`সাত আট মাইল পথ....`
বিস্মৃতপ্রায় মাইলস্টোনের এক রাজপথ
অমলকৃষ্ণ রায়
পথটা রাজআমলের। মাইল ফলকে মাপা। এ পথ কোনও সহজ-সরল পথ নয়, কখনও মেঠো স্থলপথ, কখনও পিচ ঢালা মোটরগাড়ি ছুটেচলা রাস্তা, কখনওবা নদীপথ, কখনও বিস্তীর্ণ বালির চরের উপর কাশ বিছানো পথ। এই বৈচিত্র্যে ভরা দুর্গম পথই আমায় বাইরের দুনিয়ার সঙ্গে একাত্ম হবার সুযোগ ঘটিয়েছে।
বেশির ভাগ মানুষের জীবনের পথটা সাধারণত অনেকটা এরকমই খানাখণ্ডে ভরা থাকে। সবাই তো আর সোনার চামচ মুখে নিয়ে জন্মায় না। তাই কোনও নিম্নবিত্ত-মধ্যবিত্তের সন্তানকে সেসব পথ সন্তর্পণে পেরিয়ে তার স্বপ্নের গন্তব্যে পৌঁছোতে হয়। তাতে কেউবা সফল হয়, কেউ বিফল হবার যন্ত্রণাটাকে সারাজীবন সঙ্গী করে বাকিজীবন কাটায়। এটাই হলো জীবনসংগ্রাম। তাতে হারজিত থাকবেই।
কোচবিহার জেলার মাথাভাঙা মহকুমার শীতলখুচি ব্লকের এক অখ্যাত গ্রাম আবুয়ারপাথারে সে পথের ধারেই আমার গ্রামের বাড়ি ছিল। সেই বাড়ির পাশ দিয়েই বিছানো রয়েছে সর্পিল আকারের সেই আঁকাবাঁকা রাজআমলের পথ। মাথাভাঙা হাই স্কুল থেকে বারো ক্লাস পাশ করে এবিএনসিল কলেজে বিএসসি পড়তে যাবার সময় এই দুর্গম পথটাই আমায় মাসে-ছমাসে পাড়ি দিতে হতো। সে পথ আমায় মাঝিবিহীন নৌকা পারাপার করতে শিখিয়েছে, শিখিয়েছে একাকী সাইকেলের প্যাডেল চালিয়ে দীর্ঘ পথ পাড়ি দিতে। সে শিক্ষাটাই হয়তো আমায় প্রকারান্তরে সংসারজীবনের হাল ধরার শিক্ষা। নিজেই সংসার নৌকার মাঝির দায়িত্ব কাঁধে আস্ত সংসারকে টেনে নিয়ে যাবার শিক্ষা। আজও স্পষ্ট মনে পড়ে। সুদূর কোচবিহার শহর থেকে সাইকেল চালিয়ে নদীর পাড়ে এসে যখন দেখলাম নৌকাটা পাড়ে বাঁধা। ধারেকাছে কেউ নেই, তখন সাতপাঁচ চিন্তা না করে নৌকার পাটাটনে আমার সাইকেলটাতে শুইয়ে রেখে নির্দ্বিধায় বৈঠাটা হাতে তুলে নিলাম। কোনওরকম প্রশিক্ষণ ছাড়াই নদীটা পাড়ি দিয়ে পাড়ে পৌঁছে দেখি, বনোয়ারী মাঝি বাড়ি থেকে খেয়েদেয়ে খৈনি ডলতে ডলতে বেরিয়ে নৌকাটা দেখতে না পেয়ে ওপারের উদ্দেশ্যে গালাগাল করছে, তোর বাপের নৌকা এটা! মোক না কয়া যে ধরি গেলু! বেজন্মার ঘর। পাশাপাশি আমায় প্রশংসা করে বলেছিল, তুই নৌকাখান আনি ভাল করলু বাপই। না হইলে মোর সাঁতরে আনা খাইল হয়।
