গল্প 
পরিযায়ী 
 অভিজিৎ সেন
সঙ্গে আছে দুটো টিশার্ট, দুটো জিন্সের প্যান্ট, একটি গামোছা, একটি পাম বালিস,একটি বিছানায় পাতা চাদর, পাঁচ হাজার টাকা, মোবাইল(তবে টাচ্ মোবাইল নয়,মাত্র হাজার টাকা দামের)এবং মায়ের হাতের তৈরী রুটি-তরকারি নিয়ে বছর পনেরোর রূপ রবিদাস চলেছে ভারতবর্ষের রাজধানী দিল্লিতে। ক্লাস এইট পর্যন্ত পড়েছে। পড়ার ইচ্ছা ছিল কিন্তু আর এগোনো সম্ভব হলো না, তবে মেধার জন্য নয়, অর্থের জন্য। পরিবারে মোট আট জন সদস্য। মা,বাবা ছাড়া তিন ভাই ও তিন বোন । বাবা দিনমজুর। একটি ভাই দুই বছরের আর একজন তিন বছরের বড়ো রূপের থেকে । প্রাথমিক স্কুলের পর পড়া ছেড়ে দিয়েছে ওরা । বাবার সঙ্গে কাজে যেতো । বাবা এতই অসুস্থ কাজে যেতে পারে না। দাদাদেরও নিয়মিত কোন কাজ নেই। তিন বোনই রূপের থেকে বয়েসে ছোট। করোনা মহামারীর পর থেকে তাদের আর্থিক দুরবস্থা চরম আকার ধারণ করেছে। অর্থাভাব দূর করতে লেখাপড়ায় ইতি টেনে রূপ চলেছে নিজের গ্ৰাম, নিজের জন্মস্থান ছেড়ে একেবারে ভিন্ন পরিবেশে। রূপকে কাজের উদ্দেশ্যে যেতে হচ্ছে হিন্দি ভাষা অধ্যুষিত, আত্মীয় বন্ধু বর্জিত দিল্লির মতো মহানগরে । সেখানে একটি প্লাস্টিকের সামগ্ৰি প্রস্তুত কারক কোম্পানিতে চাকরী নিয়েছে মাসিক বারো হাজার টাকার বেতনে,থাকার ব্যবস্থা কোম্পানির। খাওয়া খরচ নিজেকে বহন করতে হবে। গ্ৰাম সম্পর্কের কাকু অবনী মন্ডল তাকে সঙ্গে নিয়ে চলেছে। অবনী বিগত পাঁচ বছর ধরে এখানেই কাজ করে আসছে। প্রতি বছর কোনো না কোন ছেলে অভাবের কারণে তার সঙ্গে কাজের জন্য যায় ।শর্ত শুধু এক বছর তার সঙ্গে কাজ করতে হবে সেখানে । তাদের কাছে লিখিত নিয়ে নেয় অবনী। তাদের প্রমাণ পত্র জমা রাখ এক বছর নিজের কাছে। অবনীর লাভ আছে তাতে সে। মালিকের কাছে কমিশন পেয়ে থাকে । মালিক সস্তা শ্রমিক পেয়ে যায় এবং বছর ধরে পরিশ্রম করিয়ে নেয়, মুনাফা তুলে নেয় কয়েক গুণ । প্রাণচঞ্চল রূপ বাধ্য হয়ে এই শর্ত মেনেই কাজ করতে চলেছে দিল্লিতে।
                রূপের বাড়ি পশ্চিমবঙ্গের এক অজ্ঞাত গ্ৰাম কোচবিহার জেলার মোহনপুরে। তার বাড়ির পাশ দিয়ে বয়ে চলেছে ধরলা নদী।