Wednesday, September 3, 2025


 

মুনা 

অনলাইন ভাদ্র  সংখ্যা ১৪৩২


 সম্পাদকের কথা

প্রকৃতির নানা বিপর্যয়, বৈদেশিক বাণিজ্যে অশনি সঙ্কেত, পরিযায়ী শ্রমিকদের ওপর ক্রমাগত হামলা, এই দেশের নাগরিক হয়েও বাংলা বলবার অপরাধে অন্য দেশে জোর করে পাঠিয়ে দেওয়া, চাকরিহারা যোগ্য  শিক্ষক, অযোগ্য ও ঘুরপথে চাকরি পাওয়া শিক্ষকদের জন্য প্রশাসনের নির্লজ্জ তাঁবেদারি ইত্যাদির মধ্যেই আশ্বিনের শারদ প্রাতে মা আসছেন। 

মা প্রতিবার আসেন। উৎসবে আমরা গা ভাসাই। ভাসাই-ই শুধু। কিন্তু উৎসবের গূঢ় তাৎপর্য গ্রহণ করি না। ফল? ক্রমাগত আত্ম-অবক্ষয়। 

তবু স্বাগত শারদীয়।    


মুনা 

অনলাইন ভাদ্র সংখ্যা ১৪৩২



রেজিস্ট্রেশন নম্বর- S0008775 OF 2019-2020

হসপিটাল রোড 

কোচবিহার 

৭৩৬১০১

ইমেল- mujnaisahityopotrika@gmail.com 

প্রকাশক- রীনা সাহা  

প্রচ্ছদ ছবি- উত্তরবঙ্গের একটি চা-বাগানের পুজো 

সম্পাদনা, প্রচ্ছদ ছবি, অলংকরণ ও বিন্যাস- শৌভিক রায় 


    এই সংখ্যায় আছেন যাঁরা

ড. সৌরভ দত্ত, চিত্রা পাল, বেলা দে, গৌতমেন্দু নন্দী, পার্থ বন্দ্যোপাধ্যায়, অর্ণব ঘোষ, 

কবিতা বণিক, প্রদীপ কুমার দে, অভিজিৎ সেন, লীনা রায়, সুজাতা কর, 

শুভেন্দু নন্দী, ঋতুপর্ণা ধর, সুকল্যাণ দে, আবদুস সালাম, অশোক কুমার ঠাকুর,

উৎপলেন্দু পাল, তৌফিক হোসেন, অমিত আভা, প্রশান্ত লোহারা, দয়াময় পোদ্দার,

দেবাশিস সাহা, পলাশ পাল, বিনিময় দাস, জীবন সরখেল, অপর্ণা সাহা, 

সুচরিতা চক্রবর্তী, মগ্ননীল, মোহিত ব্যাপারী, মোঃ আব্দুল রহমান, 

আকাশলীনা ঢোল, মনোমিতা চক্রবর্তী, সম্রাট দাস, প্রতিভা পাল,

কাঞ্চন দত্ত, অলকানন্দা দে, রাণা চট্টোপাধ্যায়, অমরেশ দাস, 

 রুদ্র, বটু কৃষ্ণ হালদার, অনিতা নাগ, দেবযানী ভট্টাচার্য, 

অর্পিতা রায় আসোয়ার, রীনা মজুমদার, অর্পিতা মুখার্জী চক্রবর্তী, চন্দ্রানী চৌধুরী, 

দেবাশীষ মন্ডল,  মাথুর দাস, প্রণব শংকর গাঙ্গুলী, পংকজ পাল,

প্রাণেশ পাল, প্রিয়াঙ্কা চক্রবর্তী, মজনু মিয়া, যশোজিৎ মুখার্জী, 

তিথি পাল সরকার, হৃদান সরকার



মুনা 

অনলাইন ভাদ্র সংখ্যা ১৪৩২





 


উত্তরযাপন 


মিলেমিশে একাকার সব : এলোমেলো কথা কিছু
ড. সৌরভ দত্ত

 
বাঁকুড়া থেকে বেরিয়ে বেলিয়াতোড় হয়ে বড়জোড়া। তারপর দুর্গাপুর ব্যারেজ পেরিয়ে জেলা বদল। অর্থাৎ বাঁকুড়া থেকে পশ্চিম বর্ধমান। আরেকটু গেলেই আমার পারিবারিক ঠিকানা। কলকাতা থেকে হোক, বা শিলিগুড়ি থেকে, ন্যাশনাল হাইওয়ে দিয়ে দুর্গাপুরে প্রবেশের মুখে প্রথম যে জনবহুল এলাকা, নাম মুচিপাড়া, ঐ রাস্তার কমবেশি নব্বই ডিগ্রী কোণে বাঁদিকে যে রাস্তা, সেই রাস্তার গা ঘেঁষে একটু গেলেই আমার উক্ত পারিবারিক ঠিকানা। গাড়িতে চালক হয়ে হোক, বা আরোহী হয়ে, রুজি রোজগারের তাগিদে বাঁকুড়ার কর্মস্থলে এসে দিন কাটিয়ে রাত পার করে পরদিন হোক বা তার পরদিন, যখন দুর্গাপুরে ফিরে চলার পথ ধরি, সন্ধ্যার আলোআঁধারিতে হঠাৎ কখনো কখনো একেবারে না-বলে-কয়ে আমার মাথায় ভিড় করতে শুরু করে গিলান্ডি নদী, আংরাভাসা, গয়েরকাটা, তেলিপাড়া মোড়, এথেলবাড়ি, বীরপাড়া চৌপথি। অনেকদিনই এরকম হয়েছে যে, গোধূলি বেলায় ফাঁকা রাস্তায় আমার গাড়ি ছুটছে, পখন্না মোড় পেরিয়ে বড়জোড়ায় ঢুকছি, আর এদিকে আমি ভাবছি ঐ তো সামনে বীরপাড়া চৌপথি, সারিবদ্ধভাবে রিক্সা দাঁড়িয়ে আছে, অমুক পালের পাঁচমিশালি দোকানে আলো ঝলমল করছে, তমুক পালের ভাতের হোটেলে সীমিত আলোয় রাতের খাবারদাবারের তোড়জোড় চলছে, বাঁদিকে বীরপাড়া বাজারে ঢুকতে রাস্তার ডানদিকের মন্দিরে নিভু নিভু আলোয় সান্ধ্যকালীন পুজো চলছে। সম্বিত ফিরে আসে বটে এক নিমেষেই, কিন্তু ঐ যে কয়েক মুহূর্তের জন্য সম্বিত ফেরে না, ঐ সামান্য ক্ষণ ধরে একপ্রকার ভালোলাগা চলে ভেতরে ভেতরে। 'ভালোলাগা' বলতে এটিই যেন স্বাভাবিক। যেন সত্যিই আমি জলপাইগুড়ি বা শিলিগুড়ি শহরের কোনো কর্মস্থল থেকে সেদিনের মতো কাজ শেষ করে ময়নাগুড়ি, ধুপগুড়ি হয়ে বীরপাড়ায় ফিরছি! সম্বিত ফিরলে যে একেবারে মনখারাপের বাতাবরণ তৈরি হয়ে পড়ে, এমনটাও ঠিক নয়, কিন্তু মনের অবচেতনে আষ্টেপৃষ্ঠে জড়িয়ে থাকা যে অতীত স্মৃতি, তা থেকে নিস্তার মেলে না। আরো কয়েক মুহূর্তের জন্য যেন একটু গুলিয়ে যায় চলমান অবস্থায় নিজের অবস্থানগত দিকটি। আরোহী না হয়ে চালক হলে পরক্ষণেই মনে হয় যে, গয়েরকাটাই হোক, কিংবা বড়জোড়া, নিজের আস্তানা অভিমুখী গাড়িরাস্তায় তীক্ষ্ণ দৃষ্টি রেখে এগিয়ে চললেই তো হলো, সবই যেন মিলেমিশে একাকার।