জীবনের প্রথম নৌকা চালানোর অভিজ্ঞতা আমায় স্বাবলম্বী হতে শিখিয়েছিল। কোনও প্রতিকূল পরিস্থিতিতে নিজেকে সামলে ওঠার মতো মনোবল তৈরি করে দিয়েছিল। তাই আমি বলব, আমার এই পথই আমাকে জীবনপথের চলার শিক্ষার হাতেখড়ি দিয়েছে। জীবনের পথ সবসময় যা প্রত্যাশিত সেটাই যে হবে, তা নয়। অনেকটা পরীক্ষায় পাঠক্রমের বাইরে থেকে প্রশ্ন এলে যা হয়, মুখস্থের বাইরের অচেনা প্রশ্ন হাতে পড়লে যা হয়, ঠিক সেরকমই। ঘাবড়ে না গিয়ে কী করে মন স্থির রেখে উতড়াতে হবে।
আমার জীবনের প্রথম চলার যে পথের কথা বলছি, সেটার সঙ্গে অন্তত কোচবিহারবাসীর একটা পরিচিতি রয়েছেই। যদিও সেটার যে খুব একটা নামডাক রয়েছে তা নয়। এ পথ আমার শৈশবের গড়াগড়ি দেবার পথ, কৈশোরের দৌরাত্মির পথ, গুরুগম্ভীর ভাব নিয়ে নিজের গ্রামের হাই স্কুলে শিক্ষকতা করতে যাবার পথ। এ পথ আমায় একদিন দেউড়ি পেরিয়ে বাড়ির চত্বর থেকে বেরিয়ে এসে মুক্তমনে বাইরের সমাজসংসারের সঙ্গে পরিচিতি ঘটিয়েছে। এ পথ স্বপ্ন দেখতে শিখিয়েছে। যখন দেখতাম, এই পথ ধরে কেউ কেউ শহরের কোনও সরকারি অফিসে চাকরি করতে যাচ্ছে, তখন ভাবতাম, আমি যদি কোনওদিন তাদের মতো হতে পারতাম।
সেই স্বপ্নটা একদিন কিছুটা হলেও বাস্তবায়িত হয়েছিল। সে পথ একদিন অন্য এক সুদূর প্রসারী পথের মোড়ে পৌঁছে দিয়ে বলেছিল, এবার থেকে নিজের ব্যাপ্তিকে আরও বাড়িয়ে তোল। শিক্ষা-দীক্ষা গ্রহণ করে সমাজে মাথা উঁচু দাঁড়াও। শুধু স্কুল-কলেজ-ইউনিভার্সিটির শিক্ষা নয়, বাইরের জগৎটা তোমাকে নানাভাবে সমৃদ্ধ করার জন্য অপেক্ষা করছে। সমাজের ভালো-মন্দ, ন্যায়-অন্যায়, জ্ঞান-অজ্ঞান বোধ থেকে তুমি কোনটা গ্রহণ করবে, কোনটা করবে না সেটা বুদ্ধিমত্তার সঙ্গে বিচার-বিশ্লেষণ করে সিদ্ধান্ত নেবে।
সারাজীবন ধরে সেটাই করে গেছি। তাতে কতটা ভাল, কতটা মন্দ তুলে এনেছি জানি না, তবে আমার সেই ছোটবেলার চেনা পথ থেকে একের পর এক সুদূর প্রসারী হাজাররকম খানাখন্দ, দুর্গমতার পথ পেরিয়ে জীবনটাকে একটা জায়গায় এনে থিতু করেছি। এবার আত্মসমীক্ষণের সময় এসেছে। সারাজীবন ধরে পথ চলতে চলতে কতটুকু পেলাম, কতটুকু পাবার কথা ছিল অথচ পাইনি। পাওয়া-না পাওয়ার হিসেব মেলাতে গিয়ে যখন ভীষণরকম ধন্দে পড়ে যাই, তখন বারবার আমার সেই ছোটবেলার পথটাই স্মৃতিতে ভেসে উঠে। তখন নিজের উপরে দোষ চাপিয়ে আপনমনে বলি, সেই পথ চলার শিক্ষার হয়তো কোনও খামতি থেকে গিয়েছিল। তাই জীবনে যা পাবার ছিল তার সবটুকু অর্জন করতে পারিনি। তবে এও ঠিক, মানুষের জীবনে প্রত্যাশার কোনও শেষ নেই। তাই যতটুকু অর্জন করতে পারা যায়, তা নিয়েই সন্তুষ্ট থাকতে হয়। আমি সেটা বিশ্বাস করি। তাই জীবনের না পাওয়ার কোনও দুঃখ আমার সুখকে কেড়ে নিতে পারে না।