নদীর দুই তীরে তার বাল্য ও কৈশোরের ছড়িয়ে আছে অজস্র স্মৃতি। দুপুর জুড়ে বন্ধুদের সঙ্গে নদীর বুকে সাঁতার কেটে সময় কাটানো, ঘাটে বাঁধা সোলেমান চাচার ছোট খেয়াটি নিয়ে মাঝে মাঝেই উধাও হয়ে যাওয়া। চাচা জানতো এটা কে করেছে? সে পাড়ে বসে অপেক্ষা করতো । মিনিট দশেক পরে রূপ খেয়া নিয়ে এলে এক গাল হেসে চাচা বলতেন,''কেমন মজা পাইলা আব্বাজান ?" রূপ বলতো ''সেই মজা চাচা । তোমার কাজে একটু দেরি করে দিলাম"। চাচা আবার হেসে বলে,''আমার বেটা রহিম আর তুমি কি আলাদা? আমার কাজের কোন ক্ষতি হয় নাই বাপ'' ! এই বলে মাছ ধরতে নদীর বুকে ভেসে চলে যেত। নদীর তীরে বাড়ি, সেই কারণে বর্ষার সময় তাদের গ্ৰাম,জলে ডুবে যেত প্রতি বছর । এটা এখানের খুব স্বাভাবিক ঘটনা। বছর বছর দুর্গা পূজার মতোই যেন ব্যাপারটি ! জল নেমে গেলে বন্ধুরা মিলে মাছ ধরায় নেমে পড়তো। রূপের উৎসাহ সবচেয়ে বেশি ।
             বর্ষা চলে যাওয়ার পর শরতকাল নরম সাদা কাশের দোলায় নদীর তীর আলো করে রাখতো । গভীর নীল আকাশ স্বচ্ছ আয়নায় মতো নদীর স্থির জলে অব্যক্ত প্রতিবিম্ব সৃষ্টি করতো,রূপ সেই দৃশ্যের গভীর থেকে গভীরে হারিয়ে যেত ।এক সিগ্ধ মায়াঞ্জনে আচ্ছন্ন হয়ে যেত তার মন । এক সুরেলা আবেগের শিহরণ নদীর বুক থেকে উঠে এসে তার শিরা ধমনীর প্রবাহের সঙ্গে মিশে যেত। শরৎ ভোরের শিউলি ফুলের কোমল আবেশ, শিশির ভেজা ঘাসের রেশম-তুলতুলে আহ্বান,সবুজ কচি কচি চারা ধানের মৃদুল আলোড়ন,শাপলা শালুক ফুলের বহুমাত্রিক সৌন্দর্য,পদ্মবনের মোহিনী মুগ্ধতা সবকিছু মিলেমিশে তার কানে,অনুরণনের মতো যেন কী একটা বেজে চলতো ! দিনরাত শারদীয় ঢাকের চির পরিচিত তাল ও বোল যেন শুনতে পেতো । তার মনে হতো আকাশে বাতাসে কে যেন নূপুর পায়েবেঁধে অতি ধীর লয়ে হেঁটে চলেছে । নিত্যদিনের ব্যথা বেদনা হতাশা ব্যর্থতা দূরে সরিয়ে রেখে গভীর ভালোবাসার টানে মানুষ ঝাঁপিয়ে পড়ে সপরিবারে দুর্গা মায়ের শারদ উৎসবে । শুরু হয়ে যেত বাঙালির আনন্দের উৎসব, দুর্গোৎসব--- রূপ এ আনন্দটুকুর জন্য অপেক্ষা করে থাকে বছর ধরে।
          তাদের গ্ৰামেই খুব বড়ো করে পূজা হয় । সকলকেই দায়িত্ব ভাগ করে নিতে হতো। রূপ ও তার সমবয়সী বন্ধুরা চাঁদা সংগ্ৰহ, মূর্তি আনার কাজ করতো। পঞ্চমীর আগে থেকেই শুরু হয়ে যেত তাদের আয়োজন। মূর্তি পাশের গ্ৰামের মদন পালের ওখান থেকে আসছে শুরু থেকেই। তার পরিবার সুনামের সঙ্গে একাজ করে চলেছে বংশপরম্পরা ধরে । সাবেকি ধাঁচের প্রতিমা, একটি কাঠামোতেই সপরিবারে মা দুর্গ । গ্ৰামের মানুষের অভাব থাকলেও এ কটি দিন আনন্দের ঘোরেই কাটিয়ে দেন তারা মাতৃ আরাধনায় । সপ্তমী,অষ্টমী,নবমী ভালই কেটে যায় দশমীর দিনে মায়ের নিরঞ্জনের সাথে সাথে বিষণ্ণতা নেমে আসে গ্ৰামবাসীর মনে। রূপের মনেও । সেদিন সারা রাত ধরে অতি উচ্চ স্বরে ডি.