গল্প 
ভাবনার জগৎ
ঋতুপর্ণা ধর
ভাবনা দাশগুপ্ত, বয়স তিরিশ ছুঁইছুঁই, এক সময়ের স্কুলশিক্ষিকা, এখন সমাজমাধ্যমের জনপ্রিয় কনটেন্ট ক্রিয়েটর। সে প্রতিদিন রাত দশটায় লাইভে আসে—
একটা ঝিমঝিমে ঘরে নরম আলো, মুখটা অর্ধেক আলো-ছায়ায় ঢাকা।তার গলা নেমে আসে কোমল স্বরে—
“আজ বলব আমার গল্প। তবে, এই গল্পটা একরকম নয়… এর সত্যিও আছে, কল্পনাও।”
ভাবনার গল্পে বাস্তবের সাথে মিশে যায় রহস্য, স্বপ্ন, ছায়া।
সে বলে, “রুদ্র নামে একজন কবি একদিন তার বারান্দায় এসে বসেছিল… শুধু তাকিয়ে ছিল।”
আর শ্রোতারা মুগ্ধ হয়ে শুনত,
ভাবনার দর্শকসংখ্যা বাড়ত, লাইক, শেয়ার, কমেন্টে ভেসে যেত তার প্রোফাইল।
তবে কেউ জানত না—রুদ্র আদৌ ছিল কি না।
ভাবনার গল্প বলতে বলতে যেন নিজের একটা জগৎ তৈরি হয়ে গিয়েছিল—
এক জগৎ, যেখানে "অমৃত" নামের ছেলে তার জন্য রাতভর কবিতা লেখে,
"সীমন্তিনী" নামে এক বৃদ্ধা যার আয়নার পাশে বসে থাকে চিরকাল।
দিনের পর দিন সে ডুবে যেতে থাকে সেই জগতে।
বন্ধুদের সঙ্গে যোগাযোগ কমে যায়, ফোন ধরা বন্ধ হয়,
কাজের বাইরেও সে গল্পের চরিত্রদের নিয়ে কথা বলতে শুরু করে।
একদিন লাইভে এসে হঠাৎ থেমে যায় সে।
চোখ দুটো কেমন ঘোলাটে। বলে—
“ওরা আজ আমায় নিতে এসেছে।
রুদ্র বলেছে—এই পৃথিবীতে আমার জায়গা নেই আর।
আমার আসল বাড়ি ওর সঙ্গে, অমৃতের শহরে।”
পরদিন তার লাইভ হয় না। আরেকদিনও নয়।
অনেক খোঁজাখুঁজির পর, এক অনুরাগী তার পরিবারকে জানায়।
পাওয়া যায় এক মনোরোগ চিকিৎসাকেন্দ্রে।
ডাক্তার বলেন—স্কিজোফ্রেনিয়া।
ভাবনার মস্তিষ্ক বাস্তব ও কল্পনার সীমারেখা হারিয়েছে।
চিকিৎসা শুরু হয়।
প্রথম দিকে কেউ তার কাছে পৌঁছাতে পারে না।
কিন্তু একদিন এক তরুণ চিকিৎসক রবীন্দ্রনাথের “ছুটি” গল্পটি পড়ে শোনান।
ভাবনা চুপ করে শোনে। চোখের কোণে জল জমে।
তারপর ধীরে ধীরে আরও রবীন্দ্র-রচনা—
“পত্রলেখা”, “শেষের কবিতা”, “সভ্যতার সংকট”।
ভাবনা যেন নিজেকে খুঁজে পায় শব্দের ভিতর দিয়ে।
কল্পনার ঘোর থেকে বেরিয়ে, সে বলে ওঠে—
“রবীন্দ্রনাথও তো কল্পনা করতেন, কিন্তু পালাতে নয়—পৌঁছাতে।”
মাস কয়েক পর, ভাবনা সুস্থ হয়ে ওঠে।
লাইভে আর ফিরে আসে না, কিন্তু অনলাইনে গল্প বলা ছাড়ে না।
তবে এখন তার গল্পে আছে জীবনের ঘ্রাণ, বাস্তবতার উষ্ণতা।
সে ছোট ছোট ভিডিও বানায়—
ছাদের পাখিদের নিয়ে, রাস্তার ফেরিওয়ালার ডাক নিয়ে, কিংবা এক কাপ চায়ের গল্প।
একটি ক্যাপশনে লেখে—
“গল্প বলি, কারণ আমি বেঁচে আছি।
এবার আর পালিয়ে নয়—থাকার গল্প বলি।
ভাবনার জগৎ এবার সত্যি।”

No comments:
Post a Comment