অনেক কথাই বলা হলো। এবার কোনওরকম কৌতূহল ধরে না রেখে আমার সেই পথটার সোজাসাপটা পরিচয়টা দিয়ে ফেলি। আমার সে পথটা গ্রামের বাড়ি থেকে পিডব্লিউডি মাটির সরক, মানসাই নদী, বালির চর, বাইগনের ছড়া নামের একটা ছোট নদী পেরিয়ে মাথাভাঙা-কোচবিহার সরকের সাতমাইলে গিয়ে ঠেকেছে। চৈত্রের বাইগণের ছড়া নদীতে হাঁটু জল থাকত। সাইকেল ঠেলে পার হয়ে যেতাম অনায়াসে। আবার বর্ষার বাইগনের ছড়ার নদীতে থাকত একটা কলাগাছের ভেলা। তাতে দুটো দড়ি বাঁধা থাকত। ভেলা দিয়ে পার হবার জন্য কোনও মাঝি খাত না। সাইকেলটা ভেলায় তুলে দড়ি ধরে টান মারলেই অন্য পারে পৌঁছে যেতাম। তারপর সে রাস্তা ধরে সুকটাবাড়ি পেরিয়ে আবারও মেঠো পথে নেমে গিয়ে তোর্ষার ঘাটে ঠেকেছে। সেখান থেকে স্রোতস্বিনী তোর্ষা পেরোলেই সাজানো-গোছানো রাজার শহর কোচবিহার। এই বৈচিত্র্যে ভরা পথই হলো আমার জীবনে বড় হতে শেখার প্রথম পথ। প্রশ্ন আসতে পারে, পথিমধ্যে ‘সাতমাইল’ নামের একটা জায়গা কেন? আসলে আমার বাড়ির পাশে রাজআমলের পি ডব্লিউ ডি সরকটির পনেরো মাইলের খুঁটি ছিল। আর সাতমাইল থেকে রাজার শহর কোচবিহারের দূরত্ব সাতমাইল। সেখানেই ছিল সাতমাইলের খুঁটি। সেই খুঁটির এলাকার বাসস্ট্যাণ্ডকে ঘিরে ক্রমশ কিছু দোকানপাট গড়ে উঠতে উঠতে সেটা হয়ে উঠে সাতমাইলের হাট। তাহলে ব্যাপারটা কী দাঁড়ালো, আমার বাড়ি থেকে সাতমাইলের দূরত্ব ১৫—৭=৮ মাইল।
এই সরক আবার পশ্চিমের দিকে আমার বাড়ি ছাড়িয়ে মাথাভাঙা-শীতলখুচিগামী পাকা সড়কে গিয়ে শেষ হয়েছে। সেই তেপথির নাম হলো শিবপুর চৌপথি। সেখানেই ছিল রাজআমলের সতেরো মাইলের খুঁটি। রাজার শহর থেকে সতেরো মাইল দীর্ঘ এই রাজআমলের রাস্তাটার সঙ্গে বর্তমান প্রজন্মের তেমন একটা পরিচিতি নেই। তাই বিস্মৃতপ্রায় এই পথটাকে নিয়েই দুকলম লিখতে ইচ্ছে হলো। কারণ এ পথ আমায় কষ্টসহিষ্ণু হতে শিখিয়েছে। শিখিয়েছে না পাওয়ার গ্লানিকে ভুলে যেতে। শিখিয়েছে জীবনের চাহিদার গণ্ডিটাকে সাধ্যের মধ্যে বেঁধে রাখতে। তাই এ পথের মাইলস্টোনগুলো আজ কিলোমিটারের নতুন খুঁটিতে পালটে গেলেও আমার কাছে এখনও সেটি রাজপথই। বিদ্যাসাগরের মাইলস্টোনে মাপা গ্রাম্য পথের মতো এ পথ আমার কাছে খুবই দামি।
No comments:
Post a Comment