জে বাজিয়ে বন্ধুরা পিকনিকে মত্ত হয়ে উঠলেও শূন্য মন্ডপের সামনে এলে রূপের মনের ভেতরটা শূন্য হয়ে যেতো।ঔদাসীন্যের ঘূর্ণিঝড় তাকে যেন ঘিরে ধরতো । তাদের পাশের গ্ৰাম শিকারপুরে বেশ বড়ো আকারে কালীপূজা হয়। নানা রঙ্গের বৈদ্যুতিক আলোর রোশনাই দিনের মতো করে তোলে রাতের পথ । শহরের মতো বিগ বাজেটের পুজো না হলেও আমোদ আনন্দের তিল মাত্র অভাব থাকে না। 
                ট্রেনের কামরায় বসে অতীত কথাগুলো স্মৃতির পাতা বেয়ে যতই উঠে আসছিল ততই এক অসহনীয় যন্ত্রণা তাকে ঘূণকীটের মতো করে দংশন করে চলেছিল। এ যেন উদ্বাস্তুদের স্বজন স্বদেশ হারানোর চাপা আর্তনাদ এবং হৃদয়ের রক্তক্ষরণের ধারাবাহিক কালকূট যাপন । কী এক ব্যথা তার বুকের উপর চেপে বসেছে ! অসহনীয় দারিদ্র্য ও অভাবের কাছে সম্পূর্ণ পরাভূত, এই প্রাণচঞ্চল কিশোরটি । শৈশবের, কৈশোরের অচ্ছেদ্য আবেগ ও আকাঙ্ক্ষার বিসর্জন দিয়ে বাস্তবের কঠিন কঠোর মাটিতে হাঁটতে বাধ্য হচ্ছে আজ। নদীর বাঁকের মতো জীবন, জীবন বাঁক নিলে জীবনের চিত্রপট বদলে যায়। জীবন,কবিতার ব্যঞ্জনাময় লালিত্য ছেড়ে গদ্যের ঋজু তীক্ষ্ম পাথুরে পথে হেঁটে যেতে শুরু করে। বাল্য কৈশোরের ভাবনাহীন কল্পোলোক ছেড়ে রূপকথার, কার্টুনের আর খেলাধুলার জীবন ও জগৎ ছেড়ে রূপ লক্ষ লক্ষ পরিযায়ী শ্রমিকের একজন আজ । দেশে,পরিযায়ী শ্রমিকের একটি সংখ্যা শুধু মাত্র বৃদ্ধি পেল !
             নিউ কোচবিহার রেল স্টেশন থেকে যাত্রা শুরু করেছে। ট্রেন একটু একটু করে গতি বাড়িয়ে চলেছে। তার চেনা পৃথিবীকে,সহজ আনন্দের জগতকে, আত্মীয়,বন্ধু,পরিবারের সকলকে পিছনে ফেলে  এগিয়ে চলেছে এক নতুন অচেনা মানুষের পৃথিবীতে। কিছুতেই মনকে শান্ত করতে পারছিলো না। আবার পিছিয়ে আসাও সম্ভব নয়। পরিবারের সদস্যদের রক্তশূন্য মুখ,অভুক্ত রাত, অনিশ্চিত ভবিষ্যৎ,বাবার অসুস্থতা, মায়ের নির্বাক চোখের আতঙ্ক, ছোট ছোট বোনেদের সারল্য মাখা মায়াবী  চোখের অবুঝ আবদার তাকে কোথা থেকে যেন  আসুরিক রকমের শক্তি যুগিয়ে চলেছে-- দূরে কাজে যেতে । বিভিন্ন স্টেশনে গাড়ি এসে দাঁড়াচ্ছে। কতো বিচিত্র মানুষ, কতো বিচিত্র পোশাক, ভাষা ও খাবার। জীবনে এতোকিছু সে একসাথে কোথাও দেখেনি। একবার কোচবিহারের মদনমোহন ঠাকুরের রাসের মেলায় এসেছিল। সেখানে দেখেছিল অনেক রকম মানুষকে । কিন্তু আজকের মতো এত বৈচিত্র্য আর কখনো দেখেনি । আজ জীবিকার প্রয়োজনে, অভাবের নির্মম চাবুকে রেসের মাঠের ঘোড়ার মতন ছুটে চলতে হচ্ছে যেন তাকে ।
