গল্প
লাল গামছা
চিত্রা পাল
পুরনো জমিদার বাড়িটায় ঢুকে জায়গাটা কেমন যেন চেনা চেনা লাগলো ঋজুর’খিলান ,দরজা, জানলা যেন কত পরিচিত। তাহলে কি সত্যিই ও এখানে আগে কোনদিন এসেছিলো? কবে এসেছিলো,কেনই বা এসেছিলো কিছুই মনে করতে পারছে না।অথচ সবই মনে হচ্ছে আগে দেখা।বাড়িটা কেন এত চেনা চেনা লাগছে তার কারণ খুঁজে পাচ্ছে না। তবুও ও ভেতরে ভেতরে চেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছে,ভেবে যাচ্ছে। একবার যেন দেখলো, কে একজন গামছা কাঁধে ওঘরে ঢুকে গেলো।ভাবলো বাড়িটা দেখভাল করার জন্য কেউ আছে হয়তো। সুজয় তখন ছবি তোলায় ব্যাস্ত,খেয়াল করেনি।
দিনের আলো থাকতে থাকতে ও ওর বন্ধু সুজয়কে বললো, চল এই বেলা বাড়িটার পেছনের দিকে , মানে ওই পুকুরঘাটের দিকটায় যাই। ওদিকটা আর বাকি থাকে ক্যানো, চল যাই।বলে এগিয়ে যেতে যেতে সুজয় বলে, তবে বলে দিচ্ছি,আগেভাগেই যে, ওদিকে ওই শুধু ঘাটখানাই আছে,আর কিছু নেই।আর বিকেলের পরে মানে সন্ধ্যেবেলা হলে যাওয়া বা্রণ।ক্যানো?ঋজু জিজ্ঞেস করে।সুজয় বলে,ওই আর কি।কেউ যায় না।শুনে ঋজু অবাক হয়ে যায়। বলে, এখনকার দিনে ওসব কেউ মানে নাকি।চল তাহলে ওই দিকটা ঘুরে যাই। ওই পাশে আর একটা রাস্তা আছে, ওদিক দিয়েও বাইরে বেরনো যায়। তাও এলাম যখন এটাই বা বাদ থাকে ক্যানো, চল ওদিকটাও দেখি । বলে ঋজু সুজয়কে টানতে টানতে ওই ঘাটের দিকেই নিয়ে গেলো।পশ্চিমে সূর্য্যটা বড় অশত্থ গাছটার আড়ালে। তার পাতার ফাঁকফোকর বেয়ে রোদের ঝিলমিল।অশত্থের মাথায় খোলা আকাশ। অনেক ওপর দিয়ে একখানা প্লেন উড়ে গেল,কোন শব্দ না দিয়ে। চারটে তালগাছ দাঁড়িয়ে, পুকুরের ওদিকে বেশ কটা নারকেল গাছ,এদের ফল্কুড়োতেও লোকে এখানে আনাগোনা করে। তাল নারকেল নারকেল পাতা যা পাওয়া যায় তাতেই ওদের লাভে লাভ।
পুকুরটা বেশ বড়,অন্তত আগে যে বড় ছিল, তা মনে হচ্ছে,কারণ চারপাশের ধারের বেশ খানিকটা সংস্কারের অভাবে মজে যাওয়া। আর লোকজন যে যাতায়াত করে তা ঘাটের পাশের পথ দেখলে বোঝা যায়। পুকুরটা আয়তাকার,তার একদিকে জলজ শাপলা গাছে ভর্তি, আর একদিকেঢালুর ধার ঘেঁসে কলমী শাকএর বিছানা। নধর কলমী ডগা বেরিয়ে একের সঙ্গে আর একটা জড়িয়ে আছে। খানিকটা অংশে আবার তা নেই, মানে কেউ বা কারা শাক তুলে নিয়ে গেছে। সুজয় বলেছিলো, এদিকে কেউ আসে না, কেউ থাকে না, তা ঠিক নয়। শাক তুলতে তো আসেই,ওদিকে শাপলা তুলতেও আসে।তাহলে লোকজনের যাতায়াত তো আছেই।ঋজু তখনও একবার দেখলো, কে যেন একজন লাল গামছা কাঁধে নারকেল গাছের পাশ দিয়ে কুল্ গাছের ঝোপের দিকে চলে গেলো।
