উত্তরযাপন
মিলেমিশে একাকার সব : এলোমেলো কথা কিছু
ড. সৌরভ দত্ত
বাঁকুড়া থেকে বেরিয়ে বেলিয়াতোড় হয়ে বড়জোড়া। তারপর দুর্গাপুর ব্যারেজ পেরিয়ে জেলা বদল। অর্থাৎ বাঁকুড়া থেকে পশ্চিম বর্ধমান। আরেকটু গেলেই আমার পারিবারিক ঠিকানা। কলকাতা থেকে হোক, বা শিলিগুড়ি থেকে, ন্যাশনাল হাইওয়ে দিয়ে দুর্গাপুরে প্রবেশের মুখে প্রথম যে জনবহুল এলাকা, নাম মুচিপাড়া, ঐ রাস্তার কমবেশি নব্বই ডিগ্রী কোণে বাঁদিকে যে রাস্তা, সেই রাস্তার গা ঘেঁষে একটু গেলেই আমার উক্ত পারিবারিক ঠিকানা। গাড়িতে চালক হয়ে হোক, বা আরোহী হয়ে, রুজি রোজগারের তাগিদে বাঁকুড়ার কর্মস্থলে এসে দিন কাটিয়ে রাত পার করে পরদিন হোক বা তার পরদিন, যখন দুর্গাপুরে ফিরে চলার পথ ধরি, সন্ধ্যার আলোআঁধারিতে হঠাৎ কখনো কখনো একেবারে না-বলে-কয়ে আমার মাথায় ভিড় করতে শুরু করে গিলান্ডি নদী, আংরাভাসা, গয়েরকাটা, তেলিপাড়া মোড়, এথেলবাড়ি, বীরপাড়া চৌপথি। অনেকদিনই এরকম হয়েছে যে, গোধূলি বেলায় ফাঁকা রাস্তায় আমার গাড়ি ছুটছে, পখন্না মোড় পেরিয়ে বড়জোড়ায় ঢুকছি, আর এদিকে আমি ভাবছি ঐ তো সামনে বীরপাড়া চৌপথি, সারিবদ্ধভাবে রিক্সা দাঁড়িয়ে আছে, অমুক পালের পাঁচমিশালি দোকানে আলো ঝলমল করছে, তমুক পালের ভাতের হোটেলে সীমিত আলোয় রাতের খাবারদাবারের তোড়জোড় চলছে, বাঁদিকে বীরপাড়া বাজারে ঢুকতে রাস্তার ডানদিকের মন্দিরে নিভু নিভু আলোয় সান্ধ্যকালীন পুজো চলছে। সম্বিত ফিরে আসে বটে এক নিমেষেই, কিন্তু ঐ যে কয়েক মুহূর্তের জন্য সম্বিত ফেরে না, ঐ সামান্য ক্ষণ ধরে একপ্রকার ভালোলাগা চলে ভেতরে ভেতরে। 'ভালোলাগা' বলতে এটিই যেন স্বাভাবিক। যেন সত্যিই আমি জলপাইগুড়ি বা শিলিগুড়ি শহরের কোনো কর্মস্থল থেকে সেদিনের মতো কাজ শেষ করে ময়নাগুড়ি, ধুপগুড়ি হয়ে বীরপাড়ায় ফিরছি! সম্বিত ফিরলে যে একেবারে মনখারাপের বাতাবরণ তৈরি হয়ে পড়ে, এমনটাও ঠিক নয়, কিন্তু মনের অবচেতনে আষ্টেপৃষ্ঠে জড়িয়ে থাকা যে অতীত স্মৃতি, তা থেকে নিস্তার মেলে না। আরো কয়েক মুহূর্তের জন্য যেন একটু গুলিয়ে যায় চলমান অবস্থায় নিজের অবস্থানগত দিকটি। আরোহী না হয়ে চালক হলে পরক্ষণেই মনে হয় যে, গয়েরকাটাই হোক, কিংবা বড়জোড়া, নিজের আস্তানা অভিমুখী গাড়িরাস্তায় তীক্ষ্ণ দৃষ্টি রেখে এগিয়ে চললেই তো হলো, সবই যেন মিলেমিশে একাকার।