 
ভূমিষ্ঠ হওয়ার পর থেকে জীবনের অর্ধশতাধিক বছর পেরিয়ে পেছনে ফিরে তাকাতে গিয়ে অনায়াসে বুঝতে পারি যে অনেক পরিবর্তন হয়েছে জীবনযাপনের পরতে পরতে। এই পরিবর্তন কমবেশি অনেকেরই আসে, সবার না আসুক। দুর্গাপুজোর সময়টাই ধরা যাক। শ্রমিক ও কর্মীদের মধ্যে একপ্রস্থ কৌতূহল চলতো চা বাগানের পুজো ভাতা (বোনাস) নিয়ে। বার্ষিক আয়ের কুড়ি শতাংশ (বিশ পার্সেন্ট) বোনাস হিসেবে মিললে সোনায় সোহাগা। সব বছর মিলতো না এই ইপ্সিত বিশ পার্সেন্ট বোনাস। দু'চার শতাংশ কম পেয়ে সন্তুষ্ট থাকতে হতো হামেশাই। কিন্তু চায়ের বাজার মন্দা, এমন অকাট্য যুক্তিতে যেসব বছর বোনাস ধপ করে নেমে যেতো মাস-মাইনেতে (এইট পয়েন্ট থ্রি থ্রি পার্সেন্টে), রীতিমতো হতাশা গ্রাস করতো। এই অনুচ্ছেদের এতটুকু পড়ে মনে হতে পারে লেখকের প্রথম জীবনের চাকরিস্থল নিশ্চয়ই চা বাগান। না, তা তো নয়। কিন্তু চা বাগানের কৃষ্টি আর সংস্কৃতি গায়ে মেখে তো তিল তিল করে গড়ে ওঠা জীবনপ্রবাহে। শহর থেকে দূরে চা বাগানের ঘেরাটোপে নিম্নবিত্ত ও মধ্যবিত্ত পরিবারগুলোর পারস্পরিক বন্ধন খুবই শক্তপোক্ত। সবকিছু খুব সরল ও স্বচ্ছ। পুজোর কেনাকাটা কার্যত পুরোটাই বোনাস নির্ভর। নির্ভরতা এতটাই যে, 'বোনাস' কথাটি অক্ষরজ্ঞানশূন্য মানুষ থেকে শুরু করে সমস্ত শ্রমিক ও কর্মীদের কাছে পুজোর আনন্দের পেছনে অদৃশ্য এক চালিকাশক্তি। পুজো মানেই একটানা কয়েকদিন ধরে বাগানে ছুটি। চা বাগানের ঘেরাটোপ থেকে একটু হেঁটে জনবহুল এলাকায় গেলেই পুজোর ঢাকের শব্দ বাতাসে ভেসে আসে। মনে অসম্ভব এক শিহরণ জাগে। কাঁসর ঘন্টা সহযোগে এই ঢাকের আওয়াজের জন্যই তো এতদিন ধরে চেয়ে থাকা। নতুন জামাকাপড় গায়ে। নতুন জুতো পায়ে। সপ্তমীর সন্ধ্যায় বাগানের হলুদ-কালো ট্রাকটির মাঠের মাঝখানে এসে নিয়ম করে দাঁড়িয়ে পড়া। ট্রাকে চড়ে বাজারের ঠাকুর দেখতে যাওয়াটা ঐচ্ছিক। কিন্তু সপ্তমীর সন্ধ্যায় মাঠে ট্রাক এসে দাঁড়িয়ে হর্ন বাজিয়ে সবাইকে পুজোয় যেতে যে আহ্বান করবে, তার জন্য কতদিনের অপেক্ষা! পুজো আসার যে অপেক্ষা, সেটাই যেন বেশি আনন্দের, বেশি শান্তির। পুজো চলে আসা মানে তো হুড়মুড়িয়ে পুজো পেরিয়ে যাবার আশঙ্কা আর দুর্ভাবনা। সপ্তমীর দুপুর পর্যন্ত বেশিরভাগ সময়ই যেহেতু বাগানের প্রশাসনিক কাজকর্ম ও চা উৎপাদন প্রক্রিয়া চালু, পুজোর ছুটি সেই অর্থে আরম্ভ সপ্তমীর দ্বিতীয়ার্ধে। তাই সপ্তমী যেন ঘন্টা দুয়েকের মধ্যেই শেষ এবং রাত পেরোলেই অষ্টমীর সকাল। অষ্টমী মানেই অঞ্জলী, কুমারী পুজো। পুজো তখন রীতিমতো মধ্যগগনে। কী আনন্দ কী আনন্দ! অষ্টমীর সন্ধ্যা মন খুলে আনন্দ করার সন্ধ্যা। সন্ধ্যা গড়িয়ে রাত। আনন্দোৎসব রীতিমতো, কারণ হাতে তখনও গোটা নবমী পড়ে আছে। কিন্তু রাত পেরিয়ে নবমীর সকালবেলা থেকেই যেন বছরব্যাপী অপেক্ষা যা কিছুর জন্য, তার বিদায়ের ঘন্টা বেজে যাবার পালা। তা সত্ত্বেও মনপ্রাণ ঢেলে, মনখারাপ ছেড়ে, বেশি রাত পর্যন্ত এই পুজো, সেই পুজো, আড্ডা, খাওয়াদাওয়া। সব সেরে বছরের মতো দুর্গাপুজোর পালা সাঙ্গ করে ঘরে ফিরে আসা। তারপর দশমীর সকাল থেকেই মন্ডপে মন্ডপে বিষন্নতার ছোঁয়া। তবে এই বিষন্নতার ব্যাপ্তি সমাজের প্রতিটি স্তরে নয়। কেবলমাত্র দশমীকে উপলক্ষ্য করে যে মেলা অনুষ্ঠিত হতো, নিশ্চয়ই এখনো হয়, বহু মানুষের, বিক্রেতা হোক বা ক্রেতা, পুজোর মূল আকর্ষণ তা। ওদিকে বিকেল হতেই রীতিমতো মিছিল করে বীরপাড়া ও আশেপাশের চা বাগানের ঠাকুর বিসর্জনের ট্রাকগুলোর ভিড়ে ঠাসা হয়ে এগিয়ে চলা ফালাকাটা অভিমুখে। হয়তো এখনো যায়, বা ভাগাভাগি হয়ে গিয়ে একদল যায় মাদারিহাটে, একদল যায় গয়েরকাটায়, বাকিরা ফালাকাটায়। 'মুজনাই' নামটি দশমীর ঘাটে গিয়েই আমার প্রথম শোনা। দশমীর গোধূলি বেলায় বা সন্ধ্যায় মুজনাই তীরে যে উদ্দীপনার তথা উন্মাদনার ধারাবাহিক সাক্ষী থেকেছি শৈশবের দিনগুলোতে, তার স্মৃতি টাটকা। যেন এই তো সেদিনের কথা সব। কী বিশালাকার প্রতিমা সব! কী সুন্দর সব অবয়ব! কী জীবন্ত অভিব্যক্তি! কী নিখুঁত শিল্পকর্ম! অথচ বিসর্জনের মধ্য দিয়ে সবকিছু কী অনায়াসে নিমেষেই শেষ! পরপর বিসর্জন দেখতে দেখতে একধরণের শূণ্যতায় ডুবে যাওয়া যেন। ভিড়ের মধ্যে হারিয়ে না-যাওয়ার প্রচ্ছন্ন তাগিদে শক্ত করে ধরে রাখা বড়দের হাত। একসময় ফিরতি পথে ভিড় ঠেলে পায়ে পায়ে পৌঁছে যাওয়া দশমীর মেলার মাঠে। কী প্রকান্ড সেই মেলা! ঐতিহ্য ও জনপ্রিয়তার যোগ্য সহাবস্থান যেন। কাঠের ট্রাক কিনতাম নিয়ম করে। রাতে ঘরে ফিরে যত্ন করে ঘরের এককোণে রাখা হতো সদ্য কিনে আনা ঐ ট্রাক। অপেক্ষা পরদিন সকালের। এমনিতে পুজোর ছুটি। পড়াশোনার বিরতি। তাই সকাল হতেই ঐ ট্রাকের পেছনটায় বালি বোঝাই করে দড়ি দিয়ে টেনে টেনে সারা উঠোন জুড়ে ঘোরা। ঘুরতে ঘুরতে.. ঘুরতে ঘুরতে.. কল্পনায় হয়ত বা এঁকে চলতাম দূরের কোনো এক শিল্পশহরকে। সেই এক শিল্পশহর, যেখানে বহু বছর পর পাকাপাকি থাকার এক আস্তানা হবে। সেখানে ভোরবেলায় ঘুম ভাঙলেই গা ঘেঁষে চলে যাওয়া রাস্তায় ছুটে চলবে কতরকমের সব বালি-সিমেন্ট-কয়লা বাহক দূরপাল্লার ট্রাক! কোত্থেকে বা আসে ট্রাকগুলো! কোথায় বা যায়! কিন্তু ট্রাকের কোনো বিরাম নেই। চলছে তো চলছেই। হয় বাঁদিক থেকে ডানদিকে, নয় তো ডানদিক থেকে বাঁদিকে। সব সেই মুচিপাড়া হয়ে। বীরপাড়া চা বাগান, মুজনাই নদী, দুর্গাপুর ব্যারেজ, দামোদর নদ, বড়জোড়া, গয়েরকাটা, কোথাকার কী, দিব্যি মিলেমিশে একাকার হয়ে যায় সব! তখনকার দশমীর মেলা থেকে কিনে আনা কাঠের ট্রাক আর এখনকার পথচলতি বালি-সিমেন্ট-কয়লা বাহক দূরপাল্লার ট্রাক, ভাবনার বৈচিত্র্যে বিদ্ধ হয়ে কেমন গোলমেলে বিবর্তন একধরণের! সময়ের বেড়াজাল ছিন্ন করে গুলিয়ে যায় সব! সম্বিত ফিরে আসার দরকারটাই বা কীসের! এলোমেলো ভাবনার হাত ধরে চলুক না ভালোলাগাটুকু। তাতে কী সুন্দর মিলেমিশে একাকার হয়ে যায় সবকিছু!


 

শতবর্ষ 

"এ বিশ্বকে এ শিশুর বাসযোগ্য করে যাব আমি..."

গৌতমেন্দু নন্দী

কিশোর কবি সুকান্ত ভট্টাচার্যের জন্মশতবর্ষের আলোকে  আলোকিত তাঁর  "ছাড়পত্র" কবিতার উপরোক্ত লাইন আজকের এই আধুনিক প্রযুক্তির যুগে হয়ে উঠুক আমাদেরও " অঙ্গীকার"--------


            শিশু মনের মনোযন্ত্রণা আমরা কি উপলব্ধি  করতে পারি, না উপলব্ধি করতে চাই?  সদ্য হাঁটতে শেখা " হাঁটি হাঁটি পা পা" করে ঘরের  চারদেয়ালের মধ্যে শিশুর ঘুরে বেড়ানোর সময়টুকুও কেড়ে নিয়ে তাকে পাঠিয়ে দেওয়া হচ্ছে বিদ্যালয়ের  গন্ডিতে। খাঁচায় বন্দী পাখির মতো ইচ্ছে ডানা মেলে কল্পনার আকাশে উড়তে পারছে কি?!
         
 "ছোট খোকা বলে অ--আ--শেখেনি সে কথা  কওয়া...." কথা বলতে না শিখলেও তাদের যেন বন্দি করে রাখা হচ্ছে"বিদ্যালয়" নামক যান্ত্রিক এক চৌহদ্দির গন্ডিতে। মুখের ভাষা স্পষ্ট হওয়ার আগেই তাদের ব্যাকরণের জটিল তত্ত্ব শেখানো হচ্ছে। বাঁধ দিয়ে যেমন আটকানো হয় নদীর জলের স্বাভাবিক প্রবাহ তেমনি শিশু মনের স্বাভাবিক  বিকাশকেও জোর করে চাপা দেয় নিয়ম-শৃঙ্খলের পাথর। যে পাথরের চাপে কচি মনের সবুজ ঘাসগুলি  ক্রমশই নিরাপত্তাহীনতার বিবর্ন,মলিন ঘাসে পরিণত হতে থাকে।  সামাজিক এই অনুশাসনের ফলে, নিয়মের কঠোর বেড়াজালে তারা পরিণত হচ্ছে  "বনসাই"-এ। ছেটে ফেলা হচ্ছে তাদের স্বাভাবিক বৃদ্ধি--বিকাশের শিকড় গুলি। পরিপূর্ণ "মানুষ" হয়ে ওঠার অধিকার কেড়ে নেওয়া হচ্ছে। বাসযোগ্য পরিসর তারা পাচ্ছে কি?!