সন্ধ্যেবেলায় চা খেতে খেতে দুজনেই মোবাইলে তোলা ছবি গুলো দেখছে।ঋজু একটা ছবি দেখিয়ে বলে এই দ্যাখ, সেই লাল গামছাটা। সুজয় বলে,ওটা তো ইঁটের ওপরে সিমেন্টের দাগ, ওখানটায় খানিক খানিক পলেস্তারা উঠে গেছে তাই ওরকম দেখছিস।ছবিটা বড় করে দ্যাখ, তাহলেই বুঝতে পারবি। ঋজু ভালো করে তাকিয়ে দেখে ওমা তাইতো। আবার মনে ভাবনাটা এলো, তাহলে ওখানে কি ভুল দেখলো?যাই হোক এখন আর কিছু বললো না।
ঋজু আর সুজয় কলেজের বন্ধু। খুবই ভাব দুজনের।এবার ঋজু চলে যাবে ব্যাঙ্গালোরে আর সুজয় দিল্লীতে দুজনের উচ্চতর পড়াশোনার জন্যেও।তাই সুজয় এর ডাকেই ঋজুর এখানে বেড়াতে আসা। ঋজু আবার পুরনো প্রাসাদ বাড়ি কেল্লা দেখতে তাদের কথা জানতে বেশ পছন্দ করে। আবার সাহসীও। ভয় ডর কম ।ঋজু এখানে কয়েকদিন থেকে ফিরে যাবে ওর বাড়িতে কলকাতায় মানে, কলকাতার কাছে দমদমে।
এখন ওরা দুজনে বাড়ির সামনের উঠোনে পায়চারি করছে,আর পুরনো দিনের গল্প করছে।কি যেন একটা খস্ খস করে চলে গেল পায়ের কাছ দিয়ে, ঋজু তিড়িং করে লাফ দিয়ে ওঠে।সুজয় বলে ও কিছু নয় একটা দাঁড়াস সাপ। সুজয় গ্রামের ছেলে, জানে সাপ খোপের খবর। বলে ভয় নেই, ওর বিষ নেই,কিছু করে না। আবার দুজনে গল্প করতে শুরু করে। এবার ঋজু বলে,কাল সকালে না আমি একবার ওই পুরোনো জমিদার বাড়িটায় যাব। সুজয় বলে আবার যাবি ক্যানো? না, ওই লাল গামছা কাঁধে লোকটাকে খুঁজে বার করবো। সুজয় বুঝতে পারে, ঋজুর মাথায় ওই লাল গামছার রহস্য ঘুরপাক খাচ্ছে।
পরদিন সকালে দ্যাখে সুজয় ঘুমোচ্ছে।ঋজু ভাবলো, ও ঘুমোচ্ছে ঘুমোক, আমি একাই ঘুরে আসি। বলে ও বেরিয়ে পড়লো। ভাদ্রমাস শরতকাল। চারদিকের গাছপালা সবুজে সবুজ।কি একটা সোঁদা সোঁদা বুনো গন্ধ বাতাসে। পথের ধারে বাসক আসশ্যাওড়া গাছের জঙ্গল।বর্ষার জলে ধুয়ে সবাই সবুজ সতেজ।সব পেরিয়ে ও আবার ওই বাড়িটাতে এলো। এসে এবারে ও সামনের গেট দিয়ে না ঢুকে যেদিক দিয়ে লাল গামছা কাঁধে লোকটাকে যেতে দেখেছিলো সেই দিকে এসে চারপাশে নজর করতে লাগলো কাউকে দেখা যায় কি না। খানিকক্ষণ ঘোরাঘুরি করে কাউকে দেখতে না পেয়ে যখন ফিরে আসছে, তকন ধপ করে কি যেন একটা আওয়াজ হলো,একটু এগিয়ে দেখে ঘাসের মধ্যে একটা নারকেল পড়ে। এদিকে কতগুলো নারকেল গাছ, কোন একটার থেকে পড়েছে নিশ্চয়।ও ওটাকে কুড়িয়ে নিয়ে পুকুরের ধার দিয়েই চললো ওদিকে মানে উল্টোদিকে। ওখানে গিয়ে এদিক ওদিক দেখছে, ওখানেও ওই রকম ধপ করে শব্দ,ভালো করে তাকিয়ে দেখে ওর কাছেই, একখানা পাকা তাল পড়ে। ওখানটায় বেশ ঘাস বিছোনো পুরু করে বলে পাকা তাল হলেও কম ছেতরেছে । একখানা পাকা তাল আর একখানা নারকেল দুহাতে নিয়ে ফিরে যেতে গিয়ে দ্যাখে সেই লাল গামছা কাঁধে লোকটা পুরনো বাড়িটার ভেতরে চলে গেলো। আজ স্পষ্ট লোকটাকে দেখতে পেলো। একটু এদিক ওদিক দেখলো, এদিকে দুহাতে দুটো জিনিস, আর বেলাও হয়েছে,তাই আর দেরি না করে বাড়ির দিকেই হাঁটা দিলো। পথে সুজয়ের ভাইয়ের সঙ্গে দেখা, ও সাইকেলে স্টেশনের দিকে যাচ্ছিলো,ওকে দেখে,সঙ্গে তাল আর নারকেল দেখে সাইকেলেই বাড়িতে পৌঁছে দিয়ে ওর কাজে চলে গেলো।
