`শান্তিনিকেতনের পথে....`
আন্তরিক পথ
অলকানন্দা দে
উদ্বেগ উৎকন্ঠা দুঃশ্চিন্তার জাল কেটে বের হবার জন্যে একটি পথই তো খোঁজে মন। অশান্তির ঘাম ঘরে বসে না ঝরিয়ে বরং সেই পথে যাই যে পথ আমাকে নির্ভুল আশার তীরে পৌঁছে দেয়। তার ডাকেই সাড়া দেওয়া অভ্যেস একরকম। সুস্থির হয়ে যা অনুভব করি, এই অশান্ত শহরটার বিচিত্র শব্দের জ্বালায় জ্বলে ছত্রভঙ্গ শান্তিরা একত্র হতে চায় কবিগুরুর ঠিকানায়। যে নামের আপাদমস্তক শান্তিতে মোড়া সেই শান্তিনিকেতন অভিমুখী পথ আমার যাবতীয় শুভ’র ভিড়ে ঠাসা একথা বিলক্ষণ বুঝি। অনন্যোপায় হয়ে ছুটি, একরকম পালিয়ে যাই সেইদিকে। পেছনে মিলিয়ে যায় হাইরাইজ ফ্লাইওভারের গোলকধাঁধা। পথের দুপাশের আনকোরা সবুজের প্রশান্তি মনে করায় পুরোনো স্মৃতিদের।একনাগাড়ে ভাসে ছবি! এই পাতার ছাউনি দেওয়া পথটা দায়িত্ব নেয় সেই পুরোনোর। বইয়ের পাতা ওল্টানোর মতো কী নরম সেই ফিরে দেখা যা আপ্যায়িত হয় বোধের কাছে। ঝকঝকে ধান-রঙা রোদ্দুরে হাইওয়ে দিয়ে চলতে চলতে দূরে দূরে ছড়ানো-ছিটানো একচালা-দোচালা ঘরবাড়ি স্বপ্নের মতো সাজানো মনে হয়। কৃষিকাজে ব্যস্ত কৃষক দিব্যি একমনে সাজিয়ে চলেছে তার শস্যের সংসার। কুমড়ো ঝিঙে লাউয়ের মাচায় উপচে উঠেছে চেষ্টার ফসল। মনে মনে বলি তোমাদের আরও হোক। ফসলের হুলুস্থুলে ছু-মন্তর হয়ে যাবে এত পরিশ্রমের ক্লান্তি।
হাইওয়ে ধরে যেতে যেতে বর্ধমান শহরকে পাশ কাটিয়ে একটি রাস্তা ডান হাতে বাঁক নেয়। সম্পূর্ণ গ্রামের মধ্যে দিয়ে পৌঁছে দেয় শান্তিনিকেতন। কী যে অপূর্ব সেই পথের শোভা! যেন এক মায়ার মিছিল, চলছে তো চলছেই। সমান্তরালে বয়ে গেছে রেললাইন। দু একটি ট্রেনের হুইসিল বাজিয়ে ধানজমির বুক চিরে উর্ধ্বশ্বাসে ছুটে যাওয়া এক শব্দের সমারোহ। ট্রেনের ছন্দে বিপুল মাদকতা থাকে, আর থাকে ছুটে চলার আশ্বাস! প্রাপ্তির আর কিচ্ছু বাকি থাকে না যেন এত কিছুর পর। চোখভোলানো ক্লান্তিহরা হাজার হাজার দৃশ্যে জিরিয়ে নিচ্ছে মনটা। ওদিকে আকাশে আকাশে আসন্ন শরতের রটনা প্রশ্ন করতে ভালোবাসে “কি প্রস্তুতি নিচ্ছ বলো দেখি।” মেঘের কবল থেকে রেহাই পেলে যে রোদ্দুর ওঠে, ভালোবাসা আচমন সেরে নেয় তাতে। শুভার্থী তালসারি অনুরোধ করে, “একটা কবিতা লিখো না হয় আমাদের নিয়ে!” কাজ হয় সেইমতো। অনুভবে গেঁথে শব্দমালাদের কবিতাকে সাজাতে সাজাতে একসময় ভূমিষ্ঠ হয় সে মনের আঁতুড়ে। তালের হাওয়ায় রটে খুশির খবর। মেহনতের ক্যাঁচর ক্যাঁচর শব্দ তুলে একটি দুটি গরুরগাড়ি যায় কর্মব্যস্ততায়। ভুবন-ভাসানো চোখে দেখতে থাকি ডাগর মেঠো পথটার থইথই গরিমা। কি গান শুনব? ভাটিয়ালি নাকি রবীন্দ্র! জমে ওঠে মজলিশ বুঁদ হওয়া বোধের ঝিমার্ত পরগণায়।
একরাশ বন্ধুবৎসল উন্মাদনার আস্বাদ নিতে নিতে পথ একসময় উপনীত হয় মহামহীয়ান গাছে ঘেরা শান্তিনিকেতনে। বাতানুকুল আবহাওয়ায় আনন্দ সাঁতার কাটে তখন। একটি আন্তরিক পথ বিনম্রতার সাথে পৌঁছে দিল কাঙ্খিত গাছপালা পত্রপল্লবের সুখের কিনারে। সাক্ষী রইলো সে এই তৃপ্তির অতলে ডুব দিয়ে তুলে আনা সর্বৈব শান্তির কথকতার।
No comments:
Post a Comment