              "এ বিশ্বকে শিশুর বাসযোগ্য করে যাব..." না, এ কবির কোন রোমান্টিক উচ্চারণ নয়, তাঁর  কন্ঠ নিঃসৃত অঙ্গীকার ----এক মন্ত্রোচ্চারণ! এই শপথবানী, এই হৃদয়মন্দ্রিত ধ্বনি আকাশ বাতাস কে যখন মথিত করেছিল তখন ঘটে গেছে  সাম্রাজ্যবাদের পতন আর অভ্যুত্থান ঘটতে চলেছে তখন সমাজতন্ত্রের। জনসমাজের সেই প্রতিভু, নবজীবনের সেই ঋত্বিকের সেই মন্ত্র যখন উচ্চারিত  হল তখন শান্তির আকাশে জমছে সন্ত্রাসের ঘন  কালো মেঘ, বাতাসে বারুদের গন্ধ। 

       রাজনীতি আর ধর্ম যখন একাকার, ধনতান্ত্রিক সমাজ ব্যবস্থায় দেখা দিয়েছে আর্থিক সংকট, যুবসমাজের সামনে হতাশার অন্ধকার, নির্বিবাদে  চলছে সবুজের বিলোপ সাধন, মাঠে ঘাটে জলাভূমি  সাফ হয়ে অপরিকল্পিতভাবে গড়ে উঠছে বহুতল, বই পাঠের অভ্যাস কমে মুঠোফোন নির্ভরতা বেড়েই 
চলেছে, সমাজ মাধ্যম ও গণমাধ্যমে খুন,ধর্ষনের  ক্রমবর্ধমান সংবাদ প্রচারিত হচ্ছে, শিক্ষায় দুর্নীতির
আগ্রাসনে দিশেহারা ছাত্র সমাজ,  ক্ষমতা সর্বস্ব হিংস্র রাজনৈতিক দলাদলিতে অতিষ্ঠ সমাজজীবন তখন যে শিশুটি ভুমিষ্ঠ হয়ে প্রথম দেখবে পৃথিবীর আলো  তার কাছে কোন্ দৃষ্টান্ত আমরা স্থাপন করব?  সেই সদ্যজাতর নিষ্পাপ, নিষ্কলুষ মনের পবিত্রতা  রক্ষা করতে পারব?  ক্রোধ, হিংসা, সন্ত্রাসের আবহ থেকে  মুক্ত করে তাকে পাপ, দূষণমুক্ত এক উন্নত সমাজের আলোয় আলোকিত করতে পারব তো? 

     পৃথিবীর বুকের সমস্ত জঞ্জাল সরিয়ে ঐক্য, সম্প্রীতির দূষণমুক্ত পরিবেশ গড়ে তোলার প্রচেষ্টাই  সার্থক করে তুলতে পারবে কবির "অঙ্গীকার" কে-------এই শপথ, এই প্রতিজ্ঞা আমাদের উচ্চারিত মন্ত্র থেকে হয়ে  উঠুক আমাদের আর্তি----আমাদের জাতীয় আর্তি, আমাদেরও  অঙ্গীকার।


 

রম্য রচনা 


মুঠোফোনের দিনলিপি 
পার্থ বন্দ্যোপাধ্যায়

একটু মোবাইলটাকে বিশ্রাম দাও সব ফুলগাছ গুলোর গোড়া শুকিয়ে কাঠ হয়ে গেল।

আমি হুুঁ বলেও মোবাইল থেকে চোখ সরাতে পারলাম না। বিশ্রাম বললেই কি বিশ্রাম দেওয়া সম্ভব? ঘুমাতে যাওয়ার আগে রাতে মোবাইল  বন্ধ করে রাখার খেসারত দিতে হবে যে। আটটা মিসড কল একচল্লিশটা মেসেজ। ওয়াটস এপের মধ্যে সব চেয়ে গুরুত্বপূর্ণ খবরটাই চাকরিহারা  শিক্ষকদের নিয়ে। 

একটা সময় ছিল যখন বলা হত, " পেন এন্ড পেপার মেকস এ ম্যান রাইটার।" আজকের দিনে গোটা বিষয়টা ১৮০ ডিগ্রি ঘুরে গিয়েছে। মোবাইল ফোনে লেখা হচ্ছে কবিতা,  গল্প উপন্যাস। ব্যাংকের লেন দেন,গান গাওয়া, আবৃত্তি করা, যুদ্ধ সহ দেশ বিদেশের খবর, আপন জনের খোঁজ নেওয়া,  শত্রুদের ট্র‍্যাকিং করা এমন কি ব্লাড সুগার, ব্লাড প্রেসার মাপার কাজটাও সুনিপুণ ভাবে করে চলেছে মোবাইল ফোন। অন্যান্য আর পাঁচটা ব্যবসার মতো, কোটি টাকা ব্যায়ে বানানো  প্যাথোলোজিক্যাল ল্যাবরেটারিও আজ পথে বসতে চলেছে। 

এদিকে ফুলগাছগুলোয় জল দেবার খুবই দরকার। কিন্তু কোনো ভাবেই বলতে পারলাম না তখনই মোবাইলে খবর পেলাম  যে, আমাদের অত্যন্ত প্রিয় টোটো চালক দুর্ঘটনায় পড়ে হাসপাতালে ভর্তি। পড়ি কি মরি করে কিছু কিছু ফুল গাছে ধুপধাপ করে কয়েক বালতি জল ঢেলে বাজার করবার বাহানা দিয়ে  বেরিয়ে পড়লাম।

একটা কাজকে উদ্দেশ্য করে বের হলে মোবাইল ফোন সেই কাজকে যে কোনো অবস্থায় পন্ড করে দিতে পারে। এস এম এসে জানতে পারলাম ছেলের ওয়েট লিষ্টেড রেলের টিকিটটা কনফার্ম হয় নি। ফোন লাগালাম আই আর সি টি সি'র এজেন্টকে তৎকাল টিকিটের জন্য। 

কাজ সেরে বাড়ি ফিরেই আবারও প্রশ্নের মুখোমুখি হলাম, " আজ তো শনিবার,  নিরামিষ।  বাজার তো দরকার ছিল না "। কিন্তু মুখ ফুটে বলতে পারলাম না যে,  নানা রকম তালেগোলে মুল বাজার টাই আনা হয় নি। 

গিন্নীর গাছের নেশা। সন্ধ্যায় টেলিভিশনের ধারাবাহিকগুলো দেখে। তাই কখনো কখনো ফুলকি দাসের সাধু বাবার কি খবর বা আর্য্য কি একাই লন্ডন যাবে জিজ্ঞেস করলেই ব্যাস সব সমস্যার সমাধান। সব রাগ গলে একেবারে জল।

হাজার কাজের বন্ধু এই হাতিয়ারটি কখনো কখনো গোপন প্রেমিকার মতো আড়াল করে চলতে হয়। তবে সারা দিনের শেষে আমরা যখন ঘুমের দরজায় তখন দুজনের কাছেই  মোবাইল খুব শক্তিশালি বন্ধু। গিন্নী লাউড স্পিকার অন করে ধর্ম কথা শুনছে, আমি কানে হেডফোন লাগিয়ে শুনছি রবীন্দ্র সংগীত, গুনছি ফেসবুকের লাইক।

স্কুল যাওয়ার পথে বাইকে মোবাইল ফোন ধরলেই বিপদ। গিন্নীর সতর্কবার্তা সত্যেও ফোন ধরতে হল। সেদিনও  মোবাইলে খুব খারাপ খবর পেলাম। বকুনি খাওয়ার ভয়ে  অযোগ্য এবং যোগ্য প্রসঙ্গ টেনে আনায়, কথার মার প্যাঁচে কিছুটা নিজেকে  বাঁচানো গেল।

কিন্তু গিন্নী ঠাকুর দেবতার ভিডিও, সুসাস্থ্যের জন্য কি কি করনীয়, পে টি এম, ফোন পে গুগল পে বা টাকা ঢোকার এস এম এস গুলো খুব উৎসাহ সহকারে খোঁজ নেয়। রাত্রে মোবাইল ব্যবহারে কোনো নিষেধাজ্ঞা না থাকায় কখনো কখনো সে শাড়ির বিজ্ঞাপন, রান্নার রেসিপি আমাকে দেখায়। একসময় দুই জন ক্লান্ত হয়ে আসি। ঘুম  জড়ানো চোখে বলে ওঠে, এবার থাক, এসবের কোনো শেষ নেই। 

তাই বিভিন্ন সময়ে  মোবাইলের আওয়াজ বাড়িয়ে বা কমিয়ে, মোবাইল ফোন কে সঙ্গী করে ভালোই আছি।


 

গল্প 

স্পর্শ
অর্ণব ঘোষ

রাত ২ টা ১৫। প্ল্যাটফর্মে অপেক্ষায় রুদ্র আর ইন্দ্রাণী। মিনিট পাঁচেক বাদেই ঢুকবে আগরতলা-ব্যাঙ্গালোর হামসফর এক্সপ্রেস। এইবার শেষ চেষ্টা। ট্রেনে চেপে বসল ওরা। ধীরে ধীরে প্ল্যাটফর্ম পেরিয়ে ছুটতে লাগল ট্রেন। একে নিঝুম রাত, তায় অমাবস্যা। গহীন কালোয় আচ্ছন্ন চারিদিক। অন্ধকার আবর্তে যেন নিমজ্জিত দুজন। দুজনেই নির্বাক, অপলক দৃষ্টি জানালার বাইরে। কটুক্তি আর গঞ্জনায় বিদ্ধ ইন্দ্রানীর বুক পাথরের চাই এর মতো কঠিন! কোথায় শেষ এই আঁধারের?
আজ আট বছর অতিক্রান্ত, এখনো কোনো ছেলেপুলে এলোনা ইন্দুর কোল জুড়ে। অথচ কিসের অভাব ছিল ওদের? দুজনেই সরকারী বড়ো চাকুরে, যেমন শিক্ষাদীক্ষা তেমনি চোখ ধাঁধানো রূপ। বংশেও উঁচু, আচরণে মার্জিত।

ঈশ্বর বোধহয় সবাইকে সবটা দেয়না। ওই একটা ব্যপারেই প্রতিপদে উপহাস, অপমান সইতে হয় ওদের, বিশেষ করে ইন্দুকে। সেদিনও তো অফিস কলিগরা বলাবলি করছিল,
- শোন্ শ্রীনিকা, রূপ ধুয়ে কি জল খাবে? মেয়েদের আসল সৌন্দর্য মাতৃত্বে, বুঝলি! ইন্দুকে দেখে রাশ টানল কথায়।

পাশের বাড়ির মিনাদিও মাঝেমধ্যে বরকে শুনিয়ে বলে
- সব মাটিতেই সোনার ফসল ফলেনাগো... রিজুর বাবা।

ইন্দু কি আর এসব বোঝেনা! অথচ দোষটাই বা কী ওদের?

কত ডাক্তারের কাছে কতদিন হত্যে দিয়ে পড়েছিল, পরীক্ষার নামে শরীরটাকে কাটাছেঁড়া করিয়েছে কতো, কতরাত ভিজেয়েছে বালিশের গা, কতদিন গুনেছে প্রতীক্ষার প্রহর!

শেষমেষ যাওবা এল সেও মৃত। সেদিন যেন মাথায় আকাশ ভেঙে পড়েছিল ইন্দুর। পেটের ভার অনায়াসে ন'মাস বইতে পারলেও মনের ভার যেন ছিল রূঢ় পর্বতসম। রুদ্র অসহায়! স্ত্রীকে স্বান্তনা দেবার মতো ভাষা তার অভিধানে ছিলনা। কতবারতো বুঝিয়েছে স্ত্রীকে।_ নিজেকে এভাবে অপরাধী ক'রোনা, ভরসা রাখো ভগবানের ওপর। আজ সেই ঈশ্বরকেই প্রশ্নবাণ ছুঁড়ে দিতে হচ্ছে রুদ্রর। 

দিন দশেক পর..

