকারে ঢাকা রহস্যময়ী কোন বনপথও নয়। সে পথটিকে খোদ মহানগরী বুকে ধরে আগলে রাখলেও সে নিতান্তই সাদামাটা সরু এক পথ। সে আমার প্রিয় পথ। হেলেদুলে এঁকেবেঁকে পথটি গিয়ে মিশেছে চওড়া কুচকুচে কালো মসৃণ আরেকটি কানেক্টার পথের সঙ্গে। সরু সেই পথটির বুকের ওপর দিয়ে সকাল থেকে চলে ব্যস্ত বাস, অটো, রিক্সা। আজও সে পথে গেলে বুক ঢিপঢিপ করে আমার। পথখানা আমার খুব প্রিয় সেইদিন থেকেই যেদিন সেই পথের বাঁকে তাঁর সঙ্গে দেখা হয়েছিল।
সেদিন ছিল আগস্টের মাঝামাঝি এক গোমড়ামুখো দিন। সারাটা দিন আকাশ থেকে ঝুঁকে ভ্রুকুটি করছিল কালোজামা পরা বাদল মেঘেদের দল। শেষ বিকেলে মেঘের বুক চিরে সোনারঙা আলো ছড়িয়ে পড়েছিল মহানগরীর বুকে। ঢিপঢিপ বুকে আমি বসটিতে চড়ে বসেছিলাম, যে বাসটা আমাকে পৌঁছে দেবে সেই গলিতে। সময় যেন পাথুরে ওজন ছড়িয়ে চেপে বসেছিল বুকের ওপর। বাসটা সেদিন ইচ্ছে করে বড্ড সিগনাল খাচ্ছিল। মহানগরীর পথে কি সেদিন অন্যদিনের চেয়ে একটু বেশি বেশি মানুষজনের ভীড় ছিল? বড্ড বিশ্রী জ্যাম জট পেরিয়ে চলছিল বাসটা। অপেক্ষার আনন্দে আমার বুক কাঁপছিল দুরুদুরু! কিসের জন্য যেন কেবলই চোখ জলে ভরে আসছিল! বাসের জানালা দিয়ে বেপরোয়া বাতাস এসে ঘেঁটে দিচ্ছিল আমার চুল। বেশ টের পাচ্ছিলাম আমরা দুজনেই সেই একই বাতাসে নিঃশ্বাস নিচ্ছি। খুব কাছাকাছি। হঠাৎ বাসটা এসে ব্রেক কষে থেমেছিল আকাঙ্ক্ষিত গন্তব্যে। গলির মুখে বাসস্ট্যান্ডে দাঁড়িয়েছিল সে। নীল জীন্স-প্যান্ট আর গাঢ় ধূসররঙা পাঞ্জাবির গাম্ভীর্যের আড়ালে তাঁর মুখে কি ছিল স্মিত হাসির ফুল সম্ভাষণ ? কি জানি! দুরুদুরু বুকে তো সেসব দেখতে পাওয়া যায় না। তবে আমার সবুজ চুড়িদারে মাখামাখি লাল ওড়নাখানা সেই মুহূর্তে যেন ডানা মেলে দিতে চাইছিল। হঠাৎ ধূসর পাঞ্জাবির গাম্ভীর্য ছুঁড়ে ফেলে দিয়ে ভীড় রাস্তার ব্যস্ত গলির মুখে সে শক্ত করে চেপে ধরেছিল আমার হাত। আমার তখন ধরনী-দ্বিধা-হও অবস্থা। বিড়বিড় করে বলে চলেছি, "ছাড়ো... সবাই দেখছে তো।" এ কথায় আমার হাতের ওপর চাপ আরও বাড়তে লাগল। আর যেন পালকের মতো হলকা হয়ে যেতে লাগলাম আমি। কথা বলতে পারলাম না, কী যেন একটা দলা পাকিয়ে রইল গলার কাছে। "সেই পথ" আর "আমরা" ছাড়া যেন কোত্থাও আর কিচ্ছুটি নেই...তারপর সে পথে সে আর আমি হাত ধরাধরি হেঁটেছি মাত্র একশ মিটার। তখন বিকেল মরে নেমে আসছিল শ্লেটরঙা সন্ধে। জ্বলে উঠছিল পথের আলোগুলো। আর সেই পথে সেই আলোময় হেঁটে চলাটুকু-ই আমার বুকের মাঝে যেন উল্টে দিয়ে গেল আস্ত এক রঙের দোয়াত!
তারপর ... হেঁটেছি চেনা-অচেনা আলো ঝলমলে কত রকমারি পথে! কত মানুষ — কত নারী-পুরুষ, শিশু- বৃদ্ধার সঙ্গে ভাগভাগি করে নিয়েছি চলার পথ। কিন্তু মনে রয়ে গেছে সেই পথটি — আমার নিজস্ব "কিনু গয়লার গলি", যেখানে আজও সেই পবীত্র ছোঁয়াটুকু আগলে দাঁড়িয়ে থাকে কোন এক নবীন কিশোর, যার বয়স এ জন্মে আর বাড়ে না!
সেদিনের সেই পথ ও সেই ছোঁয়াটুকু আমাদের বেঁধে দিয়ে গেছে আজীবনের "বন্ধনহীন-গ্রন্থি"তে।
No comments:
Post a Comment