       মাতৃভূমি বাংলা পার হয়ে গেছে। হিন্দি ভাষা অধ্যুষিত এলাকায় গাড়ি ছুটে চলেছে। হিন্দি ভাষা বোঝে, কাজ চালানোর মতো বলতেও পারে । ট্রেনের কামরায় বসে জানালার ফাঁক দিয়ে দুরন্ত বেগে পেছনে ছুটে যাওয়া গাছ, মানুষ,নদী,বাজার,হাট,খেলার মাঠ,শ্মশান যা যা চোখে পড়েছে যতোটা পারছে মনের খাতায় ছবির মতো এঁকে নিচ্ছে। হঠাৎ অবনী কাকু বললো," কি রে কিছু খাবি ? অনেকক্ষণ কিছু তোর খাওয়া হয় নি।" মুড়িমাখা,চা দুজনে খেলো। অবনীর ধূমপানের অভ্যাস। কিন্তু ট্রেনে খায় না, জরিমানার ভয়ে। তামাক পাতার গুঁড়া হাতের তালুতে মিহি করে দলে তার কালো ঠোঁট ফাঁক করে দাঁতের গোড়ায় ঠেলে দিলো । ভাবুক স্বভাবের রূপ বিস্ময়ভরা চোখে ট্রেনের জানালা দিয়ে বাইরের অজানা পৃথিবীর দিকে তাকিয়ে আছে। রাতে মায়ের দেওয়া খাবার খেলো । গভীর রাতের শীতল স্নিগ্ধতা এতোটা রমনীয় ও কমনীয় হয় রূপের আগে এতটা অনুভব হয়নি, আজ যতটা হচ্ছে। হয়তো বাড়ি থেকে দূরে আছে বলে । বাড়ির আশেপাশের রাত্রিকালীন নীরবতাও মনে পড়ছে খুব গভীরভাবে । রাতের আঁধার ও নীরবতার বুক চিরে দুরন্ত গতিতে গাড়িটি প্রচন্ড শব্দ করে এগিয়ে চলেছে । পেছনে ছুটে চলে যাচ্ছে প্রতিটি মুহূর্ত। বিচ্ছেদ যে জীবনের অবিচ্ছেদ্য অঙ্গ,আজ বেশ বুঝতে পারছে রূপ । জীবনের কোন সম্পর্কই স্থায়ী নয়,অটুট নয় যেন এই কয়েক ঘন্টার মধ্যেই সে বুঝতে পেরেছে ।
          যখনই কোন স্টেশনে এসে দাঁড়াচ্ছে তখন কেউ জলের বোতল নিয়ে, কেউ কাগজের মতো পাতলা রুটি ও ঝাল ঝাল আলুর তরকারি নিয়ে, কেউ বিরিয়ানির প্যাকেট নিয়ে,দই, মিস্টি নিয়ে ছুটে আসছে । গাড়ির কামরায় ঘুরে বিক্রি করছে । দুই বা তিন মিনিটের বিরতির ফাঁকে যাত্রীদের মধ্যে কেউ কেউ প্ল্যাটফর্মে নেমে প্রয়োজনীয় সামগ্রী সংগ্রহ করে নিচ্ছে । ট্রেনের কামরায় হকাররা সূচ থেকে শুরু করে চাদর,গামছা,পিলো, বাচ্চাদের খেলনা বেশি দামে বিক্রি করছে। কেউ কিনছে, কেউ দেখে ফিরিয়ে দিচ্ছে । স্টেশনে ছোট ছোট ছেলে মেয়েরা ভিক্ষে করছে । অর্থ ও খাদ্য চেয়ে যাত্রিদের পা জড়িয়ে ধরছে । কেউ আবার রেলের কামরার নোংরা মেঝে ঝাড় দিয়ে যাত্রীদের কাছ থেকে টাকা সংগ্রহ করছে। একদল কিন্নর তাদের কামরায় এলো । দুই হাতে তালি দিয়ে যাত্রীদের কাছ থেকে অর্থ সংগ্রহ করতে শুরু করল । রূপ এদের কথা শুনেছিল আগে দেখেনি আজ দেখলো কাছ থেকে । যারা দিচ্ছে মাথায় হাত দিয়ে আশিস্ দিচ্ছে না দিলে কেউ অশ্লীলভাবে অঙ্গভঙ্গি