ভোররাত। পিনড্রপ সাইলেন্স স্টেশনে। পরাজিত সৈনিকের মতো বুকভরা গ্লানি আর মুখভরা যন্ত্রনার ছাপ নিয়ে ফিরল রুদ্র আর ইন্দু। ইন্দুকে আবারও দিতে হবে অগ্নিপরীক্ষা!- নিজের কাছে, পরিবারের কাছে, সমাজের কাছে। এ অপবাদ বয়ে বেড়াতে হবে আজীবন, এ যাত্রার শেষ নেই, এ ক্ষতে দেবার মতো নেই কোনো প্রলেপ!
- মিঃ  রুদ্র। IVF ইস গোয়িং টু বি আনসাক্সেসফুল। আই এম সরি!
কথাটা আবারও  মনে করতেই ভিজে গেছে রুদ্রর চোখের কোণ। ইন্দু আলুথালু, শাড়ীর আঁচল লুটিয়ে পড়েছে পথে, নিজেকে হারিয়ে ফেলেছে ও, দিয়েছে মনের সলিল সমাধি!

চোখের কোণটা মুছল রুদ্র। সামনে আস্তাকুঁড়ে কী ওটা? দৌড়ে গেল। পচাগলা বর্জ্যের স্তুপ থেকে উঁকি দিচ্ছে এক ফুটফুটে মুখ, নিস্পাপ, করুন, সুকোমল। এদিক ওদিক দেখল রুদ্র, নাঃ কেউ নেই, পরম স্নেহে তুলে নিয়ে কোলে দিল ইন্দুর। প্রথমবারের বরষার স্পর্শ যেন ভিজিয়ে দিল রোদেফাটা মাটির কোল! মায়ের কোল!
- ঈশ্বরকে কৃতজ্ঞতা জানাও ইন্দু,.. ও.. ও আমাদের রুদ্রাণী!

আকাশে তখন ছড়িয়ে পড়েছে মৃদু ভোরের আলো।


 

গল্প 

সেপারেটেড হাজভেন্ড এন্ড ওয়াইফ
প্রদীপ কুমার দে


অবুঝ মন তার ইচ্ছাকে স্বীকৃতি দিয়েই শরীর হারিয়েছে।এখন আমি আমাকে ছাড়া। নদীর গতিমুখ জোর করে পাল্টে দিলে যা হয় আর কি? নিজস্বতা নেই। আছে ধার করা আবেগ, অথবা বলা যেতে পারে অন্যর বুলি নিজের কন্ঠে আওড়নো, ইনফ্যাক্ট ইঞ্জেকটেড ফ্রম আউটসাইড।   নাউ অনিকা ইজ কমপ্লিটলি হাইপোথিকেটেড।

সামনের কদম গাছের ছায়াপথেই আড়ষ্টতা মেখে চেয়ার দখল করে বসে ইকোনমি ট্যুরিং কোম্পানির চেয়ারম্যান অনিকা গাঙ্গুলী।

উল্টোদিকে টিম কন্ডাক্টর কাম সোল প্রোপাইটার সুরেশ আহমেদ। সম্পর্ক ব্যবসায়িক।
আরো একটা পরিচিতি ওদের বডি ওয়ালে সেঁটে গেছে, দে আর রিলেটেড এজ হাজবেন্ড এন্ড ওয়াউফ।

কোম্পানীর মিট দি পাবলিক ফুড উইথ গেট টুগেদার অনুষ্ঠানে বাদুড়িয়া বাগান বাড়ি আলোড়িত।

আমি নিমন্ত্রিত। কারণ আমি একজন দামী সাপ্লায়ার। অন্য আর একটা পরিচয় আছে, না ছিল এককালে, এখন আর নেই। 

অনিকাকে বিয়ে করেছিলাম ভালোবেসেই। বিয়ের দুই বছরের মাথায় দামী চাকরি চলে যায়,  কোম্পানী ব্যবসা গুটিয়ে নেওয়ার ফলে। দামী চাকরি করার ঝুঁকি অনেক। হারালে ফেরা কঠিন।
দারিদ্র্য ভালোবাসার শয়তান, মেরে দিল। অনিকা চাকরি খুঁজে নিল। বস সুরেশ আহমেদ। চাকরিতে ঝটপট উন্নতি চেয়ারম্যান বানিয়ে দিল। সহজ নয় যদিও তবে জেন্টলম্যান সুরেশের ভালো নজরেই পড়ে যায় অনিকা।

আমার কাছে ডিভোর্স চায়। আমি বাক্যবায় করেনি। চার বছরের মাথায় সেপারেশন কম্পলিটেড! 

আমি ব্যাবসা শুরু করি দিন বদলায়।  ইষ্টার্ন ইন্ডিয়ার একমাত্র কোল সাপ্লায়ার এজেন্সির তকমা জুটে যায়। সুরেশ আমার শরনাপন্ন হয়।
সেই থেকেই আমরা ব্যবসায়ী।

বিয়ের পাঁচবছর অতিক্রান্ত। আজ এই মিট দা ফেষ্টিবালে এসে জানতে পারি। সুরেশ আর অনিকার এই সম্পর্কটা!


 

গল্প 


পরিযায়ী 
 অভিজিৎ সেন
                        
                             
সঙ্গে আছে দুটো টিশার্ট, দুটো জিন্সের প্যান্ট, একটি গামোছা, একটি পাম বালিস,একটি বিছানায় পাতা চাদর, পাঁচ হাজার টাকা, মোবাইল(তবে টাচ্ মোবাইল নয়,মাত্র হাজার টাকা দামের)এবং মায়ের হাতের তৈরী রুটি-তরকারি নিয়ে বছর পনেরোর রূপ রবিদাস চলেছে ভারতবর্ষের রাজধানী দিল্লিতে। ক্লাস এইট পর্যন্ত পড়েছে। পড়ার ইচ্ছা ছিল কিন্তু আর এগোনো সম্ভব হলো না, তবে মেধার জন্য নয়, অর্থের জন্য। পরিবারে মোট আট জন সদস্য। মা,বাবা ছাড়া তিন ভাই ও তিন বোন । বাবা দিনমজুর। একটি ভাই দুই বছরের আর একজন তিন বছরের বড়ো রূপের থেকে । প্রাথমিক স্কুলের পর পড়া ছেড়ে দিয়েছে ওরা । বাবার সঙ্গে কাজে যেতো । বাবা এতই অসুস্থ কাজে যেতে পারে না। দাদাদেরও নিয়মিত কোন কাজ নেই। তিন বোনই রূপের থেকে বয়েসে ছোট। করোনা মহামারীর পর থেকে তাদের আর্থিক দুরবস্থা চরম আকার ধারণ করেছে। অর্থাভাব দূর করতে লেখাপড়ায় ইতি টেনে রূপ চলেছে নিজের গ্ৰাম, নিজের জন্মস্থান ছেড়ে একেবারে ভিন্ন পরিবেশে। রূপকে কাজের উদ্দেশ্যে যেতে হচ্ছে হিন্দি ভাষা অধ্যুষিত, আত্মীয় বন্ধু বর্জিত দিল্লির মতো মহানগরে । সেখানে একটি প্লাস্টিকের সামগ্ৰি প্রস্তুত কারক কোম্পানিতে চাকরী নিয়েছে মাসিক বারো হাজার টাকার বেতনে,থাকার ব্যবস্থা কোম্পানির। খাওয়া খরচ নিজেকে বহন করতে হবে। গ্ৰাম সম্পর্কের কাকু অবনী মন্ডল তাকে সঙ্গে নিয়ে চলেছে। অবনী বিগত পাঁচ বছর ধরে এখানেই কাজ করে আসছে। প্রতি বছর কোনো না কোন ছেলে অভাবের কারণে তার সঙ্গে কাজের জন্য যায় ।শর্ত শুধু এক বছর তার সঙ্গে কাজ করতে হবে সেখানে । তাদের কাছে লিখিত নিয়ে নেয় অবনী। তাদের প্রমাণ পত্র জমা রাখ এক বছর নিজের কাছে। অবনীর লাভ আছে তাতে সে। মালিকের কাছে কমিশন পেয়ে থাকে । মালিক সস্তা শ্রমিক পেয়ে যায় এবং বছর ধরে পরিশ্রম করিয়ে নেয়, মুনাফা তুলে নেয় কয়েক গুণ । প্রাণচঞ্চল রূপ বাধ্য হয়ে এই শর্ত মেনেই কাজ করতে চলেছে দিল্লিতে।

                রূপের বাড়ি পশ্চিমবঙ্গের এক অজ্ঞাত গ্ৰাম কোচবিহার জেলার মোহনপুরে। তার বাড়ির পাশ দিয়ে বয়ে চলেছে ধরলা নদী।নদীর দুই তীরে তার বাল্য ও কৈশোরের ছড়িয়ে আছে অজস্র স্মৃতি। দুপুর জুড়ে বন্ধুদের সঙ্গে নদীর বুকে সাঁতার কেটে সময় কাটানো, ঘাটে বাঁধা সোলেমান চাচার ছোট খেয়াটি নিয়ে মাঝে মাঝেই উধাও হয়ে যাওয়া। চাচা জানতো এটা কে করেছে? সে পাড়ে বসে অপেক্ষা করতো । মিনিট দশেক পরে রূপ খেয়া নিয়ে এলে এক গাল হেসে চাচা বলতেন,''কেমন মজা পাইলা আব্বাজান ?" রূপ বলতো ''সেই মজা চাচা । তোমার কাজে একটু দেরি করে দিলাম"। চাচা আবার হেসে বলে,''আমার বেটা রহিম আর তুমি কি আলাদা? আমার কাজের কোন ক্ষতি হয় নাই বাপ'' ! এই বলে মাছ ধরতে নদীর বুকে ভেসে চলে যেত। নদীর তীরে বাড়ি, সেই কারণে বর্ষার সময় তাদের গ্ৰাম,জলে ডুবে যেত প্রতি বছর । এটা এখানের খুব স্বাভাবিক ঘটনা। বছর বছর দুর্গা পূজার মতোই যেন ব্যাপারটি ! জল নেমে গেলে বন্ধুরা মিলে মাছ ধরায় নেমে পড়তো। রূপের উৎসাহ সবচেয়ে বেশি ।

