গল্প 
স্পর্শ
অর্ণব ঘোষ
রাত ২ টা ১৫। প্ল্যাটফর্মে অপেক্ষায় রুদ্র আর ইন্দ্রাণী। মিনিট পাঁচেক বাদেই ঢুকবে আগরতলা-ব্যাঙ্গালোর হামসফর এক্সপ্রেস। এইবার শেষ চেষ্টা। ট্রেনে চেপে বসল ওরা। ধীরে ধীরে প্ল্যাটফর্ম পেরিয়ে ছুটতে লাগল ট্রেন। একে নিঝুম রাত, তায় অমাবস্যা। গহীন কালোয় আচ্ছন্ন চারিদিক। অন্ধকার আবর্তে যেন নিমজ্জিত দুজন। দুজনেই নির্বাক, অপলক দৃষ্টি জানালার বাইরে। কটুক্তি আর গঞ্জনায় বিদ্ধ ইন্দ্রানীর বুক পাথরের চাই এর মতো কঠিন! কোথায় শেষ এই আঁধারের?
আজ আট বছর অতিক্রান্ত, এখনো কোনো ছেলেপুলে এলোনা ইন্দুর কোল জুড়ে। অথচ কিসের অভাব ছিল ওদের? দুজনেই সরকারী বড়ো চাকুরে, যেমন শিক্ষাদীক্ষা তেমনি চোখ ধাঁধানো রূপ। বংশেও উঁচু, আচরণে মার্জিত।
ঈশ্বর বোধহয় সবাইকে সবটা দেয়না। ওই একটা ব্যপারেই প্রতিপদে উপহাস, অপমান সইতে হয় ওদের, বিশেষ করে ইন্দুকে। সেদিনও তো অফিস কলিগরা বলাবলি করছিল,
- শোন্ শ্রীনিকা, রূপ ধুয়ে কি জল খাবে? মেয়েদের আসল সৌন্দর্য মাতৃত্বে, বুঝলি! ইন্দুকে দেখে রাশ টানল কথায়।
পাশের বাড়ির মিনাদিও মাঝেমধ্যে বরকে শুনিয়ে বলে
- সব মাটিতেই সোনার ফসল ফলেনাগো... রিজুর বাবা।
ইন্দু কি আর এসব বোঝেনা! অথচ দোষটাই বা কী ওদের?
কত ডাক্তারের কাছে কতদিন হত্যে দিয়ে পড়েছিল, পরীক্ষার নামে শরীরটাকে কাটাছেঁড়া করিয়েছে কতো, কতরাত ভিজেয়েছে বালিশের গা, কতদিন গুনেছে প্রতীক্ষার প্রহর!
শেষমেষ যাওবা এল সেও মৃত। সেদিন যেন মাথায় আকাশ ভেঙে পড়েছিল ইন্দুর। পেটের ভার অনায়াসে ন'মাস বইতে পারলেও মনের ভার যেন ছিল রূঢ় পর্বতসম। রুদ্র অসহায়! স্ত্রীকে স্বান্তনা দেবার মতো ভাষা তার অভিধানে ছিলনা। কতবারতো বুঝিয়েছে স্ত্রীকে।_ নিজেকে এভাবে অপরাধী ক'রোনা, ভরসা রাখো ভগবানের ওপর। আজ সেই ঈশ্বরকেই প্রশ্নবাণ ছুঁড়ে দিতে হচ্ছে রুদ্রর। 
দিন দশেক পর..
ভোররাত। পিনড্রপ সাইলেন্স স্টেশনে। পরাজিত সৈনিকের মতো বুকভরা গ্লানি আর মুখভরা যন্ত্রনার ছাপ নিয়ে ফিরল রুদ্র আর ইন্দু। ইন্দুকে আবারও দিতে হবে অগ্নিপরীক্ষা!- নিজের কাছে, পরিবারের কাছে, সমাজের কাছে। এ অপবাদ বয়ে বেড়াতে হবে আজীবন, এ যাত্রার শেষ নেই, এ ক্ষতে দেবার মতো নেই কোনো প্রলেপ!
- মিঃ  রুদ্র। IVF ইস গোয়িং টু বি আনসাক্সেসফুল। আই এম সরি!
কথাটা আবারও  মনে করতেই ভিজে গেছে রুদ্রর চোখের কোণ। ইন্দু আলুথালু, শাড়ীর আঁচল লুটিয়ে পড়েছে পথে, নিজেকে হারিয়ে ফেলেছে ও, দিয়েছে মনের সলিল সমাধি!
চোখের কোণটা মুছল রুদ্র। সামনে আস্তাকুঁড়ে কী ওটা? দৌড়ে গেল। পচাগলা বর্জ্যের স্তুপ থেকে উঁকি দিচ্ছে এক ফুটফুটে মুখ, নিস্পাপ, করুন, সুকোমল। এদিক ওদিক দেখল রুদ্র, নাঃ কেউ নেই, পরম স্নেহে তুলে নিয়ে কোলে দিল ইন্দুর। প্রথমবারের বরষার স্পর্শ যেন ভিজিয়ে দিল রোদেফাটা মাটির কোল! মায়ের কোল!
- ঈশ্বরকে কৃতজ্ঞতা জানাও ইন্দু,.. ও.. ও আমাদের রুদ্রাণী!
আকাশে তখন ছড়িয়ে পড়েছে মৃদু ভোরের আলো।

No comments:
Post a Comment