ভূমিষ্ঠ হওয়ার পর থেকে জীবনের অর্ধশতাধিক বছর পেরিয়ে পেছনে ফিরে তাকাতে গিয়ে অনায়াসে বুঝতে পারি যে অনেক পরিবর্তন হয়েছে জীবনযাপনের পরতে পরতে। এই পরিবর্তন কমবেশি অনেকেরই আসে, সবার না আসুক। দুর্গাপুজোর সময়টাই ধরা যাক। শ্রমিক ও কর্মীদের মধ্যে একপ্রস্থ কৌতূহল চলতো চা বাগানের পুজো ভাতা (বোনাস) নিয়ে। বার্ষিক আয়ের কুড়ি শতাংশ (বিশ পার্সেন্ট) বোনাস হিসেবে মিললে সোনায় সোহাগা। সব বছর মিলতো না এই ইপ্সিত বিশ পার্সেন্ট বোনাস। দু'চার শতাংশ কম পেয়ে সন্তুষ্ট থাকতে হতো হামেশাই। কিন্তু চায়ের বাজার মন্দা, এমন অকাট্য যুক্তিতে যেসব বছর বোনাস ধপ করে নেমে যেতো মাস-মাইনেতে (এইট পয়েন্ট থ্রি থ্রি পার্সেন্টে), রীতিমতো হতাশা গ্রাস করতো। এই অনুচ্ছেদের এতটুকু পড়ে মনে হতে পারে লেখকের প্রথম জীবনের চাকরিস্থল নিশ্চয়ই চা বাগান। না, তা তো নয়। কিন্তু চা বাগানের কৃষ্টি আর সংস্কৃতি গায়ে মেখে তো তিল তিল করে গড়ে ওঠা জীবনপ্রবাহে। শহর থেকে দূরে চা বাগানের ঘেরাটোপে নিম্নবিত্ত ও মধ্যবিত্ত পরিবারগুলোর পারস্পরিক বন্ধন খুবই শক্তপোক্ত। সবকিছু খুব সরল ও স্বচ্ছ। পুজোর কেনাকাটা কার্যত পুরোটাই বোনাস নির্ভর। নির্ভরতা এতটাই যে, 'বোনাস' কথাটি অক্ষরজ্ঞানশূন্য মানুষ থেকে শুরু করে সমস্ত শ্রমিক ও কর্মীদের কাছে পুজোর আনন্দের পেছনে অদৃশ্য এক চালিকাশক্তি। পুজো মানেই একটানা কয়েকদিন ধরে বাগানে ছুটি। চা বাগানের ঘেরাটোপ থেকে একটু হেঁটে জনবহুল এলাকায় গেলেই পুজোর ঢাকের শব্দ বাতাসে ভেসে আসে। মনে অসম্ভব এক শিহরণ জাগে। কাঁসর ঘন্টা সহযোগে এই ঢাকের আওয়াজের জন্যই তো এতদিন ধরে চেয়ে থাকা। নতুন জামাকাপড় গায়ে। নতুন জুতো পায়ে। সপ্তমীর সন্ধ্যায় বাগানের হলুদ-কালো ট্রাকটির মাঠের মাঝখানে এসে নিয়ম করে দাঁড়িয়ে পড়া। ট্রাকে চড়ে বাজারের ঠাকুর দেখতে যাওয়াটা ঐচ্ছিক। কিন্তু সপ্তমীর সন্ধ্যায় মাঠে ট্রাক এসে দাঁড়িয়ে হর্ন বাজিয়ে সবাইকে পুজোয় যেতে যে আহ্বান করবে, তার জন্য কতদিনের অপেক্ষা! পুজো আসার যে অপেক্ষা, সেটাই যেন বেশি আনন্দের, বেশি শান্তির। পুজো চলে আসা মানে তো হুড়মুড়িয়ে পুজো পেরিয়ে যাবার আশঙ্কা আর দুর্ভাবনা। সপ্তমীর দুপুর পর্যন্ত বেশিরভাগ সময়ই যেহেতু বাগানের প্রশাসনিক কাজকর্ম ও চা উৎপাদন প্রক্রিয়া চালু, পুজোর ছুটি সেই অর্থে আরম্ভ সপ্তমীর দ্বিতীয়ার্ধে। তাই সপ্তমী যেন ঘন্টা দুয়েকের মধ্যেই শেষ এবং রাত পেরোলেই অষ্টমীর সকাল। অষ্টমী মানেই অঞ্জলী, কুমারী পুজো। পুজো তখন রীতিমতো মধ্যগগনে। কী আনন্দ কী আনন্দ! অষ্টমীর সন্ধ্যা মন খুলে আনন্দ করার সন্ধ্যা। সন্ধ্যা গড়িয়ে রাত। আনন্দোৎসব রীতিমতো, কারণ হাতে তখনও গোটা নবমী পড়ে আছে। কিন্তু রাত পেরিয়ে নবমীর সকালবেলা থেকেই যেন বছরব্যাপী অপেক্ষা যা কিছুর জন্য, তার বিদায়ের ঘন্টা বেজে যাবার পালা। তা সত্ত্বেও মনপ্রাণ ঢেলে, মনখারাপ ছেড়ে, বেশি রাত পর্যন্ত এই পুজো, সেই পুজো, আড্ডা, খাওয়াদাওয়া। সব সেরে বছরের মতো দুর্গাপুজোর পালা সাঙ্গ করে ঘরে ফিরে আসা। তারপর দশমীর সকাল থেকেই মন্ডপে মন্ডপে বিষন্নতার ছোঁয়া। তবে