গল্প 
রবিবারের গল্প
       লীনা রায়
ঘুম থেকে উঠেই পুবদিকের জানালা খোলে শান্তা। অমনি হুড়মুড়িয়ে সোনালি রোদ ঘর ভাসিয়ে দেয়। মন কেমন করে ওঠে শান্তার। শরৎ এলেই আশ্চর্য এক ভোজবাজিতে সব বদলে যায়। শান্তা আকাশের দিকে তাকায়। ভেলভেট নীল আকাশে সাদা পেঁজা তুলো মেঘ। মা আসছেন। আর তাই আকাশে, বাতাসে সাজো সাজো রব।
আজ রবিবার। আর রবিবার মানেই শান্তার কাছে বিশেষ দিন। সময়ের সঙ্গে সঙ্গে ভাল লাগার কারণ বদলে গেছে। কিন্তু রবিবারের আকর্ষণ এতটুকু কমেনি। ছেলেবেলায় রবিবার মানেই স্কুল ছুটি। আর উপরি পাওনা সকাল, বিকেল দু'বেলা খেলার সুযোগ। একটু বড় হবার পর খেলাধুলোর চেয়ে নাচ তাকে বেশি টানতো। আর রবিবারের বিকেল মানেই নাচের স্কুল। তাল, লয়, মুদ্রা – সব মিলিয়ে রবিবার হয়ে উঠল ভালবাসা উদযাপনের দিন।
উচ্চ মাধ্যমিক পরীক্ষার জন্য বেশ কয়েকটি রবিবার নাচের স্কুলে যাওয়া হয়নি শান্তার। পরীক্ষা শেষ হবার পর রবিবার এলো। শান্তা তৈরিও হলো। কিন্তু নাচের স্কুলে আর যাওয়া হলো না। সেদিন বিকেলেই পাত্রপক্ষ ওকে দেখতে এসেছিল যে।
এর কিছুদিন বাদে শান্তার বিয়ে হয়ে যায়। বিয়ের পর সংসার, সন্তান সামলে পড়াশুনো করেছে। তারপর স্কুলে পড়ানোর চাকরি। তখন রবিবার ছিল তার কাছে হাঁফ ধরা রুটিন থেকে মুক্তির দিন। তবে 
ছেলের বিয়ের পরের রবিবারগুলোতে হুল্লোড় অনেক বেশি। চারজনে মিলে এদিক ওদিক ঘুরতে যাওয়া। রাতে বাইরে খাওয়া। আর মিমোর জন্মের পর রবিবার আরো অনেক অনেক বেশি আকর্ষণীয় হয়ে উঠল। সেই একটা দিন নাতিকে সারাদিন কাছে পাওয়া যেত। পুচকেটার দস্যিপনা তাড়িয়ে তাড়িয়ে উপভোগ করার দিন ছিল রবিবার।
সেদিন সকালে পুরানো কথা ভাবছিল শান্তা। পুজোর আগে রবিবার মানেই বাজার করতে বেরিয়ে পড়া। কিন্তু এবার সব অন্যরকম। শহরের নামকরা স্কুলে এডমিশনের জন্য মিমো তৈরি হচ্ছে। তিন বছরের একটি বাচ্চার দম ফেলার ফুরসৎ নেই। চাকুরে বৌমা সারা সপ্তাহ ছেলের দিকে নজর দিতে পারে না তেমন। তাই রবিবার সকাল থেকে রাত অব্দি পড়িয়ে সেই ঘাটতি মেটায়।
শান্তার স্বামী, ছেলে দুজনে বার বার বৌমাকে বুঝিয়েছে। কিন্তু বৌমার একটিই কথা। বিশেষ একটি ইংরেজি মিডিয়াম স্কুলে ছেলেকে ভর্তি না করতে পারলে ও লজ্জায় মুখ দেখাতে পারবে না। এই নিয়ে অনেক তর্ক হয়েছে। শেষ পর্যন্ত দুজনে ক্ষান্ত দিয়েছে। শান্তা কোনদিন কিছু বলে না। কিন্তু মিমোর জন্য বুকটা মুচড়ে ওঠে। বাড়িটাকে আজকাল বড্ড অচেনা লাগে শান্তার।
আজও বৌমা মিমোকে দরজা বন্ধ করে পড়াচ্ছে। আজ মনে হচ্ছে মিমোর পড়াশুনোয় একটুও মন নেই। বৌমার সশব্দ শাসন, তর্জন গর্জনে বাড়িতে টেকা মুশকিল। মাঝে মাঝে মনে হয় বৌমার ওপর কোন অপদেবতা ভর করেছে। কান চেপে বসে থাকে শান্তা। কিন্তু হঠাৎ মিমোর আর্ত চিৎকারে ও আর নিজেকে ধরে রাখতে পারে না।
 সিঁড়ি ভেঙে ওপরে আসে। দরজা খুলে ঘরে ঢোকে। বৌমার হাত থেকে স্কেল টেনে মাটিতে ফেলে দেয়। মিমোকে কোলে নিয়ে ঘর থেকে বেরিয়ে আসে। যাবার সময় ঘরের দরজাটা সশব্দে বন্ধ করে দেয়।

No comments:
Post a Comment