Wednesday, September 3, 2025


 

ব্যক্তিগত গদ্য 


মনের আয়নায়

অনিতা নাগ 

চার দেওয়ালের বাইরের আকাশটা প্রাচীরঘেরা সীমানা পেরিয়ে তেমন করে ধরা দেয় না ফ্ল্যাট বাড়ীর চোহদ্দির মধ্যে। অনুর বড্ড আফশোস। সুযোগ পেলেই ফাঁক- ফোঁকড়ের পাশ দিয়ে খন্ডিত আকাশটাকে আগলে রাখে মনের অলিন্দে। কতো যে তার রূপের বাহার! এখন তো ঋতুরও ভোল পাল্টে গেছে। বর্ষার আকাশে দিব্যি শরতের মেঘের মায়াজাল। সবাই কেমন যেনো ফন্দী এঁটেছে। কাজের ফাঁকে একবার বারান্দায় গিয়ে নীল আকাশে সাদা মেঘের ভেলায় মন ভাসিয়ে রান্নাঘরে ফিরে সবে চচ্চড়িতে পাঁচফোড়ন দিয়েছে, ওমা! হঠাৎ কোথা থেকে কাজল কালো মেঘ এসে বৃষ্টির ফোঁটায় ভিজিয়ে দিলো চারধার। চচ্চড়ির ফোড়ন তো পুড়লোই, সাথে কাজ বাড়ালো। বারান্দার দড়িতে মেলা ভিজে কাপড়ের বোঝা! কি যে দুষ্টুমি শুরু করেছে তার ঠিক নেই। শ্রাবণের আকাশ সবসময়েই কালো মেঘের জটা জলে জড়িয়ে থাকে। তো এ'বার যে কোথা থেকে মনোহরণ নীল মেঘে গা ভাসিয়ে সাদা মেঘের ভেলা উড়ে উড়ে এসে ভাসিয়ে নিয়ে যাচ্ছে মন, তার ঠিক নেই। মনকে বেশ শক্ত করে বেঁধে রান্নায় মন দিলো অনু। এ'সব মনের পাগলামো তো কাউকে বলা যায় না। পাগোল ভাববে যে। ভাববে বুড়ো বয়সের ভিমরতি। মেঘের সাথে ভেসে বেড়ানো! আদিখ্যেতা! কাজ সেরে, দুপুরে খাওয়ার পর একটু নিজস্ব সময়। তখন মুঠোফোনের দাপট কাটিয়ে নিজেকে নিয়ে ভাবার সময় কমই থাকে। সে'দিন আকাশে কালো মেঘের ঘনঘটা থেকে বৃষ্টি নামলো মুষলধারে। ইচ্ছে করছিলো শ্রাবণের এই ধারায় শরীর মন সিক্ত করে নেয়। কিন্তু সে' উপায় নেই। বৃষ্টির জল এখন আগের মতো নেই। আর ভিজলে শরীর দেবে? তখন তো হাজার সমস্যা। অসুস্থ হতে বড্ড ভয় অনুর। মন ভেসে চলে ছোটবেলায়। ওদের পৈতৃক বাড়ীর বারান্দা থেকে বৃষ্টি দেখার দিনগুলো কেমব ছবির মতো দেখতে । পাড়ায় একটা ডোবা ছিলো। বর্ষার জলে ভরে উঠতো। দাদারা সেখানে মহা আনন্দে মাছ খুঁজে বেড়াতো। আর বহু পরিশ্রমের পর কারুর কাছ থেকে মাটির ভাঁড় / কাঁচের শিশি জোগাড় করে তাতে করে বাড়ী নিয়ে আসতো। কিন্তু ওদের আনন্দে জল ঢেলে মা দূর করে ছুঁড়ে ফেলে দিতেন। এগুলো মাছ, না ব্যাঙাচি! বোঝো কান্ড। মা রাগে গজগজ করতে করতে হাতের কাজে মন দিতেন। বর্ষায় বড্ড আতান্তর। খোলা উঠোনের একদিকে রান্নাঘর, কয়লার ঘর। অন্যদিকে