করছে বা গালাগাল দিচ্ছে। রূপ যতো এগিয়ে চলেছে জীবনের রহস্য বর্ণময় হয়ে ধরা পড়ছে তার জিজ্ঞাসু কিশোর চোখে । অন্ধ ভিক্ষুক বাঁশি বাজিয়ে গান করছিল। রূপ তার হাতে দশ টাকা দিলো । গান শুনে রূপের উদাস মনও গুন্ গুনিয়ে উঠলো-- "কোথায় ছিলাম কোথায় এলাম পাখির নেই স্থায়ী ঠিকানা/পাখি কাঁদে, আর কাঁদে পাখির আপনজনা ।" তিন দিন পরে তারা দিল্লি এসে পৌঁছায়। তাদের জায়গা কারখানার ভেতরে বস্তি এলাকার মতো ছোট ছোট ঘরে ।এক ঘরে দুজন করে থাকার ব্যবস্থা। দুটি চৌকি পাতার পরে মাঝে দুই হাত জায়গা অবশিষ্ট থাকে, সে সংকীর্ণ পথে দুজনকেই যাতায়াত করতে হয়। মোট ষাটজন শ্রমিক সেখানে থাকে । স্নানাগার ও শৌচাগার বেশ কয়েকটি আছে তবে সকলের জন্য । শ্রমিকদের মধ্যে দিল্লির কেউই নেই, বেশির ভাগই বাংলা, বিহার এবং ওড়িশা থেকে এসেছে। প্রত্যেকের সমস্যা এক একটি ট্র্যাজেডি।পরেরদিন সকাল আটটায় সাইরেন বাজে । সাইরিন বাজার দশ মিনিটের মধ্যে কাজে যেতে হবে । আগের দিন অবনী কাকু কারখানার নিয়ম বুঝিয়ে দিয়েছিল। রূপ সকাল পাঁচটায় প্রতিদিন ওঠে,প্রাতকৃত্য করে, সামান্য কসরতের পর ছোলা গুড় খায় । আজ তাই করে কাজের উদ্যোশে বেরোলো। বিকাল পাঁচটা পর্যন্ত কাজ। মাঝে বেলা ১টা থেকে ১টা৩০ পর্যন্ত বিরতি। ভেতরে ক্যান্টিন আছে। দিনে ও রাতে খোলা থাকে। রূপের রান্নার সমস্যা থাকলো না । এখানেই খাওয়া দাওয়ার ব্যাবস্থা হয়ে গেল। খাওয়া খরচ অস্বাভাবিক নয়, এটাই রক্ষ্যা । দেখতে দেখতে এক মাস কেটে গেল। রূপ পরিবেশের সঙ্গে মানিয়ে নিয়েছে। রূপের মতই পরিস্কার ও সরল মনের উজ্জ্বল মহাপাত্র নামের ষোল বছরের ছেলেটি। সে এই ঘরে থাকে । তার বাড়ি উড়িষ্যায়। রূপকে তারও ভালোই লেগেছে। তেমনি রূপেরও ।
             রূপ, এখানে আলো ঝলমলে রাতের প্রশস্ত সরক দেখেছে, দ্রুতগামী যানবাহন দেখেছে, অগণিত বিদেশি পর্যটক দেখেছে, নানা ধরনের মনোলুব্ধকর খাদ্যের নিত্য আয়োজন দেখেছে,ভোগ বিলাসের স্রোতে ভেসে যাওয়া মানুষদের দেখেছে---সব ধরনের আয়োজন ছড়িয়ে আছে  শুধু প্রয়োজন অপর্যাপ্ত অঢেল অর্থের। বিলাসিতায় গাভাসানোর অবকাশ ও মানসিকতা তার নেই। সহজ সরল জীবনযাপন করতেই বরাবর পছন্দ করে রূপ। সে এখানে কেন এসেছে একটি মুহূর্তের জন্যও ভোলেনি, নাগরিক বিলাসিতায় প্রলুব্ধ হয়ে ভেসে যায়নি । মন দিয়ে সে কাজ করে। ফাঁকি দেয় না কাজে। অবনী কাকু এবং কারখানার মালিক দুজনেই তার প্রতি সন্তুষ্ট। 
