Wednesday, September 3, 2025


 

গল্প 


রহস্যের অতলে

শুভেন্দু নন্দী 

শ্যামলকাকু খুব ভোরবেলায় অর্কর বাড়ি থেকে প্রস্থান করলেন। সকালবেলায় এইভাবে অর্কর ঘুম না ভাঙ্গিয়ে চলে যাওয়া গর্হিতের মতই কাজ মনে হোলো তাঁর কাছে।  গতকালের ঘটনা তাঁর কাছে খুবই হৃদয়বিদারক। ঐ ঝড়-জলের রাতে নিজের বাড়িতে এসে দেখেন সদর দরজায় তালা লাগানো। অথচ তাঁর চাকরীতে যোগদানের পর তাঁর মাতৃস্থানীয়া পিসি একাই এই বাড়িতে থাকতেন।  আশেপাশের প্রতিবেশীদের কথায় এটা স্পষ্ট হোলো তাঁর কাছে যে, ঐ বাড়িতে এক ভদ্রলোকের অকস্মাৎ মৃত্যুর কারণে পিসি মানসিক আঘাতে শয্যাশায়ী হন এবং অবশেষে চিরকালের জন্য পরপারে পাড়ি দেন।  অত রাতে শ্যামলবাবুকে কেউ ঠাহর করতে পারেননি। ভয়ে, আতঙ্কে নিজের পরিচয় তাঁদের কাছে গোপন রাখতে বাধ্য হোলেন। অতঃপর, ক্ষোভে, দুঃখে,হতাশায় তিনি চটজলদি ঐ জায়গা পরিত্যাগ করে অর্কদের বাড়ি আশ্রয় নেন। এটাই সান্ত্বনা ছিলো যে তাঁর accident-এর কথা হয়তো অর্কর কাছে অজ্ঞাত ছিলো। কিন্ত এখন কিংকর্তব্যবিমুঢ় হয়ে এগিয়ে চললেন সামনের একটা ছোট্ট চায়ের দোকানে। দোকান সবে খুলেছে। দোকানী একজন অল্প বয়সী মহিলা।চা-বিস্কুটের অর্ডার দিয়ে একটা পুরনো খবরের কাগজে মনোনিবেশ করতেই তাঁঁর চক্ষু ছানাবড়া? এতো তাঁরই ছবি- এনকাউন্টারে তাঁরই মৃত্যুর বিশদ বিবরণ! দোকানী বিশেষভাবে তাঁকে লক্ষ্য করেনি। চা-পান করে সন্ত্রস্ত হয়ে চারিদিক তাকাতে তাকাতে চললেন পয়সা মিটিয়ে দিয়ে। একবার ভেবেছিলেন তাঁর নিজস্ব বাড়িতে ফিরে যাবেন, কিন্ত তার আর উপায় রইলোনা ঐ সর্বনাশা খবরের জন্য। সত্যি, কর্নেল কাকা তাঁর জীবনদান করেছেন- তাঁর রক্ষাকর্তা  কিন্ত সে কথা ভাববার এখন সময় নেই।.......