ভাঁড়ার ঘর। বর্ষাকালে জল পেরিয়ে সব কাজ। তারমধ্যে কয়লার ঘরে টিনের চাল থেকে পড়া বৃষ্টির জলে ঘুঁটে কয়লা বাঁচানো এক বিরাট কাজ। তারমধ্যে মাছ ভেবে ব্যাঙাচী নিয়ে এসে ছোড়দা বেচারা বিপদে পড়তো। অনুরা তখন কচিকাচার দল। খবরের কাগজ নিয়ে নৌকা ভাসাতে ব্যাস্ত। কার নৌকা জমা জলে বেশীক্ষণ ভেসে থাকে সেই দেখতে ব্যাস্ত। ততোক্ষণে রান্নাঘর থেকে ভেসে আসা খিচুড়ির গন্ধে সে' দিন তাড়াতাড়ি ক্ষিদে পেয়ে যেতো। সাথে পাপড় ভাজা। আটা গুলে তাতে কালোজিরে, পোস্ত ছড়িয়ে হতো আলুর খোসা ভাজা, আলুনি, বেগুনি, কুমড়োনি। আহা আজ এতো বছর পর সেই স্বাদ যেনো ফিরে এলো। শেষ পাতে আমের আচার। আহা! কি আনন্দ যে ছিলো। কিন্তু খাবার পরে আর তো কখনো খোঁজ নেওয়া হয়নি মা, ঠাকুমার জন্য ছিলো তো আলুনি, কুমড়োনি, পাঁপরভাজা! আমরা যখন অতো বছর আগে সে খবর রাখতাম না, তাহলে আজ কেনো কেউ খোঁজ নিলো না বলে অভিমান হয়! এ তো রীতিমতো অন্যায়। এ' বার থেকে সাবধান হতে হবে। এই সব সাতপাঁচ ভাবতে ভাবতে চোখের জলে ঝাপসা হয় চারদিক। বুক উথলে একরাশ অভিমান আর কান্না গলায় দলা পাকিয়ে উঠে। কেনো সবাই চলে গেলে! কেনো সব হারিয়ে গেলো! ফ্ল্যাটবাড়ীর আরাম আয়েশের ঘেরাটোপে মন যে খুঁজে বেড়ায় ফেলে আসা দিনগুলোকে। একটু বৃষ্টি কমলেই বিকেলে খেলতে বেড়োনো। বড়দের চোখ এড়িয়ে জমা জলে পা ভিজোনো আর মাটি ঘাঁটা! এখন আর এ'সব কেউ বিশ্বাস করবে না। মাটিও এখন কিনতে হয়। বড় কোম্পানির লেবেল লাগিয়ে সুদৃশ্য প্যাকেটে মাটি আসে। তাই দিয়েই সখের বাগান বিলাস! বাবার বড্ড গাছের সখ ছিলো। শীতের সময় ডালিয়া, চন্দ্রমল্লিকা আলো করে থাকতো। গরমে বেল, জুঁই। সবই টবে। কতোরকমের সার তৈরী করতেন বাবা। সে’ সব করতে না পারলেও ব্যালকনিতে কয়েকটা টবে গাছ আছে অনুর। রোজ সকালে উঠে ওদের কাছে গেলেই মন ভালো হয়ে যায়। ওরা যেদিন খিলখিলিয়ে হেসে রঙ ছড়িয়ে দেয়, সে'দিনটা এক ভালো লাগা ছুঁয়ে থাকে সারাদিন। বাবার কথা মনে পড়ে যায়। এমন করেই তারা জড়িয়ে থাকেন অনুকে। তাদের সবটা নিয়েই তো ভেঙেচুরে নিজেকে গড়ে নেওয়া। এই ভাঙগড়ার নিত্য খেলায় মন হারিয়ে যায়। বিয়ের পর থেকে প্রবাস বাস। মাত্র বাইশটা বছর মা’ বাবার সাথে থাকা। তারপর বছরে হাতে গোণা ক'দিনই বা দেখা হতো।! পরকে আপন করে জীবনের পথ চলা। সে' শিক্ষা