এই বিষন্নতার ব্যাপ্তি সমাজের প্রতিটি স্তরে নয়। কেবলমাত্র দশমীকে উপলক্ষ্য করে যে মেলা অনুষ্ঠিত হতো, নিশ্চয়ই এখনো হয়, বহু মানুষের, বিক্রেতা হোক বা ক্রেতা, পুজোর মূল আকর্ষণ তা। ওদিকে বিকেল হতেই রীতিমতো মিছিল করে বীরপাড়া ও আশেপাশের চা বাগানের ঠাকুর বিসর্জনের ট্রাকগুলোর ভিড়ে ঠাসা হয়ে এগিয়ে চলা ফালাকাটা অভিমুখে। হয়তো এখনো যায়, বা ভাগাভাগি হয়ে গিয়ে একদল যায় মাদারিহাটে, একদল যায় গয়েরকাটায়, বাকিরা ফালাকাটায়। 'মুজনাই' নামটি দশমীর ঘাটে গিয়েই আমার প্রথম শোনা। দশমীর গোধূলি বেলায় বা সন্ধ্যায় মুজনাই তীরে যে উদ্দীপনার তথা উন্মাদনার ধারাবাহিক সাক্ষী থেকেছি শৈশবের দিনগুলোতে, তার স্মৃতি টাটকা। যেন এই তো সেদিনের কথা সব। কী বিশালাকার প্রতিমা সব! কী সুন্দর সব অবয়ব! কী জীবন্ত অভিব্যক্তি! কী নিখুঁত শিল্পকর্ম! অথচ বিসর্জনের মধ্য দিয়ে সবকিছু কী অনায়াসে নিমেষেই শেষ! পরপর বিসর্জন দেখতে দেখতে একধরণের শূণ্যতায় ডুবে যাওয়া যেন। ভিড়ের মধ্যে হারিয়ে না-যাওয়ার প্রচ্ছন্ন তাগিদে শক্ত করে ধরে রাখা বড়দের হাত। একসময় ফিরতি পথে ভিড় ঠেলে পায়ে পায়ে পৌঁছে যাওয়া দশমীর মেলার মাঠে। কী প্রকান্ড সেই মেলা! ঐতিহ্য ও জনপ্রিয়তার যোগ্য সহাবস্থান যেন। কাঠের ট্রাক কিনতাম নিয়ম করে। রাতে ঘরে ফিরে যত্ন করে ঘরের এককোণে রাখা হতো সদ্য কিনে আনা ঐ ট্রাক। অপেক্ষা পরদিন সকালের। এমনিতে পুজোর ছুটি। পড়াশোনার বিরতি। তাই সকাল হতেই ঐ ট্রাকের পেছনটায় বালি বোঝাই করে দড়ি দিয়ে টেনে টেনে সারা উঠোন জুড়ে ঘোরা। ঘুরতে ঘুরতে.. ঘুরতে ঘুরতে.. কল্পনায় হয়ত বা এঁকে চলতাম দূরের কোনো এক শিল্পশহরকে। সেই এক শিল্পশহর, যেখানে বহু বছর পর পাকাপাকি থাকার এক আস্তানা হবে। সেখানে ভোরবেলায় ঘুম ভাঙলেই গা ঘেঁষে চলে যাওয়া রাস্তায় ছুটে চলবে কতরকমের সব বালি-সিমেন্ট-কয়লা বাহক দূরপাল্লার ট্রাক! কোত্থেকে বা আসে ট্রাকগুলো! কোথায় বা যায়! কিন্তু ট্রাকের কোনো বিরাম নেই। চলছে তো চলছেই। হয় বাঁদিক থেকে ডানদিকে, নয় তো ডানদিক থেকে বাঁদিকে। সব সেই মুচিপাড়া হয়ে। বীরপাড়া চা বাগান, মুজনাই নদী, দুর্গাপুর ব্যারেজ, দামোদর নদ, বড়জোড়া, গয়েরকাটা, কোথাকার কী, দিব্যি মিলেমিশে একাকার হয়ে যায় সব! তখনকার দশমীর মেলা থেকে কিনে আনা কাঠের ট্রাক আর এখনকার পথচলতি বালি-সিমেন্ট-কয়লা বাহক দূরপাল্লার ট্রাক, ভাবনার বৈচিত্র্যে বিদ্ধ হয়ে কেমন গোলমেলে বিবর্তন একধরণের! সময়ের বেড়াজাল ছিন্ন করে গুলিয়ে যায় সব! সম্বিত ফিরে আসার দরকারটাই বা কীসের! এলোমেলো ভাবনার হাত ধরে চলুক না ভালোলাগাটুকু। তাতে কী সুন্দর মিলেমিশে একাকার হয়ে যায় সবকিছু!

No comments:
Post a Comment