সন্ধ্যে বেলায় তালের বড়া সহযোগে মুড়ির সঙ্গে চাটা বেশ জমে উঠেছে। সুজয়ের মা আবার সবাইকে গোটাকতক করে তালের বড়া দিয়ে গেলো। ঋজূ বলে তাল আর নারকেল তো পেলাম, কিন্তু ওই লোকটার দেখা পেলাম না। সুজয় বলে, কোন লোকটারে? ওই যে লাল গামছা কাঁধে লোকোটা।ঋজু বললো,আজকেও লোকটাকে দু তিনবার দেখেছে, কিন্তু যতবার কাছে যাবার ভালো করে দেখবার চেষ্টা করেছি, ততবার যেন কোথায় অদৃশ্য হয়ে যায়, আর দেখতে পাই না। সুজয় বলে ওখানে আর তোর না যাওয়াই ভালো। কারা সব ঘুরে বেড়ায় ওখানে কে জানে। শুনেছি, কেউ কেউ নাকি ওরকম দেখতে গিয়ে মারাও গেছে।
আজ খুব সকালে ঘুম থেকে উঠেছে ঋজু। সুজয়ের মাকে দেখতে বললো, আমি একটু বাইরে হেঁটে আসি। বলে বাড়ি থেকে বেরিয়ে ওই বাড়ির দিকেই হাঁটতে লাগলো। হেঁটে বাড়ির পেছনে পুকুর পাড়ে যেতে গিয়ে আবার ওই লাল গামছা ওলা লোকটাকে দেখতে পেলো। ঋজু দৌড়ে ওর দিকে যেতেই ও সুট করে বাড়িটার ভেতরে ঢুকে পড়লো। আজ ঋজু ওকে ছাড়বে না।দৌড়ে ঢুকে পড়ে বাড়িতে।অন্ধকার স্যাঁতস্যাঁতে ঘর দালান, ঝাপসা অন্ধকার ভেদ করে তখনও দিনের আলো ততটা আসেনি।একটা ঘরের দরজার আড়ালে যেন ও দাঁড়িয়ে রয়েছে। ওকে দেখে দৌড়ে ধরতে যাবে, সর সর করে আওয়াজ শুনে চমকে দ্যাখে, একটা সাপ যেন ওর দিকেই আসছে। ও পড়িমরি করে দৌড়ে বেরতে গিয়ে পা স্লিপ করে এক ধাক্কা খেয়ে পড়ে যায় রকের নীচের কাঁটা বনের জঙ্গলে। তখনি ওর গলা দিয়ে একটা আর্তনাদ বেরোয়, আ---। এক মুহুর্তের জন্যে সংজ্ঞাও হারিয়েছিলো বোধ হয়। চোখ খুলে দ্যাখে, সুজয় ডাকছে, ঋজু, ঋজু।
দুপুরে আজ জোর ঘুমিয়েছে ঋজু। আগামী কাল চলে যাবে,তাই আজ সন্ধ্যে বেলার চায়ের আসরে সুজয়ের বাবা ও হাজির। ওর মাও চায়ের কাপ নিয়ে এসে ওদের সংগে যোগ দিয়েছে। সুজয়ের বাবা জিজ্ঞেস করলেন,এখন ব্যাথা নেইতো ত্যামন। ঋজু বললো, কিচ্ছু চিন্তা করবেন না,আমি সেসময়ে একটু ভয় পেয়ে গিয়েছিলাম, তাও সুজয় সাথে সাথে আমাকে ধরে ফেলেছিলো, আমার সঙ্গে বরাবর ছিলো, এখন আমি একদম ফিট। ভালো থাকো বাবা, এখান থেকে অসুস্থ হয়ে ফিরে গেলে আমাদের ও দুশ্চিন্তা থাকবে যে, এই সব কথা বার্তা হচ্ছে, এমন সময়ে সেই লাল গামছা কাঁধে কে যেন ঢুকলো ওদের ঘরে, কেউ কিছু বলার আগেই ঋজু তিড়িং করে একলাফ দিয়ে ওকে ধরে আর কি। সুজয় বলে, কি নারান দা তুমি এখানে? নারান বলে,আমার টাকাটা? ঋজু সুজয়কে বলে, তুই চিনিস একে? সুজয় বলে, হ্যাঁ, মানে আমিই ওকে বলেছিলাম, একটা সাসপেন্স তৈরি করতে, ও নিজেই এটা করেছে। তুই এখানে এসেছিস্ তো তাই একটু মজা করছিলাম আর কি। ঋজু একটা ঘুঁসি বাগিয়েওর দিকে তেড়ে গিয়ে বলে, তোকে এক ঘুঁসিতে না- বলে, হা হা করে হেসে উঠে ওকে জড়িয়ে ধরে।