Wednesday, September 3, 2025


 

ব্যক্তিগত গদ্য 


মৃত্যুর আঙুলে স্পর্শ

রুদ্র 


মৃত্যু।
শব্দটা শুনলেই মনে হয় অদ্ভুত এক নীরবতা নেমে আসে চারপাশে—যেন সমস্ত শব্দ, আলো, রঙ এক মুহূর্তের জন্য থেমে গেছে। সেই থেমে যাওয়া মুহূর্তে আমি অনুভব করি, কেউ আমার কাঁধে আলতো হাত রেখেছে। ভয় নয়, বরং এক অব্যক্ত স্নেহ, এমন এক ছোঁয়া যা দিনের শেষে বিশ্রামের কথা বলে।

আমরা বেঁচে থাকি অসংখ্য আকাঙ্ক্ষার ভেতর দিয়ে, অসংখ্য অপূর্ণতার ভার নিয়ে। প্রতিদিনের ক্লান্তি, প্রতিদিনের অনিবার্য ছোটোখাটো মৃত্যু—এসবের ভিতর দিয়ে শরীরের কোষে কোষে জমে থাকে এক অদৃশ্য অবসাদ। মনে হয়, সেই অবসাদের শেকড় একদিন গভীর হয়ে পুরো দেহটাকে গ্রাস করবে। ঠিক তখনই মৃত্যু এসে দাঁড়াবে দরজায়—যেন দীর্ঘ ভ্রমণের শেষে অবশেষে নিজের ঘরে ফেরা।

এই দিক থেকে দেখলে, মৃত্যু এক সুন্দর মুক্তির পথ।
যেমন নদী কোনোদিন সমুদ্রে গিয়ে থেমে যায় না—বরং তারই মধ্যে বিলীন হয়ে অনন্ত হয়ে ওঠে—তেমনি মানুষও হয়তো মিশে যায় সেই অচেনা শূন্যতায়, যেখানে নেই কোনো অপূর্ণতা, নেই কোনো দায়। শুধু নিস্তব্ধতা—যার ভেতর ঘুমিয়ে আছে কোটি কোটি বছরের বিশ্রাম।

কিন্তু আমি জানি, মৃত্যু কেবল মুক্তি নয়—এ এক আসক্তিও।
যেন কোনো নিষিদ্ধ দরজা, যার ফাঁক দিয়ে উঁকি দিলে দেখা যায় এমন এক আলো, যা জীবনের কোনো আলো নয়। কতবার রাতের নির্জনতায়, ভাঙাচোরা মন নিয়ে আমি সেই দরজার দিকে তাকিয়ে থেকেছি! ভেবেছি—যদি এক পা ফেলি, তবে হয়তো সমস্ত ব্যথা থেমে যাবে। হয়তো সমস্ত প্রশ্ন মুছে যাবে। হয়তো অন্যপারে আমার জন্য অপেক্ষা করছে এক অদ্ভুত নিশ্চুপ স্নেহ, যা জীবনের কোনো আলিঙ্গনের চেয়েও গভীর।

কখনও মৃত্যু এতটাই কাছে চলে আসে যে তার নিঃশ্বাস টের পাই। ভিড়ের মাঝেও, কথোপকথনের মাঝেও, অচেনা মানুষের চোখের ভেতর হঠাৎ তার ছায়া ঝলকে ওঠে। তখন মনে হয়—আমরা সবাই তার কাছে ঋণী, শুধু সময়ের অপেক্ষা বাকি।

তবু আজও বেঁচে আছি।
মৃত্যু আমার দরজার বাইরে দাঁড়িয়ে আছে, ধৈর্য ধরে। আমি জানি, কোনো একদিন—যখন আকাশের রঙ আর চিনব না, যখন সময়ের কাঁটা আমার সমস্ত দিনের হিসেব মুছে দেবে—তখন আমি দরজা খুলে দেব।

প্রশ্ন কেবল একটাই—
সেদিন আমি ওকে বলব কি,
“তুমি আমার মুক্তি”—
নাকি বলব,
“তুমি আমার আসক্তি।”

হয়তো সত্যিটা দুটোই হবে। 

No comments:

Post a Comment