Wednesday, September 3, 2025


 

ব্যক্তিগত গদ্য 


ছোটবেলায় মহালয়ার দিনগুলো এখন খুব মিস করি
বটু কৃষ্ণ হালদার

অবশেষে এক ভয়ঙ্কর কালো আঁধার পেরিয়ে ঘরের মেয়ে উমা আসছে বাপের বাড়িতে।বিগত কয়েক  বছর যাবত আমরা অনেক কিছু হারিয়েছি।হারিয়েছে প্রিয়জনদের হাসিমুখ।চারিদিকে কান পাতলে শোনা যেতো প্রিয়জন হারানোর আর্তনাদ।কর্মহারা হয়েছে বহু মানুষ।তবুও কালো মেঘের ভ্রুকুটি এখনো কাটেনি।করোনা আতঙ্ক না থাকলেও বিশ্ব মেতে উঠেছে যুদ্ধ যুদ্ধ খেলায়।আফগানিস্তান,পাকিস্তান,রাশিয়া,ইউক্রেন ইসরাইল,প্যালেস্টাইন,ইরাক,ইরান,বাংলাদেশর মাটি তাজা তাজা রক্তে লাল হয়ে উঠেছে।তবে নিয়মের বেড়াজালে ঋতু পরিবর্তনের সাথে সাথে পরিবর্তিত হচ্ছে প্রাকৃতিক পরিবেশের রূপ।
 
নীল সাদা মেঘেদের ভেলা,দূরে কাশ ফুলের উপর দিয়ে তালে তালে নাচন জানান দিচ্ছে এটা শরৎকাল।সুখ,দুঃখ,হাসি,কান্না সঙ্গে নিয়ে ঘরের মেয়ে উমা সপরিবারে বাপের বাড়ি আসার সময় আসন্ন।চারিদিকে সাজ সাজ রব।এ যেন সুখ দুঃখ পাওয়া,না পাওয়ার  মাঝে আলতো খুশির ছোঁয়ায় হারিয়ে যেতে কার না ভালো লাগে বলুন।এ খুশি যেন আবির রঙের আলতো আল্পনার ছোঁয়া পদ্ম পাতার মত নেচে উঠছে জলের ঢেউয়ে।তাই সবাই মিলে তাল ভাগ করে নেব।

আমার জন্ম সুন্দরবনের এক প্রত্যন্ত গ্রামে। গোসাবা ব্লকের পাঠানখালী নামক জায়গায় কামারপড়া গ্রামে। ফলে জীবনের পনেরোটা বসন্ত পার হয়েছে গ্রামের জংলা, নদী, খাল-বিলে সাঁতার কেটে। বর্তমান সময়ের মতো তখনকার দিকে গ্রামের রাস্তাঘাট ছিল কাঁচা। তাই শৈশব কেটেছে ধুলো,বালি,মাটিকাঁদা মেখে। কখনোবা গাছের ডালে দোলা খেতে খেতে মাটিতে লুটিয়ে পড়া, কখনো বা অন্যের গাছের ফল চুরি করতে গিয়ে তাড়া খেয়ে মাটিতে হোঁচট খেয়ে পায়ের রক্ত ঝরিয়ে লুকিয়ে বাড়িতে ফেরার দিন গুলো আজ খুব মিস করি।

বাঙালির বারো মাসে তেরো পার্বণ। গ্রামেগঞ্জে অনেক রকম পূজা পার্বণ লেগে থাকে মাসে মাসে।সেই অনুষ্ঠানগুলোকে কেন্দ্র করে কোথাও কোথাও যাত্রা,মেলা,পুতুল নাচ,নাটক,পর্দার ভিডিও ইত্যাদি নানা অনুষ্ঠান লেগে থাকত। রাতে বাবা ঘুমিয়ে পড়লে নিঃশব্দে পা টিপে টিপে বন্ধুদের সঙ্গে সারারাত কাটিয়ে ফিরে আসার আগে দেখতাম বাবা লাঠি নিয়ে বসে থাকতে ন।কখনো বা রেগে গিয়ে দু-চারবার পিঠে দিয়ে দিতেন। চোখ ডলতে ডলতে হাতপা ধুয়ে  বিছানায় অঘোরে ঘুমিয়ে পড়তাম। দুপুর গড়াতেই ঠাকুমা কিংবা মা ডেকে তুলে স্নান করিয় ভাত খাওয়াতে। এখন কর্মসূত্রে গ্রামের বাইরে থাকি অর্থাৎ কলকাতায় থাকি। সেই পনের বছর বয়সে গ্রাম ছেড়ে কলকাতায় আসে পড়াশোনার জন্য কেটে গেছে আরো কুড়িটা বসন্ত। আমার শৈশবে গ্রামে ফেলে আসা দিন আর বর্তমান সময়ের মধ্যে বিস্তর ফারাক। তবে জীবনের সব থেকে বেশি মিস করি শৈশবে দুর্গাপূজার আগের সময় বা মহালয়ার দিনগুলো।