             বর্ষা চলে যাওয়ার পর শরতকাল নরম সাদা কাশের দোলায় নদীর তীর আলো করে রাখতো । গভীর নীল আকাশ স্বচ্ছ আয়নায় মতো নদীর স্থির জলে অব্যক্ত প্রতিবিম্ব সৃষ্টি করতো,রূপ সেই দৃশ্যের গভীর থেকে গভীরে হারিয়ে যেত ।‌এক সিগ্ধ মায়াঞ্জনে আচ্ছন্ন হয়ে যেত তার মন । এক সুরেলা আবেগের শিহরণ নদীর বুক থেকে উঠে এসে তার শিরা ধমনীর প্রবাহের সঙ্গে মিশে যেত। শরৎ‌ ভোরের শিউলি ফুলের কোমল আবেশ, শিশির ভেজা ঘাসের রেশম-তুলতুলে আহ্বান,সবুজ কচি কচি চারা ধানের মৃদুল আলোড়ন,শাপলা শালুক ফুলের বহুমাত্রিক সৌন্দর্য,পদ্মবনের মোহিনী মুগ্ধতা সবকিছু মিলেমিশে তার কানে,অনুরণনের মতো যেন কী একটা বেজে চলতো ! দিনরাত শারদীয় ঢাকের চির পরিচিত তাল ও বোল যেন শুনতে পেতো । তার মনে হতো আকাশে বাতাসে কে যেন নূপুর পায়েবেঁধে অতি ধীর লয়ে হেঁটে চলেছে । নিত্যদিনের ব্যথা বেদনা হতাশা ব্যর্থতা দূরে সরিয়ে রেখে গভীর ভালোবাসার টানে মানুষ ঝাঁপিয়ে পড়ে সপরিবারে দুর্গা মায়ের শারদ উৎসবে । শুরু হয়ে যেত বাঙালির আনন্দের উৎসব, দুর্গোৎসব--- ‌রূপ এ আনন্দটুকুর জন্য অপেক্ষা করে থাকে বছর ধরে।

          তাদের গ্ৰামেই খুব বড়ো করে পূজা হয় । সকলকেই দায়িত্ব ভাগ করে নিতে হতো। রূপ ও তার সমবয়সী বন্ধুরা চাঁদা সংগ্ৰহ, মূর্তি আনার কাজ করতো। পঞ্চমীর আগে থেকেই শুরু হয়ে যেত তাদের আয়োজন। মূর্তি পাশের গ্ৰামের মদন পালের ওখান থেকে আসছে শুরু থেকেই। তার পরিবার সুনামের সঙ্গে একাজ করে চলেছে বংশপরম্পরা ধরে । সাবেকি ধাঁচের প্রতিমা, একটি কাঠামোতেই সপরিবারে মা দুর্গ । গ্ৰামের মানুষের অভাব থাকলেও এ কটি দিন আনন্দের ঘোরেই কাটিয়ে দেন তারা মাতৃ আরাধনায় । সপ্তমী,অষ্টমী,নবমী ভালই কেটে যায় দশমীর দিনে মায়ের নিরঞ্জনের সাথে সাথে বিষণ্ণতা নেমে আসে গ্ৰামবাসীর মনে। রূপের মনেও । সেদিন সারা রাত ধরে অতি উচ্চ স্বরে ডি.জে বাজিয়ে বন্ধুরা পিকনিকে মত্ত হয়ে উঠলেও শূন্য মন্ডপের সামনে এলে রূপের মনের ভেতরটা শূন্য হয়ে যেতো।ঔদাসীন্যের ঘূর্ণিঝড় তাকে যেন ঘিরে ধরতো । তাদের পাশের গ্ৰাম শিকারপুরে বেশ বড়ো আকারে কালীপূজা হয়। নানা রঙ্গের বৈদ্যুতিক আলোর রোশনাই দিনের মতো করে তোলে রাতের পথ । শহরের মতো বিগ বাজেটের পুজো না হলেও আমোদ আনন্দের তিল মাত্র অভাব থাকে না। 

                ট্রেনের কামরায় বসে অতীত কথাগুলো স্মৃতির পাতা বেয়ে যতই উঠে আসছিল ততই এক অসহনীয় যন্ত্রণা তাকে ঘূণকীটের মতো করে দংশন করে চলেছিল। এ যেন উদ্বাস্তুদের স্বজন স্বদেশ হারানোর চাপা আর্তনাদ এবং হৃদয়ের রক্তক্ষরণের ধারাবাহিক কালকূট যাপন । কী এক ব্যথা তার বুকের উপর চেপে বসেছে ! অসহনীয় দারিদ্র্য ও অভাবের কাছে সম্পূর্ণ পরাভূত, এই প্রাণচঞ্চল কিশোরটি । শৈশবের, কৈশোরের অচ্ছেদ্য আবেগ ও আকাঙ্ক্ষার বিসর্জন দিয়ে বাস্তবের কঠিন কঠোর মাটিতে হাঁটতে বাধ্য হচ্ছে আজ। নদীর বাঁকের মতো জীবন, জীবন বাঁক নিলে জীবনের চিত্রপট বদলে যায়। জীবন,কবিতার ব্যঞ্জনাময় লালিত্য ছেড়ে গদ্যের ঋজু তীক্ষ্ম পাথুরে পথে হেঁটে যেতে শুরু করে। বাল্য কৈশোরের ভাবনাহীন কল্পোলোক ছেড়ে রূপকথার, কার্টুনের আর খেলাধুলার জীবন ও জগৎ ছেড়ে রূপ লক্ষ লক্ষ পরিযায়ী শ্রমিকের একজন আজ । দেশে,পরিযায়ী শ্রমিকের একটি সংখ্যা শুধু মাত্র বৃদ্ধি পেল !

             নিউ কোচবিহার রেল স্টেশন থেকে যাত্রা শুরু করেছে। ট্রেন একটু একটু করে গতি বাড়িয়ে চলেছে। তার চেনা পৃথিবীকে,সহজ আনন্দের জগতকে, আত্মীয়,বন্ধু,পরিবারের সকলকে পিছনে ফেলে  এগিয়ে চলেছে এক নতুন অচেনা মানুষের পৃথিবীতে। কিছুতেই মনকে শান্ত করতে পারছিলো না। আবার পিছিয়ে আসাও সম্ভব নয়। পরিবারের সদস্যদের রক্তশূন্য মুখ,অভুক্ত রাত, অনিশ্চিত ভবিষ্যৎ,বাবার অসুস্থতা, মায়ের নির্বাক চোখের আতঙ্ক, ছোট ছোট বোনেদের সারল্য মাখা মায়াবী  চোখের অবুঝ আবদার তাকে কোথা থেকে যেন  আসুরিক রকমের শক্তি যুগিয়ে চলেছে-- দূরে কাজে যেতে । বিভিন্ন স্টেশনে গাড়ি এসে দাঁড়াচ্ছে। কতো বিচিত্র মানুষ, কতো বিচিত্র পোশাক, ভাষা ও খাবার। জীবনে এতোকিছু সে একসাথে কোথাও দেখেনি। একবার কোচবিহারের মদনমোহন ঠাকুরের রাসের মেলায় এসেছিল। সেখানে দেখেছিল অনেক রকম মানুষকে । কিন্তু আজকের মতো এত বৈচিত্র্য আর কখনো দেখেনি । আজ জীবিকার প্রয়োজনে, অভাবের নির্মম চাবুকে রেসের মাঠের ঘোড়ার মতন ছুটে চলতে হচ্ছে যেন তাকে ।

       মাতৃভূমি বাংলা পার হয়ে গেছে। হিন্দি ভাষা অধ্যুষিত এলাকায় গাড়ি ছুটে চলেছে। হিন্দি ভাষা বোঝে, কাজ চালানোর মতো বলতেও পারে । ট্রেনের কামরায় বসে জানালার ফাঁক দিয়ে দুরন্ত বেগে পেছনে ছুটে যাওয়া গাছ, মানুষ,নদী,বাজার,হাট,খেলার মাঠ,শ্মশান যা যা চোখে পড়েছে যতোটা পারছে মনের খাতায় ছবির মতো এঁকে নিচ্ছে। হঠাৎ অবনী কাকু বললো," কি রে কিছু খাবি ? অনেকক্ষণ কিছু তোর খাওয়া হয় নি।" মুড়িমাখা,চা দুজনে‌ খেলো। অবনীর ধূমপানের অভ্যাস। কিন্তু ট্রেনে খায় না, জরিমানার ভয়ে। তামাক পাতার গুঁড়া হাতের তালুতে মিহি করে দলে তার কালো ঠোঁট ফাঁক করে দাঁতের গোড়ায় ঠেলে দিলো । ভাবুক স্বভাবের রূপ বিস্ময়ভরা চোখে ট্রেনের জানালা দিয়ে বাইরের অজানা পৃথিবীর দিকে তাকিয়ে আছে। রাতে মায়ের দেওয়া খাবার খেলো । গভীর রাতের শীতল স্নিগ্ধতা এতোটা রমনীয় ও কমনীয় হয় রূপের আগে এতটা অনুভব হয়নি, আজ যতটা হচ্ছে। হয়তো বাড়ি থেকে দূরে আছে বলে । বাড়ির আশেপাশের রাত্রিকালীন নীরবতাও মনে পড়ছে খুব গভীরভাবে । রাতের আঁধার ও নীরবতার বুক চিরে দুরন্ত গতিতে গাড়িটি প্রচন্ড শব্দ করে এগিয়ে চলেছে । পেছনে ছুটে চলে যাচ্ছে প্রতিটি মুহূর্ত। বিচ্ছেদ যে জীবনের অবিচ্ছেদ্য অঙ্গ,আজ বেশ বুঝতে পারছে রূপ । জীবনের কোন সম্পর্কই স্থায়ী নয়,অটুট নয় যেন এই কয়েক ঘন্টার মধ্যেই সে বুঝতে পেরেছে ।

