রম্য রচনা
মুঠোফোনের দিনলিপি 
পার্থ বন্দ্যোপাধ্যায়
একটু মোবাইলটাকে বিশ্রাম দাও সব ফুলগাছ গুলোর গোড়া শুকিয়ে কাঠ হয়ে গেল।
আমি হুুঁ বলেও মোবাইল থেকে চোখ সরাতে পারলাম না। বিশ্রাম বললেই কি বিশ্রাম দেওয়া সম্ভব? ঘুমাতে যাওয়ার আগে রাতে মোবাইল  বন্ধ করে রাখার খেসারত দিতে হবে যে। আটটা মিসড কল একচল্লিশটা মেসেজ। ওয়াটস এপের মধ্যে সব চেয়ে গুরুত্বপূর্ণ খবরটাই চাকরিহারা  শিক্ষকদের নিয়ে। 
একটা সময় ছিল যখন বলা হত, " পেন এন্ড পেপার মেকস এ ম্যান রাইটার।" আজকের দিনে গোটা বিষয়টা ১৮০ ডিগ্রি ঘুরে গিয়েছে। মোবাইল ফোনে লেখা হচ্ছে কবিতা,  গল্প উপন্যাস। ব্যাংকের লেন দেন,গান গাওয়া, আবৃত্তি করা, যুদ্ধ সহ দেশ বিদেশের খবর, আপন জনের খোঁজ নেওয়া,  শত্রুদের ট্র্যাকিং করা এমন কি ব্লাড সুগার, ব্লাড প্রেসার মাপার কাজটাও সুনিপুণ ভাবে করে চলেছে মোবাইল ফোন। অন্যান্য আর পাঁচটা ব্যবসার মতো, কোটি টাকা ব্যায়ে বানানো  প্যাথোলোজিক্যাল ল্যাবরেটারিও আজ পথে বসতে চলেছে। 
এদিকে ফুলগাছগুলোয় জল দেবার খুবই দরকার। কিন্তু কোনো ভাবেই বলতে পারলাম না তখনই মোবাইলে খবর পেলাম  যে, আমাদের অত্যন্ত প্রিয় টোটো চালক দুর্ঘটনায় পড়ে হাসপাতালে ভর্তি। পড়ি কি মরি করে কিছু কিছু ফুল গাছে ধুপধাপ করে কয়েক বালতি জল ঢেলে বাজার করবার বাহানা দিয়ে  বেরিয়ে পড়লাম।
একটা কাজকে উদ্দেশ্য করে বের হলে মোবাইল ফোন সেই কাজকে যে কোনো অবস্থায় পন্ড করে দিতে পারে। এস এম এসে জানতে পারলাম ছেলের ওয়েট লিষ্টেড রেলের টিকিটটা কনফার্ম হয় নি। ফোন লাগালাম আই আর সি টি সি'র এজেন্টকে তৎকাল টিকিটের জন্য। 
কাজ সেরে বাড়ি ফিরেই আবারও প্রশ্নের মুখোমুখি হলাম, " আজ তো শনিবার,  নিরামিষ।  বাজার তো দরকার ছিল না "। কিন্তু মুখ ফুটে বলতে পারলাম না যে,  নানা রকম তালেগোলে মুল বাজার টাই আনা হয় নি। 
গিন্নীর গাছের নেশা। সন্ধ্যায় টেলিভিশনের ধারাবাহিকগুলো দেখে। তাই কখনো কখনো ফুলকি দাসের সাধু বাবার কি খবর বা আর্য্য কি একাই লন্ডন যাবে জিজ্ঞেস করলেই ব্যাস সব সমস্যার সমাধান। সব রাগ গলে একেবারে জল।
হাজার কাজের বন্ধু এই হাতিয়ারটি কখনো কখনো গোপন প্রেমিকার মতো আড়াল করে চলতে হয়। তবে সারা দিনের শেষে আমরা যখন ঘুমের দরজায় তখন দুজনের কাছেই  মোবাইল খুব শক্তিশালি বন্ধু। গিন্নী লাউড স্পিকার অন করে ধর্ম কথা শুনছে, আমি কানে হেডফোন লাগিয়ে শুনছি রবীন্দ্র সংগীত, গুনছি ফেসবুকের লাইক।
স্কুল যাওয়ার পথে বাইকে মোবাইল ফোন ধরলেই বিপদ। গিন্নীর সতর্কবার্তা সত্যেও ফোন ধরতে হল। সেদিনও  মোবাইলে খুব খারাপ খবর পেলাম। বকুনি খাওয়ার ভয়ে  অযোগ্য এবং যোগ্য প্রসঙ্গ টেনে আনায়, কথার মার প্যাঁচে কিছুটা নিজেকে  বাঁচানো গেল।
কিন্তু গিন্নী ঠাকুর দেবতার ভিডিও, সুসাস্থ্যের জন্য কি কি করনীয়, পে টি এম, ফোন পে গুগল পে বা টাকা ঢোকার এস এম এস গুলো খুব উৎসাহ সহকারে খোঁজ নেয়। রাত্রে মোবাইল ব্যবহারে কোনো নিষেধাজ্ঞা না থাকায় কখনো কখনো সে শাড়ির বিজ্ঞাপন, রান্নার রেসিপি আমাকে দেখায়। একসময় দুই জন ক্লান্ত হয়ে আসি। ঘুম  জড়ানো চোখে বলে ওঠে, এবার থাক, এসবের কোনো শেষ নেই। 
তাই বিভিন্ন সময়ে  মোবাইলের আওয়াজ বাড়িয়ে বা কমিয়ে, মোবাইল ফোন কে সঙ্গী করে ভালোই আছি।

No comments:
Post a Comment