                যখন বাড়ি থেকে রওনা হয়েছিল তখন শ্রাবণ মাস । আজ তার কাজের এক মাস পূর্ণ হলো। এটা ভাদ্র। শরতের সূচনা কাল । বাংলার আকাশে বাতাসে ঢাকের কাঠির বোল বাজতে শুরু করেছে। দিল্লির প্রকৃতি একেবারে  ভিন্ন চরিত্রের । শুষ্কতা, ধোঁয়া । গগনচুম্বী ইমারত, দূষণযুক্ত শ্বাসরোধী বাতাস, কলুষিত যমুনার প্রবাহ, ঘিঞ্জি এলাকার মানুষের অস্বাস্থ্যকর জীবন যাপন, আবেগ শূন্য ও আত্মকেন্দ্রিক,ভোগসর্বস্ব ও যান্ত্রিক জীবনে শরতের সামান্য ছোঁয়াটুক পর্যন্ত নেই। রবিবার ছুটি । দীপাবলিতে দুদিন ছুটি থাকে। দুর্গা পূজার কোন ছুটি নেই। এক রবিবারে উজ্জলকে নিয়ে যমুনার তীরে বেড়াতে এসেছিল। ছোট থেকেই তো সে মুক্ত পাখির মতন ঘুরে বেড়াতে ভালোবাসতো । যমুনার তীরে বসে তার বাড়ির পাশের নদীর কথা, নদীর দু ধারের সৌন্দর্যের কথা মনে পড়ছিল । শরতের সময় বাড়ি থেকে একটু দূরে মানসাই নদীর তীরে ত্রিকোণীয়ার ছোট্ট পার্কটিতে সাইকেল করে চলে আসতো । এ সময় নদী যেন স্বচ্ছ আয়না । ছোট ছোট ডিঙ্গি নৌকো ভেসে চলেছে। নীল আকাশের বুকেও ভেসে চলেছে পাল্লা দিয়ে সাদা বর্ণের মেঘ--নৌকার মতন।একেই স্বর্গের শোভা মনে হতো তার। মেঘখণ্ডগুলো যেন পৃথিবী থেকে বার্তা নিয়ে চলেছে কৈলাসের উদ্যেশ্যে । মা দুর্গা যেন পরিবার সমেত পৃথিবীর সন্তানদের সঙ্গে কয়েক দিন আনন্দে আবেগে কাটিয়ে যান । শারদীয়ার দুর্গোৎসব বাংলার সমগ্ৰ প্রকৃতি জুড়ে যে ধরনের মাদকতা ছড়িয়ে দেয়, এক অলৌকিক আবেগ সকলের মনের স্তর ধরে নামতে থাকে চৈতন্যের নানা স্তরে । অজস্র ইচ্ছারা জমাট বাঁধে মধুর চাকের মতন তখন থেকেই । বাংলার আকাশ বাতাসে, প্রতিটি ঘাসে, ভোরের শিশির বিন্দুতে, মাটির বুকে ছড়িয়ে থাকা শিউলি ফুলে, পদ্মফুলের জলবিন্দুতে,শুভ্র অথবা খয়েরি রঙের অজস্র শাপলা-শালুকে,সবুজ কচি চারাধানের সুশীল শিহরনে, ভোরের হিমেল হাওয়ার দোলায় মায়ের আগমনের পদধ্বনি যেন প্রতিটি মুহূর্তে শুনতে পেয়ে থাকে বাঙ্গালী তার সমগ্ৰ সত্তা জুড়ে। রূপ, উজ্জ্বলকে বলছে," আর পনেরো দিন পরেই আমাদের ওখানে দুর্গাপূজা। পূজায় কতো যে আনন্দ হয় তোমাকে কী বলবো। এবার ভেবেছিলাম বন্ধুরা মিলে চপ,মোমোর দোকান দিবো, হলো না। পূজার কয়টি দিনই আমাদের আনন্দের দিন। বাকি দিনগুলো যন্ত্রণার কাঁটাই আমাদের পাথেয় । " এই বলে রূপ দীর্ঘশ্বাস ছেড়ে কাজে যাওয়ার জন্য প্রস্তুতি নিতে লাগলো। দুর্গাপূজা চলে এলো। দুর্গাপূজায় ছুটি পাওয়া যায় না । গেলে বিনা বেতনে যেতে হবে। কাল পঞ্চমী । সে নেই।গ্ৰামে পূজার আয়োজন চলছে। সে নেই সে যন্ত্রণা শুধু তার নিজের। দিল্লিতে বাঙ্গালীরা মিলে কোথাও পূজা করে থাকলেও বাংলার মতো আনন্দ কোথায়? সবেতেই কৃত্তিমতা, যান্ত্রিকতা।