          যখনই কোন স্টেশনে এসে দাঁড়াচ্ছে তখন কেউ জলের বোতল নিয়ে, কেউ কাগজের মতো পাতলা রুটি ও ঝাল ঝাল আলুর তরকারি নিয়ে, কেউ বিরিয়ানির প্যাকেট নিয়ে,দই, মিস্টি নিয়ে ছুটে আসছে । গাড়ির কামরায় ঘুরে বিক্রি করছে । দুই বা তিন মিনিটের বিরতির ফাঁকে যাত্রীদের মধ্যে কেউ কেউ প্ল্যাটফর্মে নেমে প্রয়োজনীয় সামগ্রী সংগ্রহ করে নিচ্ছে । ট্রেনের কামরায় হকাররা সূচ থেকে শুরু করে চাদর,গামছা,পিলো, বাচ্চাদের খেলনা বেশি দামে বিক্রি করছে। কেউ কিনছে, কেউ দেখে ফিরিয়ে দিচ্ছে । স্টেশনে ছোট ছোট ছেলে মেয়েরা ভিক্ষে করছে । অর্থ ও খাদ্য চেয়ে যাত্রিদের পা জড়িয়ে ধরছে । কেউ আবার রেলের কামরার নোংরা মেঝে ঝাড় দিয়ে যাত্রীদের কাছ থেকে টাকা সংগ্রহ করছে। একদল কিন্নর তাদের কামরায় এলো । দুই হাতে তালি দিয়ে যাত্রীদের কাছ থেকে অর্থ সংগ্রহ করতে শুরু করল । রূপ এদের কথা শুনেছিল আগে দেখেনি আজ দেখলো কাছ থেকে । যারা দিচ্ছে মাথায় হাত দিয়ে আশিস্ দিচ্ছে না দিলে কেউ অশ্লীলভাবে অঙ্গভঙ্গি করছে বা গালাগাল দিচ্ছে। রূপ যতো এগিয়ে চলেছে জীবনের রহস্য বর্ণময় হয়ে ধরা পড়ছে তার জিজ্ঞাসু কিশোর চোখে । অন্ধ ভিক্ষুক বাঁশি বাজিয়ে গান করছিল। রূপ তার হাতে দশ টাকা দিলো । গান শুনে রূপের উদাস মনও গুন্ গুনিয়ে উঠলো-- "কোথায় ছিলাম কোথায় এলাম পাখির নেই স্থায়ী ঠিকানা/পাখি কাঁদে, আর কাঁদে পাখির আপনজনা ।" তিন দিন পরে তারা দিল্লি এসে পৌঁছায়। তাদের জায়গা কারখানার ভেতরে বস্তি এলাকার মতো ছোট ছোট ঘরে ।এক ঘরে দুজন করে থাকার ব্যবস্থা। দুটি চৌকি পাতার পরে মাঝে দুই হাত জায়গা অবশিষ্ট থাকে, সে সংকীর্ণ পথে দুজনকেই যাতায়াত করতে হয়। মোট ষাটজন শ্রমিক সেখানে থাকে । স্নানাগার ও শৌচাগার বেশ কয়েকটি আছে তবে সকলের জন্য । শ্রমিকদের মধ্যে দিল্লির কেউই নেই, বেশির ভাগই বাংলা, বিহার এবং ওড়িশা থেকে এসেছে। প্রত্যেকের সমস্যা এক একটি ট্র্যাজেডি।পরেরদিন সকাল আটটায় সাইরেন বাজে । সাইরিন বাজার দশ মিনিটের মধ্যে কাজে যেতে হবে । আগের দিন অবনী কাকু কারখানার নিয়ম বুঝিয়ে দিয়েছিল। রূপ সকাল পাঁচটায় প্রতিদিন ওঠে,প্রাতকৃত্য করে, সামান্য কসরতের পর ছোলা গুড় খায় । আজ তাই করে কাজের উদ্যোশে বেরোলো। বিকাল পাঁচটা পর্যন্ত কাজ। মাঝে বেলা ১টা থেকে ১টা৩০ পর্যন্ত বিরতি। ভেতরে ক্যান্টিন আছে। দিনে ও‌ রাতে খোলা থাকে। রূপের রান্নার সমস্যা থাকলো না । এখানেই খাওয়া দাওয়ার ব্যাবস্থা হয়ে গেল। খাওয়া খরচ অস্বাভাবিক নয়, এটাই রক্ষ্যা । দেখতে দেখতে এক মাস কেটে গেল। রূপ পরিবেশের সঙ্গে মানিয়ে নিয়েছে। রূপের মতই পরিস্কার ও সরল মনের উজ্জ্বল মহাপাত্র নামের ষোল বছরের ছেলেটি। সে এই ঘরে থাকে । তার বাড়ি উড়িষ্যায়। রূপকে তারও ভালোই লেগেছে। তেমনি রূপেরও ।

             রূপ, এখানে আলো ঝলমলে রাতের প্রশস্ত সরক দেখেছে, দ্রুতগামী যানবাহন দেখেছে, অগণিত বিদেশি পর্যটক দেখেছে, নানা ধরনের মনোলুব্ধকর খাদ্যের নিত্য আয়োজন দেখেছে,ভোগ বিলাসের স্রোতে ভেসে যাওয়া মানুষদের দেখেছে---সব ধরনের আয়োজন ছড়িয়ে আছে  শুধু প্রয়োজন অপর্যাপ্ত অঢেল অর্থের। বিলাসিতায় গাভাসানোর অবকাশ ও মানসিকতা তার নেই। সহজ সরল জীবনযাপন করতেই বরাবর পছন্দ করে রূপ। সে এখানে কেন এসেছে একটি মুহূর্তের জন্যও ভোলেনি, নাগরিক বিলাসিতায় প্রলুব্ধ হয়ে ভেসে যায়নি । মন দিয়ে সে কাজ করে। ফাঁকি দেয় না কাজে। অবনী কাকু এবং কারখানার মালিক দুজনেই তার প্রতি সন্তুষ্ট। 

                যখন বাড়ি থেকে রওনা হয়েছিল তখন শ্রাবণ মাস । আজ তার কাজের এক মাস পূর্ণ হলো। এটা ভাদ্র। শরতের সূচনা কাল । বাংলার আকাশে বাতাসে ঢাকের কাঠির বোল বাজতে শুরু করেছে। দিল্লির প্রকৃতি একেবারে  ভিন্ন চরিত্রের । শুষ্কতা, ধোঁয়া । গগনচুম্বী ইমারত, দূষণযুক্ত শ্বাসরোধী বাতাস, কলুষিত যমুনার প্রবাহ, ঘিঞ্জি এলাকার মানুষের অস্বাস্থ্যকর জীবন যাপন, আবেগ শূন্য ও আত্মকেন্দ্রিক,ভোগসর্বস্ব ও যান্ত্রিক জীবনে শরতের সামান্য ছোঁয়াটুক পর্যন্ত নেই। রবিবার ছুটি । দীপাবলিতে দুদিন ছুটি থাকে। দুর্গা পূজার কোন ছুটি নেই। এক রবিবারে উজ্জলকে নিয়ে যমুনার তীরে বেড়াতে এসেছিল। ছোট থেকেই তো সে মুক্ত পাখির মতন ঘুরে বেড়াতে ভালোবাসতো । যমুনার তীরে বসে তার বাড়ির পাশের নদীর কথা, নদীর দু ধারের সৌন্দর্যের কথা মনে পড়ছিল । শরতের সময় বাড়ি থেকে একটু দূরে মানসাই নদীর তীরে ত্রিকোণীয়ার ছোট্ট পার্কটিতে সাইকেল করে চলে আসতো । এ সময় নদী যেন স্বচ্ছ আয়না । ছোট ছোট ডিঙ্গি নৌকো ভেসে চলেছে। নীল আকাশের বুকেও ভেসে চলেছে পাল্লা দিয়ে সাদা বর্ণের‌ মেঘ--নৌকার মতন।একেই স্বর্গের শোভা মনে হতো তার। মেঘখণ্ডগুলো যেন পৃথিবী থেকে বার্তা নিয়ে চলেছে কৈলাসের উদ্যেশ্যে । মা দুর্গা যেন পরিবার সমেত পৃথিবীর সন্তানদের সঙ্গে কয়েক দিন আনন্দে আবেগে কাটিয়ে যান । শারদীয়ার দুর্গোৎসব বাংলার সমগ্ৰ প্রকৃতি জুড়ে যে ধরনের মাদকতা ছড়িয়ে দেয়, এক অলৌকিক আবেগ সকলের মনের স্তর ধরে নামতে থাকে চৈতন্যের নানা স্তরে । অজস্র ইচ্ছারা জমাট বাঁধে মধুর চাকের মতন তখন থেকেই । বাংলার আকাশ বাতাসে, প্রতিটি ঘাসে, ভোরের শিশির বিন্দুতে, মাটির বুকে ছড়িয়ে থাকা শিউলি ফুলে, পদ্মফুলের জলবিন্দুতে,শুভ্র অথবা খয়েরি রঙের অজস্র শাপলা-শালুকে,সবুজ কচি চারাধানের সুশীল শিহরনে, ভোরের হিমেল হাওয়ার দোলায় মায়ের আগমনের পদধ্বনি যেন প্রতিটি মুহূর্তে শুনতে পেয়ে থাকে বাঙ্গালী তার সমগ্ৰ সত্তা জুড়ে। রূপ, উজ্জ্বলকে বলছে," আর পনেরো দিন পরেই আমাদের ওখানে দুর্গাপূজা। পূজায় কতো যে আনন্দ হয় তোমাকে কী বলবো। এবার ভেবেছিলাম বন্ধুরা মিলে চপ,মোমোর দোকান দিবো, হলো না। পূজার কয়টি দিনই আমাদের আনন্দের দিন। বাকি দিনগুলো যন্ত্রণার কাঁটাই আমাদের পাথেয় । " এই বলে রূপ দীর্ঘশ্বাস ছেড়ে কাজে যাওয়ার জন্য প্রস্তুতি নিতে লাগলো। দুর্গাপূজা চলে এলো। দুর্গাপূজায় ছুটি পাওয়া যায় না । গেলে বিনা বেতনে যেতে হবে। কাল পঞ্চমী । সে নেই।গ্ৰামে পূজার আয়োজন চলছে। সে নেই সে যন্ত্রণা শুধু তার নিজের। দিল্লিতে বাঙ্গালীরা মিলে কোথাও পূজা করে থাকলেও বাংলার মতো আনন্দ কোথায়? সবেতেই কৃত্তিমতা, যান্ত্রিকতা।

       ষষ্ঠীও চলে গেল। আজ সপ্তমী। পঞ্চমীর আগে থেকেই দেবী দর্শনের জন্য বাংলার বুকে জনস্রোত বন্যার মতোই নেমে আসে। এখানে সেই আবেগ,উৎসাহ কোথায়?কাজ করতে করতে এসব ভাবছে । নীল আকাশের দিকে তাকিয়ে আছে। দেখতে পেল দূর থেকে একদল আকাশী-হলুদ রঙের বিদেশি পাখির ঝাঁক মাথার উপর দিয়ে উড়ে চলে গেলো। পাখিগুলো দেখে সে চিনতে পেরেছে। এদের সে তাদের বাড়িরওখানে নদীর পাড়ে দেখেছে । শরৎকালেই আসে বাংলায় এই পরিযায়ী পাখির দল,শরতের শেষে আবার ফিরে যায় । রূপ বাড়ি ফিরে যেতে পারলোনা পুজোর দিনে ! তাই যেন পাখিগুলোর ডানায় মনকে পাঠিয়ে দিল তার গ্ৰামে । 