ও তারাই দিয়েছেন। কর্তার চাকরী জীবনের শেষ দিকে কিছুদিন সমুদ্র শহরে থাকার সুযোগ হয়েছিলো অনুর। তখন খুব কাছ থেকে সমুদ্রকে দেখার, জানার সুযোগ হয়েছিলো। নিত্য ভাঙা আর গড়া। বিরামহীন বয়ে চলা। কোনো চাওয়া পাওয়া নেই। অপেক্ষা নেই। অন্তহীন বয়ে চলা। কতো তার রূপ। সকালে সূর্যাস্তের আলোয় যেমন মোহময়ী, সন্ধ্যারাগের সাজেও অপরূপা। মধ্যাহ্নের সূর্যালোকে কিশেরীর চঞ্চলতা। তুমি যেমন করে দেখতে চাও সে তেমনি। তাকে ঘিরে কতো ব্যাস্ততা। কতো পর্যটক, কতো বিপনন। অনু ভাবে এমন করে যদি নিজেকে গড়ে নিতে পারতো বেশ হতো। হয় না। আর তাই তো এতো জ্বালা। মন নামক ওই বস্তুটি যে বড্ড জটিল। জীবনের শুরুতে সারাদিন সংসার সামলাতে সামলাতে নিজের কথা মনে করার সময় পাওয়া যায় না। তারপর আস্তে আস্তে নিজেকে কোথায় হারিয়ে ফেলা। পেছনে পড়ে থাকে স্কুলবেলা, কলেজ জীবন, নিজের ভালো লাগা। তখন জীবনের নতুন ভূমিকায় নতুন চাওয়া পাওয়া। প্রেমিকা থেকে স্ত্রী, সন্তানের মা, গৃহিনী। এমন কতো ভূমিকার রূপায়নে ব্যাস্ত মেয়েটি নিজের কথা ভাবার অবকাশ পেতো না। মনের আলমারীর ধূলো মুছে এখন তাকে খুঁজে নেওয়া। একটা কথা অনু সার বুঝেছে। নিজেকে নিজেই ভালো রাখতে হবে। তাই মান অভিমানের মেঘ ভাসিয়ে দেয় আকাশে। ওরা জল হয়ে ঝরে পড়ুক টুপটাপ। যেমন শিউলিতলায় আলো হয়ে থাকে টুপটাপ ঝরে পড়া শিউলিরা। শিউলির গন্ধে শরতের হাতছানি। শরত মানেই সাদা মেঘের ভেলা, পূজোর প্যান্ডেল, দুর্গা কাঠামোয় শিল্পীর ব্যাস্ততা। ঢাকের আওয়াজ, নতুন সাজ, হৈহৈ। এখন সবকিছু অনেক পাল্টে গেছে। তবে প্রকৃতিকে বদলানোর ক্ষমতা কারুর নেই। তাই রক্ষে। শত দূষণের বাঁধণ তুচ্ছ করে তাই আজও আকাশ মায়াবী নীল। তাতে সাদা মেঘেদের ভেলা ভাসে। আজও শিউলির গন্ধে উমা আসার প্রতিক্ষা। আর এই সব নিয়েই জীবন। জীবন খাতার পাতা উল্টোতে উল্টোতে এমন করেই ভেসে চলা জীবনের ছন্দে। মেঘের চাদরে মুখ লুকিয়ে দিনের আলো কখন নিভে গেছে টের পাই নি অনু। অগোছালো মনটাকে গুছিয়ে নিয়ে রোজকার যাপনে ফিরে চলা চেনা ছন্দে। তুলসী তলায় প্রদীপ জ্বেলে সকলের মঙ্গল কামনা। আর একটাই প্রার্থণা সব আঁধার ঘুচে যাক। আলোয় ভরুক বিশ্বভূবন। আঁধার ভূবন আলোয় ভরুক, ঘুচুক অন্ধকারবিশ্বভূবন মাঝে বাজুক তোমার আপন সুর।

No comments:

Post a Comment