দুর্গাপূজা শুরু হওয়ার এক মাস আগে থেকে আমাদের বাজারে ঠাকুর তৈরি করা শুরু হয়ে যেত। জেটিঘাটে একপাশে ঠাকুরের কাঠমা তৈরি করার জিনিসপত্র থাকতো। সেখানেই থাকতেন মৃৎশিল্পী রা।সুদূর চন্দননগর থেকে প্রতিবছরই তারা আসতেন ঠাকুর তৈরি করতে। একই লোক প্রতিবছর আসছেন তাই আমার সঙ্গে চেনা পরিচিত হয়ে গিয়েছিল। রোজ রোজ স্কুলে যাবার পথে ফেরার পথে আমরা একবার সেখান দেখা না করে আসতাম না। দুর্গাপূজা যতই এগিয়ে আসতো ততই আমাদের মধ্যে উদ্দীপনা উল্লাস বেড়ে যেতো। জেটিঘাটে দিনের-পর-দিন যেতাম আর মায়ের রূপ পরিবর্তন হতে। প্রথমে কাঠমা ছিল ধীরে ধীরে তার ওপর খড় লাগাতেন, মাটির প্রলেপ পড়ত। ধীরে ধীরে হাত চোখ কান মুখ সব তৈরি হতো। অসুর বাঘ, সরস্বতী,গণেশ কার্তিক লক্ষ্মী  তৈরি হতো। আর আমরা গিয়ে হাত দিয়ে স্পর্শ করে দেখতাম। কখনো-সখনো তাদের কাছে বকা ও খেতে হয়েছে। তাতে কি তার মধ্যে কত আনন্দ খুঁজে পেতাম।

ফেলে আসা মহালয়ার দিন যা আজও ভুলতে পারিনা। রঙিন টিভি তো দূরের কথা,গ্রামে লব বুড়োর বাড়িতে ছিল একটা সাদা কালো টিভি।সেটা চলত ব্যাটারীতে চার্জ দিয়ে। হই একটা দিন হয়তো ব্যাটারি চার্জ দিয়ে রাখতেন মহালয়া দেখব বলে। কারণ তখনকার দিনে ব্যাটারির চার্জ দিতে গেলেও অনেক দূরে নিয়ে যেতে হতো। মহালয়ার দিন টিভি খুললেও আমরা বাইরে জানলা দিয়ে কয়েকবার দেখেছি। দূর থেকে ভালোভাবে দেখা যেত না। তবু তার মধ্যেই আনন্দ যে মহালায় দেখছি।তবে সে সময় রেডিওর প্রচলন ছিল। আর রঙিন টিভি আধুনিক স্মার্ট ফোনের যুগেও রেডিও ছাড়া মহালয়ার কথা ভাবা যায় না একেবারেই। প্রায় প্রত্যেকের বাড়িতে রেডিও ছিল। মহালয়া শুনবে বলে বাজারে গিয়ে আগের দিন সবাই ব্যাটারি কিনে আনতেন। তবে ওই দিনটা বরাদ্দ থাকত খালের ওপারে মালি বুড়োর জন্য। প্রতি বছরেই তার একই নিয়ম ছিল। মালীবুড়ো বাজারে গিয়ে ব্যাটারি কিনে  আনতেন। আর মাছ রাত দিয়ে সেই রেডিওর ফুল ভলিউম দিয়ে বাঁশের মাথায় বেঁধে উপরে ঝুলিয়ে রাখতেন।রাতে শুতে যাওয়ার আগে মাকে বলে রাখতাম যদি না উঠিত ভোরের আগেই আমাকে ডেকে দেবে।মহালয়ার আগের রাতটা সারা শরীর জুড়ে থাকতো উন্মাদনা ও অস্থিরতা। ভোরের আগেই ঘুম ভেঙে যেত। শুনতাম রেডিওর সেই আওয়াজ চারিদিকে ছড়িয়ে পড়েছে। মহালয়া শেষ হতেই দেখতাম মা-বোন সবাই দৌড়াদৌড়ি করছে। সিঁদুর জলে গুলে তাতে দুর্গা ফল চুবিয়ে সদর দরজা জানালাতে ফোটা দিচ্ছে। তখনো ও অন্ধকার কুয়াশাচ্ছন্ন পরিবেশ। আশেপাশে বাড়ির কাকিমা জেঠিমা দিদি দ্বারা উলুধ্বনি শাঁখ বাজা তো। সেই ভোরবেলায় প্রত্যেককে ঠাকুর ঘরে প্রদীপ,ধূপ,ধুনা জ্বালাতো। মহালয়ার সুরুর মুহূর্তে অদ্ভুত সুন্দর স্নিগ্ধতা এক পবিত্রতায় ভরে যেত গৃহকোণের চারিপাশ উঠোন আকাশ বাতাস।