          বন্ধুদের মধ্যে একজন নবমীর রাতে রূপকে ফোন করেছে । রূপের সঙ্গে কতো কথা হলো। সে বললো, "আমি ভিডিও কল করছি তুই গ্ৰামের পূজার আয়োজন দেখ্ । ও তোর ফোনে তো ভিডিও কল হবে না। অবনী কাকুর ফোনে হবে ।" রূপ ভিডিও কলে গ্ৰামের দুর্গা পূজার আয়োজন দেখলো কয়েক মিনিট, তারপরে যোগাযোগ বিচ্ছিন্ন হয়ে গেল । পরিস্থিতি ও জীবনের কঠিন বাঁক রূপকে বাধ্য করেছে অনলাইনে নিজের গ্রামের দুর্গাপূজা দেখতে । জীবন কখন কাকে কোথায় এনে দাঁড় করাবে কেউ বলতে পারে না ! রূপ টাকা রোজগার করছে, বাড়িতে পাঠিয়েছে। বাড়ির আর্থিক দুরবস্থা ধীরে ধীরে দূর হতে শুরু করেছে। জীবন তার নানা পরীক্ষা নিয়ে চলেছে । তার ব্যবহারে আর কাজে মালিক খুশি। কোম্পানিতে তার আয় বেড়েছে, পদোন্নতি হয়েছে। এখন সে অবনী কাকুর শর্ত থাকে মুক্ত । দেখতে দেখতে পাঁচ বছর চলে গেল। পরিযায়ী পাখির দলটি ঠিক সময়ে তার মাথায় উপর দিয়ে শব্দ করতে করতে উড়ে যায় । তারা তার গ্ৰামের নদীর চরে যাবে,আবার এ পথ ধরেই ফিরে আসবে । রূপ সেটাই দেখে প্রতিবছর । রূপের অনেক দায়িত্ব। অনেক টাকা উপার্জন করতে হবে। যখনই ওই পরিযায়ী পাখিগুলোকে দেখে তখন রূপের শৈশব, কৈশোর,নদীর চর,গ্রামের খেলার মাঠ সব যেন আবর্তিত হতে থাকে তার চৈতন্যের প্রতিটি স্তর ধরে। দিন রাতের মতো সে শুধু ঘুরে চলেছে চাকার মতো । তার বাড়ি ফেরার আকাঙ্ক্ষা পরিযায়ী পাখির ডানায় উড়তে থাকে,আর সে দিল্লির ছোট্ট ঘরটির সংকীর্ণ জানালার ফাঁক দিয়ে দূরে উড়ে যাওয়া পরিযায়ী পাখিগুলির সাথে মনে মনে ! কোথায় যেন উড়ে যেতে থাকে ?


 

 গল্প 


লাল গামছা

  চিত্রা পাল 


পুরনো জমিদার বাড়িটায় ঢুকে জায়গাটা কেমন যেন চেনা চেনা লাগলো ঋজুর’খিলান ,দরজা, জানলা যেন কত পরিচিত। তাহলে কি সত্যিই ও এখানে আগে কোনদিন এসেছিলো? কবে এসেছিলো,কেনই বা এসেছিলো  কিছুই মনে করতে পারছে না।অথচ সবই মনে হচ্ছে আগে দেখা।বাড়িটা কেন এত চেনা চেনা লাগছে তার কারণ খুঁজে পাচ্ছে না। তবুও ও ভেতরে ভেতরে চেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছে,ভেবে যাচ্ছে। একবার যেন দেখলো, কে একজন গামছা কাঁধে ওঘরে ঢুকে গেলো।ভাবলো বাড়িটা দেখভাল করার জন্য কেউ আছে হয়তো। সুজয় তখন ছবি তোলায় ব্যাস্ত,খেয়াল করেনি।  

  দিনের আলো থাকতে থাকতে ও ওর বন্ধু সুজয়কে বললো, চল এই বেলা বাড়িটার পেছনের দিকে , মানে ওই পুকুরঘাটের দিকটায় যাই। ওদিকটা আর বাকি থাকে ক্যানো, চল যাই।বলে এগিয়ে যেতে যেতে সুজয় বলে, তবে বলে দিচ্ছি,আগেভাগেই যে, ওদিকে ওই শুধু ঘাটখানাই আছে,আর কিছু নেই।আর বিকেলের পরে মানে সন্ধ্যেবেলা হলে যাওয়া বা্রণ।ক্যানো?ঋজু জিজ্ঞেস করে।সুজয় বলে,ওই আর কি।কেউ যায় না।শুনে ঋজু অবাক হয়ে যায়। বলে, এখনকার দিনে ওসব কেউ মানে নাকি।চল  তাহলে ওই দিকটা ঘুরে যাই। ওই পাশে আর একটা রাস্তা আছে, ওদিক দিয়েও বাইরে বেরনো যায়। তাও এলাম যখন এটাই বা বাদ থাকে ক্যানো, চল ওদিকটাও দেখি । বলে ঋজু সুজয়কে টানতে টানতে ওই ঘাটের দিকেই নিয়ে গেলো।পশ্চিমে সূর্য্যটা বড় অশত্থ গাছটার আড়ালে। তার পাতার ফাঁকফোকর বেয়ে রোদের ঝিলমিল।অশত্থের মাথায় খোলা আকাশ। অনেক ওপর দিয়ে একখানা প্লেন উড়ে গেল,কোন শব্দ না দিয়ে। চারটে তালগাছ দাঁড়িয়ে, পুকুরের ওদিকে বেশ কটা নারকেল গাছ,এদের ফল্কুড়োতেও লোকে এখানে আনাগোনা করে। তাল নারকেল নারকেল পাতা যা পাওয়া যায় তাতেই ওদের লাভে লাভ।

পুকুরটা বেশ বড়,অন্তত আগে যে বড় ছিল, তা মনে হচ্ছে,কারণ চারপাশের ধারের বেশ খানিকটা  সংস্কারের অভাবে মজে যাওয়া। আর লোকজন যে যাতায়াত করে তা ঘাটের পাশের পথ দেখলে বোঝা যায়। পুকুরটা আয়তাকার,তার একদিকে জলজ শাপলা গাছে ভর্তি, আর একদিকেঢালুর ধার  ঘেঁসে কলমী শাকএর বিছানা। নধর কলমী ডগা বেরিয়ে একের সঙ্গে আর একটা জড়িয়ে আছে।  খানিকটা অংশে আবার তা নেই, মানে কেউ বা কারা শাক তুলে নিয়ে গেছে। সুজয় বলেছিলো, এদিকে কেউ আসে না, কেউ থাকে না, তা ঠিক নয়। শাক তুলতে তো আসেই,ওদিকে শাপলা তুলতেও আসে।তাহলে লোকজনের যাতায়াত তো আছেই।ঋজু তখনও একবার দেখলো, কে যেন  একজন লাল গামছা কাঁধে নারকেল গাছের পাশ দিয়ে কুল্ গাছের ঝোপের দিকে চলে গেলো। 

 সন্ধ্যেবেলায় চা খেতে খেতে দুজনেই মোবাইলে তোলা ছবি গুলো দেখছে।ঋজু একটা ছবি দেখিয়ে বলে এই দ্যাখ, সেই লাল গামছাটা। সুজয় বলে,ওটা তো ইঁটের ওপরে সিমেন্টের দাগ, ওখানটায় খানিক খানিক পলেস্তারা উঠে গেছে তাই ওরকম দেখছিস।ছবিটা বড় করে দ্যাখ, তাহলেই বুঝতে পারবি। ঋজু ভালো করে তাকিয়ে দেখে ওমা তাইতো। আবার মনে ভাবনাটা এলো, তাহলে ওখানে কি ভুল দেখলো?যাই হোক এখন আর কিছু বললো না। 

 ঋজু আর সুজয় কলেজের বন্ধু। খুবই ভাব দুজনের।এবার ঋজু চলে যাবে ব্যাঙ্গালোরে আর সুজয় দিল্লীতে দুজনের উচ্চতর পড়াশোনার জন্যেও।তাই সুজয় এর ডাকেই ঋজুর এখানে বেড়াতে আসা। ঋজু আবার পুরনো প্রাসাদ  বাড়ি কেল্লা দেখতে তাদের কথা জানতে বেশ পছন্দ করে। আবার সাহসীও। ভয় ডর কম ।ঋজু এখানে কয়েকদিন থেকে ফিরে যাবে ওর বাড়িতে কলকাতায় মানে,  কলকাতার কাছে দমদমে। 

  এখন ওরা দুজনে বাড়ির সামনের উঠোনে পায়চারি  করছে,আর পুরনো দিনের গল্প করছে।কি যেন একটা খস্ খস করে চলে গেল পায়ের কাছ দিয়ে, ঋজু তিড়িং করে লাফ দিয়ে ওঠে।সুজয় বলে ও কিছু নয় একটা দাঁড়াস সাপ।  সুজয় গ্রামের ছেলে, জানে সাপ খোপের খবর। বলে ভয় নেই, ওর বিষ নেই,কিছু করে না।  আবার দুজনে গল্প করতে শুরু করে। এবার ঋজু বলে,কাল সকালে না আমি একবার ওই পুরোনো জমিদার বাড়িটায় যাব। সুজয় বলে আবার যাবি ক্যানো? না, ওই লাল গামছা কাঁধে লোকটাকে খুঁজে বার করবো। সুজয় বুঝতে পারে, ঋজুর মাথায় ওই লাল গামছার রহস্য ঘুরপাক খাচ্ছে।

পরদিন সকালে দ্যাখে সুজয় ঘুমোচ্ছে।ঋজু ভাবলো, ও ঘুমোচ্ছে ঘুমোক, আমি একাই ঘুরে আসি। বলে ও বেরিয়ে পড়লো। ভাদ্রমাস শরতকাল। চারদিকের গাছপালা সবুজে সবুজ।কি একটা সোঁদা সোঁদা বুনো গন্ধ বাতাসে। পথের ধারে বাসক আসশ্যাওড়া গাছের জঙ্গল।বর্ষার জলে ধুয়ে সবাই সবুজ সতেজ।সব পেরিয়ে ও আবার ওই বাড়িটাতে এলো। এসে এবারে ও সামনের গেট দিয়ে না ঢুকে যেদিক দিয়ে লাল গামছা কাঁধে লোকটাকে  যেতে দেখেছিলো সেই দিকে এসে চারপাশে নজর করতে লাগলো কাউকে দেখা যায় কি না। খানিকক্ষণ ঘোরাঘুরি করে কাউকে দেখতে না পেয়ে যখন ফিরে আসছে, তকন ধপ করে কি যেন একটা আওয়াজ হলো,একটু এগিয়ে দেখে ঘাসের মধ্যে একটা নারকেল পড়ে। এদিকে কতগুলো নারকেল গাছ, কোন একটার থেকে পড়েছে নিশ্চয়।ও ওটাকে কুড়িয়ে নিয়ে  পুকুরের ধার দিয়েই চললো ওদিকে মানে উল্টোদিকে। ওখানে গিয়ে এদিক ওদিক দেখছে, ওখানেও ওই রকম ধপ করে শব্দ,ভালো করে তাকিয়ে দেখে ওর কাছেই, একখানা পাকা তাল পড়ে। ওখানটায় বেশ ঘাস বিছোনো পুরু করে বলে পাকা তাল হলেও কম ছেতরেছে । একখানা পাকা তাল আর একখানা নারকেল  দুহাতে নিয়ে ফিরে যেতে গিয়ে দ্যাখে সেই লাল গামছা কাঁধে লোকটা পুরনো বাড়িটার ভেতরে চলে গেলো। আজ স্পষ্ট লোকটাকে দেখতে পেলো। একটু এদিক ওদিক দেখলো, এদিকে দুহাতে দুটো জিনিস, আর বেলাও হয়েছে,তাই আর দেরি না করে বাড়ির দিকেই হাঁটা দিলো। পথে সুজয়ের ভাইয়ের সঙ্গে দেখা, ও  সাইকেলে স্টেশনের দিকে যাচ্ছিলো,ওকে দেখে,সঙ্গে তাল আর নারকেল দেখে সাইকেলেই বাড়িতে পৌঁছে দিয়ে ওর কাজে চলে গেলো।