ঘটনার পরের দিনই জয়ন্ত টিউশন থেকে ফেরার পথে সাইকেল থেকে নামলো । আরে! এটাই বোধ হয় শ্যামলকাকুর বাড়ির নতুন ঠিকানা। খড়ের চাল আর বাঁশের বেড়ার দেওয়াল দিয়ে তৈরী প্রায় প্রতিটি বাড়ি। মনে হয় সবাই দিনমজুরী করে জীবনযাপন করেন। বোধ হয় ঐ একতলা দালান বাড়িটি শ্যামলকাকুর। কিন্ত দরজা লক করা। 
- আচ্ছা, এই বাড়িতে কী কেউ নেই ? দরজায় তালা লাগানো দেখছি।" চারিদিক তাকিয়ে দু-একজনকে আশেপাশে দেখে প্রশ্ন ছুঁড়লো জয়ন্ত। 
" একজন এখানে এসেছিলেন। আপনার মতই জিজ্ঞাসাবাদ করেছিলেন।" পাশের বাড়ি থেকে বেশ কয়েকজন সমস্বরে বলে উঠলো,
"উঁচুমতন এক ভদ্রলোক। মাথায় টুপী, গায়ে রেইনকোট, চোখে চশমা, অনুমান ষাট ছুঁই ছুঁই বয়স। পায়ে ক্যামবিসের  জুতো, কাঁধে পুরনো আমলের ঢাউস ব্যাগ, আর সঙ্গে ছাতা। চারিদিক তখন অন্ধকারে ঢাকা ছিলো একটানা লোডশেডিং-এর কারণে। তাই ভালো করে মুখটা দেখা সম্ভব হয়নি।  বেশ নিম্ন স্বরে আর থেমে থেমে কথা বলছিলেন তিনি। আর মাঝে মাঝে বাড়িটার দিকেও লক্ষ্য করছিলেন"
- তা-ই-ই ? নামধাম কিছু বলেছিলেন কী ? জয়ন্ত রীতিমতন উত্তেজিত হয়ে এ কথা বলে ওঠে।
- তা বলেননি অবশ্য। আমরাও জিজ্ঞেস করিনি। আপনার কী চেনা জানা? কোনো সম্পর্ক?"
-কি মুশকিল! আমি একটু জানতে চাইছি। দরকার ছিলো তাই । সম্পর্ক আছে বৈকি তাঁদের সাথে। নামটা জানা থাকলে ভালো হোতো।"
"কেন বলুন তো ?"
"মানে একটা ব্যাপারে......" কথাটা অসম্পূর্ণ আর অনুচ্চারিত থেকে গেলো জয়ন্তর কাছ থেকে। বলাটা সমীচীন হবেনা ভেবেই থেমে গেলো জয়ন্ত। 
-  ওঃ, তাহলে শুনুন। এখানে একজন বয়স্কা মহিলা থাকতেন পুত্রসম এক চাকরীকরা ভদ্রলোকের সাথে। সম্পর্কে পিসি বলেই আমরা জানি।-
- এখন নেই কেন? মানে ব্যাপারটা অন্যভাবে নেবেন না, কেমন? 
- আসলে ঐ তথাকথিত ভদ্রলোকের হঠাৎ মৃত্যুর 
খবর শুনে তাঁর দূর সম্পর্কের ঐ পিসি মানসিকভাবে ভেঙ্গে পড়েন। শোকে,দুঃখে অসুস্থ হয়ে পড়েন এবং পরপারে স্বর্গবাসী হন।খুবই মর্মান্তিক।"
- সত্যিই তো। যাকগে, আমি তাহলে আসি।আপনাদের যথেষ্ট ধন্যবাদ সহযোগিতার জন্য।"
এখন বিকেল গড়িয়ে অনেকক্ষন সন্ধ্যা নেমেছে।
জয়ন্ত যাবার উদ্যোগ করতেই হঠাৎ গেটের কাছে চোখ পড়লো। ছোট্ট একটা সাদা কাগজের চিরকুট। তড়িঘড়ি করে পকেটে নিয়েই চললো বাড়ির পানে সাইকেলে। 
- হয়তো এর মধ্যে রহস্যের সূত্র আছে"। সে মনে মনে ভাবলো।
 - জলজ্যান্ত একটা মানুষের প্রথমে নিজের বাড়ি, পরে অর্কর বাসস্থানে আগমন ও ভোরে আবার অর্কর বাড়ি থেকে প্রস্থান- এতগুলো ঘটনা ঘটে গেলো তবুও তিনি রহস্যের আড়ালেই রয়ে গেলেন।
তাঁর তো কোনও পাত্তাই মিলছে না। গেলেন তিনি তাহলে কোথায় ? যেখানে চারিদিকে প্রোমোটারিং এর ব্যবসা,স্বল্প জায়গায় বহুতল ফ্ল্যাট তৈরীর প্রচেষ্টা,  সেখানে অত সুন্দর ছিমছাম একতলা বাড়ি। বেশ তারিফ করবার মত । বিস্তর খরচও করেছিলেন এই বাড়িটি গড়ার
পেছনে। অনেক ঋণও করেছিলেন শ্যামলকাকু। যেটা অর্কর কাছ থেকেই শুনেছিলো জয়ন্ত।  ওঃ
বাড়িটার চারিদিকে উঁচু পাঁচিল। ভেতরে টবগুলোতে মরসুমী ফুলের সমারোহ,কিচেন-গার্ডেন, পেছনে উঁকিঝুঁকি মারা আম-কাঁঠালের উঁচু উঁচু ঝাঁঁকড়া গাছ। অথচ কি এক বিভ্রান্তিকর ঘটনায় প্রতিবেশীদের কাছে তাঁর identity establish করতেই scared feel করলেন। নিজের বাড়ি অথচ দরজার lock খুলতে সাহস হোলোনা। মনে হয় সেখান থেকে পরিত্যক্ত  হয়ে শেষমেষ অর্কদের বাড়ি! সৌজন্যে- এক ভুয়ো খবর- শ্যামলের এনকাউন্টারে মুত্যু। ওঃ ভাবাই যায়না! ভাগ্যের কি লিখন! .....
সাইকেলে চলার গতি বাড়িয়ে দিলো জয়ন্ত।  -অনেকটা সময় গড়িয়ে গেলো। বাড়িতে সবাই ভীষন চিন্তা করবে। অবশ্য তা অকারণে নয়।
- মাঠে যখন নেমেছি- গোল তো করতেই হবে। অর্ককে কথা দিয়েছি। রহস্য উন্মোচন করতেই হবে। চিরকুটে যদি কিছু সুত্র পাওয়া যায়।"জয়ন্ত আত্মপ্রত্যয়ের সঙ্গে এ কথা ভাবতে থাকে।

No comments:

Post a Comment