       ষষ্ঠীও চলে গেল। আজ সপ্তমী। পঞ্চমীর আগে থেকেই দেবী দর্শনের জন্য বাংলার বুকে জনস্রোত বন্যার মতোই নেমে আসে। এখানে সেই আবেগ,উৎসাহ কোথায়?কাজ করতে করতে এসব ভাবছে । নীল আকাশের দিকে তাকিয়ে আছে। দেখতে পেল দূর থেকে একদল আকাশী-হলুদ রঙের বিদেশি পাখির ঝাঁক মাথার উপর দিয়ে উড়ে চলে গেলো। পাখিগুলো দেখে সে চিনতে পেরেছে। এদের সে তাদের বাড়িরওখানে নদীর পাড়ে দেখেছে । শরৎকালেই আসে বাংলায় এই পরিযায়ী পাখির দল,শরতের শেষে আবার ফিরে যায় । রূপ বাড়ি ফিরে যেতে পারলোনা পুজোর দিনে ! তাই যেন পাখিগুলোর ডানায় মনকে পাঠিয়ে দিল তার গ্ৰামে । 
          বন্ধুদের মধ্যে একজন নবমীর রাতে রূপকে ফোন করেছে । রূপের সঙ্গে কতো কথা হলো। সে বললো, "আমি ভিডিও কল করছি তুই গ্ৰামের পূজার আয়োজন দেখ্ । ও তোর ফোনে তো ভিডিও কল হবে না। অবনী কাকুর ফোনে হবে ।" রূপ ভিডিও কলে গ্ৰামের দুর্গা পূজার আয়োজন দেখলো কয়েক মিনিট, তারপরে যোগাযোগ বিচ্ছিন্ন হয়ে গেল । পরিস্থিতি ও জীবনের কঠিন বাঁক রূপকে বাধ্য করেছে অনলাইনে নিজের গ্রামের দুর্গাপূজা দেখতে । জীবন কখন কাকে কোথায় এনে দাঁড় করাবে কেউ বলতে পারে না ! রূপ টাকা রোজগার করছে, বাড়িতে পাঠিয়েছে। বাড়ির আর্থিক দুরবস্থা ধীরে ধীরে দূর হতে শুরু করেছে। জীবন তার নানা পরীক্ষা নিয়ে চলেছে । তার ব্যবহারে আর কাজে মালিক খুশি। কোম্পানিতে তার আয় বেড়েছে, পদোন্নতি হয়েছে। এখন সে অবনী কাকুর শর্ত থাকে মুক্ত । দেখতে দেখতে পাঁচ বছর চলে গেল। পরিযায়ী পাখির দলটি ঠিক সময়ে তার মাথায় উপর দিয়ে শব্দ করতে করতে উড়ে যায় । তারা তার গ্ৰামের নদীর চরে যাবে,আবার এ পথ ধরেই ফিরে আসবে । রূপ সেটাই দেখে প্রতিবছর । রূপের অনেক দায়িত্ব। অনেক টাকা উপার্জন করতে হবে। যখনই ওই পরিযায়ী পাখিগুলোকে দেখে তখন রূপের শৈশব, কৈশোর,নদীর চর,গ্রামের খেলার মাঠ সব যেন আবর্তিত হতে থাকে তার চৈতন্যের প্রতিটি স্তর ধরে। দিন রাতের মতো সে শুধু ঘুরে চলেছে চাকার মতো । তার বাড়ি ফেরার আকাঙ্ক্ষা পরিযায়ী পাখির ডানায় উড়তে থাকে,আর সে দিল্লির ছোট্ট ঘরটির সংকীর্ণ জানালার ফাঁক দিয়ে দূরে উড়ে যাওয়া পরিযায়ী পাখিগুলির সাথে মনে মনে ! কোথায় যেন উড়ে যেতে থাকে ?

No comments:
Post a Comment