 সন্ধ্যে বেলায় তালের বড়া সহযোগে মুড়ির সঙ্গে চাটা বেশ জমে উঠেছে। সুজয়ের মা আবার সবাইকে গোটাকতক করে তালের বড়া দিয়ে গেলো। ঋজূ বলে তাল আর নারকেল তো পেলাম, কিন্তু ওই লোকটার দেখা পেলাম না। সুজয় বলে, কোন লোকটারে? ওই যে লাল গামছা কাঁধে লোকোটা।ঋজু বললো,আজকেও লোকটাকে দু তিনবার দেখেছে, কিন্তু যতবার কাছে যাবার ভালো করে দেখবার চেষ্টা করেছি, ততবার যেন কোথায় অদৃশ্য হয়ে যায়, আর দেখতে পাই না। সুজয় বলে ওখানে আর তোর না যাওয়াই ভালো। কারা সব ঘুরে বেড়ায় ওখানে কে জানে। শুনেছি, কেউ কেউ নাকি ওরকম দেখতে গিয়ে মারাও গেছে।

 আজ খুব সকালে ঘুম থেকে উঠেছে ঋজু। সুজয়ের মাকে দেখতে বললো, আমি একটু বাইরে হেঁটে  আসি। বলে বাড়ি থেকে বেরিয়ে ওই বাড়ির দিকেই হাঁটতে লাগলো। হেঁটে বাড়ির পেছনে পুকুর পাড়ে  যেতে গিয়ে আবার ওই লাল গামছা ওলা লোকটাকে দেখতে পেলো। ঋজু দৌড়ে ওর দিকে যেতেই ও সুট করে বাড়িটার ভেতরে ঢুকে পড়লো। আজ ঋজু ওকে ছাড়বে না।দৌড়ে ঢুকে  পড়ে বাড়িতে।অন্ধকার স্যাঁতস্যাঁতে ঘর দালান, ঝাপসা অন্ধকার ভেদ করে তখনও দিনের আলো ততটা আসেনি।একটা ঘরের দরজার আড়ালে যেন ও দাঁড়িয়ে রয়েছে। ওকে দেখে দৌড়ে ধরতে যাবে, সর সর করে আওয়াজ শুনে চমকে দ্যাখে, একটা সাপ যেন ওর দিকেই আসছে। ও পড়িমরি করে দৌড়ে বেরতে গিয়ে পা স্লিপ করে এক ধাক্কা খেয়ে পড়ে যায় রকের নীচের কাঁটা বনের জঙ্গলে। তখনি ওর গলা দিয়ে একটা আর্তনাদ বেরোয়, আ---। এক মুহুর্তের জন্যে সংজ্ঞাও হারিয়েছিলো বোধ হয়। চোখ খুলে দ্যাখে, সুজয় ডাকছে, ঋজু, ঋজু। 

দুপুরে আজ জোর ঘুমিয়েছে ঋজু। আগামী কাল চলে যাবে,তাই আজ সন্ধ্যে বেলার চায়ের আসরে সুজয়ের বাবা ও  হাজির। ওর মাও চায়ের কাপ নিয়ে এসে ওদের সংগে যোগ দিয়েছে। সুজয়ের বাবা জিজ্ঞেস করলেন,এখন ব্যাথা নেইতো ত্যামন। ঋজু বললো, কিচ্ছু চিন্তা করবেন না,আমি সেসময়ে একটু ভয় পেয়ে গিয়েছিলাম, তাও সুজয় সাথে সাথে আমাকে ধরে ফেলেছিলো, আমার সঙ্গে বরাবর ছিলো, এখন আমি একদম ফিট। ভালো থাকো বাবা, এখান থেকে অসুস্থ হয়ে ফিরে গেলে আমাদের ও দুশ্চিন্তা থাকবে যে, এই সব কথা বার্তা হচ্ছে, এমন সময়ে সেই লাল গামছা কাঁধে কে যেন ঢুকলো ওদের ঘরে, কেউ কিছু বলার আগেই ঋজু তিড়িং করে একলাফ দিয়ে ওকে ধরে আর কি। সুজয় বলে, কি নারান দা তুমি এখানে?  নারান বলে,আমার টাকাটা? ঋজু সুজয়কে বলে, তুই চিনিস একে? সুজয় বলে, হ্যাঁ, মানে আমিই ওকে বলেছিলাম, একটা সাসপেন্স তৈরি করতে, ও নিজেই এটা করেছে। তুই এখানে এসেছিস্‌ তো তাই একটু মজা করছিলাম আর কি। ঋজু একটা ঘুঁসি বাগিয়েওর দিকে তেড়ে গিয়ে বলে, তোকে এক ঘুঁসিতে না- বলে, হা হা করে হেসে উঠে ওকে জড়িয়ে ধরে। 

              

 


 

গল্প 

রবিবারের গল্প
       লীনা রায়

ঘুম থেকে উঠেই পুবদিকের জানালা খোলে শান্তা। অমনি হুড়মুড়িয়ে সোনালি রোদ ঘর ভাসিয়ে দেয়। মন কেমন করে ওঠে শান্তার। শরৎ এলেই আশ্চর্য এক ভোজবাজিতে সব বদলে যায়। শান্তা আকাশের দিকে তাকায়। ভেলভেট নীল আকাশে সাদা পেঁজা তুলো মেঘ। মা আসছেন। আর তাই আকাশে, বাতাসে সাজো সাজো রব।

আজ রবিবার। আর রবিবার মানেই শান্তার কাছে বিশেষ দিন। সময়ের সঙ্গে সঙ্গে ভাল লাগার কারণ বদলে গেছে। কিন্তু রবিবারের আকর্ষণ এতটুকু কমেনি। ছেলেবেলায় রবিবার মানেই স্কুল ছুটি। আর উপরি পাওনা সকাল, বিকেল দু'বেলা খেলার সুযোগ। একটু বড় হবার পর খেলাধুলোর চেয়ে নাচ তাকে বেশি টানতো। আর রবিবারের বিকেল মানেই নাচের স্কুল। তাল, লয়, মুদ্রা – সব মিলিয়ে রবিবার হয়ে উঠল ভালবাসা উদযাপনের দিন।

উচ্চ মাধ্যমিক পরীক্ষার জন্য বেশ কয়েকটি রবিবার নাচের স্কুলে যাওয়া হয়নি শান্তার। পরীক্ষা শেষ হবার পর রবিবার এলো। শান্তা তৈরিও হলো। কিন্তু নাচের স্কুলে আর যাওয়া হলো না। সেদিন বিকেলেই পাত্রপক্ষ ওকে দেখতে এসেছিল যে।

এর কিছুদিন বাদে শান্তার বিয়ে হয়ে যায়। বিয়ের পর সংসার, সন্তান সামলে পড়াশুনো করেছে। তারপর স্কুলে পড়ানোর চাকরি। তখন রবিবার ছিল তার কাছে হাঁফ ধরা রুটিন থেকে মুক্তির দিন। তবে 
ছেলের বিয়ের পরের রবিবারগুলোতে হুল্লোড় অনেক বেশি। চারজনে মিলে এদিক ওদিক ঘুরতে যাওয়া। রাতে বাইরে খাওয়া। আর মিমোর জন্মের পর রবিবার আরো অনেক অনেক বেশি আকর্ষণীয় হয়ে উঠল। সেই একটা দিন নাতিকে সারাদিন কাছে পাওয়া যেত। পুচকেটার দস্যিপনা তাড়িয়ে তাড়িয়ে উপভোগ করার দিন ছিল রবিবার।

সেদিন সকালে পুরানো কথা ভাবছিল শান্তা। পুজোর আগে রবিবার মানেই বাজার করতে বেরিয়ে পড়া। কিন্তু এবার সব অন্যরকম। শহরের নামকরা স্কুলে এডমিশনের জন্য মিমো তৈরি হচ্ছে। তিন বছরের একটি বাচ্চার দম ফেলার ফুরসৎ নেই। চাকুরে বৌমা সারা সপ্তাহ ছেলের দিকে নজর দিতে পারে না তেমন। তাই রবিবার সকাল থেকে রাত অব্দি পড়িয়ে সেই ঘাটতি মেটায়।
শান্তার স্বামী, ছেলে দুজনে বার বার বৌমাকে বুঝিয়েছে। কিন্তু বৌমার একটিই কথা। বিশেষ একটি ইংরেজি মিডিয়াম স্কুলে ছেলেকে ভর্তি না করতে পারলে ও লজ্জায় মুখ দেখাতে পারবে না। এই নিয়ে অনেক তর্ক হয়েছে। শেষ পর্যন্ত দুজনে ক্ষান্ত দিয়েছে। শান্তা কোনদিন কিছু বলে না। কিন্তু মিমোর জন্য বুকটা মুচড়ে ওঠে। বাড়িটাকে আজকাল বড্ড অচেনা লাগে শান্তার।

আজও বৌমা মিমোকে দরজা বন্ধ করে পড়াচ্ছে। আজ মনে হচ্ছে মিমোর পড়াশুনোয় একটুও মন নেই। বৌমার সশব্দ শাসন, তর্জন গর্জনে বাড়িতে টেকা মুশকিল। মাঝে মাঝে মনে হয় বৌমার ওপর কোন অপদেবতা ভর করেছে। কান চেপে বসে থাকে শান্তা। কিন্তু হঠাৎ মিমোর আর্ত চিৎকারে ও আর নিজেকে ধরে রাখতে পারে না।
 সিঁড়ি ভেঙে ওপরে আসে। দরজা খুলে ঘরে ঢোকে। বৌমার হাত থেকে স্কেল টেনে মাটিতে ফেলে দেয়। মিমোকে কোলে নিয়ে ঘর থেকে বেরিয়ে আসে। যাবার সময় ঘরের দরজাটা সশব্দে বন্ধ করে দেয়।