সময় সময়ের তালে ছুটে চলেছে। আমরাও তার পিছু নিয়েছি। কালের নিয়মে শৈশব থেকে কৈশোর কৈশোর থেকে মধ্যগগনে পৌঁছেছি। বর্তমানে অত্যাধুনিক সভ্যতার যুগে প্রতিযোগিতার পালা।একে অপরকে পিছনে ফেলে সময় কিনে নেওয়ার প্রয়াস। প্রতিযোগিতার ভারে কুঁকড়ে যাচ্ছে বিবর্ণ মুখ। শিশুদের পিঠে বইয়ের পাহাড় ভারে পূব আকাশে লাল সূর্যটা তাদের কাছে ঝলসানো রুটি সমান। খেলার মাঠে শুধুই নিঃসঙ্গতা। মোবাইল হয়েছে সবার নিত্যসঙ্গী। তারি সাথে সাথে অল্প বয়সে চোখ কে গ্রাস করছে চশমা। প্রাকৃতিক পরিবেশের রূপ,বর্ণ পরিত্যাগ করে সবাই কেমন করে কৃত্তিম পরিবেশের সঙ্গে  আলিঙ্গনে ব্যস্ত। আমরা যে স্বর্ণালী দিনগুলো পার করে এসেছি তা বর্তমান সমাজের শিশু কিংবা যুব সমাজের কাছে শুধুমাত্র লেখনি হয়ে উঠেছে। তারা বইয়ের পাতায় আমাদের ফেলে আসা সময় গুলো গল্প কিংবা,গদ্য কবিতার মাধ্যমে পড়াশোনা করে।যার ফলে সেকাল আর বর্তমান কালের মধ্যে কিছু শূন্যস্থান পূরণ হয়েছে তা বোধহয় আর পূরণ হবার নয়। তাই পরিশেষে বলা যায়-' হায় আফসোস ভারী/ছেলেবেলা চলে গেল খুব তাড়াতাড়ি'। ছোটবেলায় সেই মহালয়ার দিনগুলি ছিল অনাবিল আনন্দের দিন এক নতুন উন্মাদনায় জেগে উঠবার দিন। তখন টাকা-পয়সা না থাকলেও অনাবিল সুখের ঢেউয়ে কমতি ছিল না। আজও হয়তো অনেকেই মহালয়ার এই আনন্দ হুল্লোড় গুলো খুঁজে বেড়াচ্ছে হাতড়ে বেড়াচ্ছে। সবার আড়ালে অনেকের মন খুঁজে বেড়ায় হাফ কাপ চা নাড়ু ঠাকুর ঘরে শঙ্খ ধ্বনি বাবার হাঁক ডাক,সেই সাদা কালো রঙিন টিভির দিন রেডিওতে মহালয়া শুনবার দিন।

No comments:

Post a Comment