এই শহর এই জীবন
বেলা দে
জলশহর, মানে আমার শহর জলপাইগুড়ি। এ শহরে আমার স্থায়িত্বকাল ৫২ বছর, জন্মস্থানে নারী জীবনের মেয়াদ খুবই কম, বলতে গেলে এক চতুর্থাংশ। তাই জন্মস্থান ধর্ত্যব্যের মধ্যেই পড়ে না,
শশুরঘর স্বামীর সংসার মেয়েদের পাকাপোক্ত বসত। এমন একটা সময় আসে যেদিন সে হয়ে ওঠে সেখানে সর্বময় কর্তী পুত্রকন্যা নাতি নাতনি বেষ্টনীর মধ্যে চরম আবদ্ধ। কলেজ পড়তে এসেছি এই শহরে ১৯৭১ এ, ইতিপূর্বে দার্জিলিঙে গভমেন্ট কলেজে পরে এখানে আসা। ১৯৭৪ সালে গাটছরা
এই শহরেই বাঁধা পড়ে। বসবাস এশহরের প্রাণকেন্দ্রে, বড্ড বেশি ভালবেসে ফেলেছি শহরটাকে, হয়তো নিজের চেয়েও। তাই বুঝি তার বদনাম একেবারেই সহ্য করতে পারি না। এমন প্রানবন্ত সংস্কৃতিপ্রিয় জনপদ আর কোথাও দেখিনি জানি যার যার নিজের শহর অতিপ্রিয় তার কাছে সেটা বলার অপেক্ষা রাখে না, এখানে সাহিত্যপ্রিয় মানুষজন খেলাধূলা নাটক নাচ গান আবৃত্তি যেনো নিত্যকার চালচিত্র, প্রতিটি জীবনে মজ্জ্বায় মিশে আছে, রান্নাবান্না গৃহস্থালি চুলোয় যাক। শিল্পকলা বারমাস সেজেই আছে। আমাকে যেটুকু দিয়েছে এ শহরটাই। আমার পান্ডাপাড়া এলাকায় বাড়ি সেদিন যখন পাড়ায় ঢুকেছি বিয়ের পরে সমস্ত বাড়িঘর মোটামুটি টিনের চাল কাঠের বেড়ায়, আমার শশুর বাড়িটাও তাই। বেশ কয়েক বছরের মধ্যেই দেখতে দেখতে দোতালা তিনতলা চারতলা অবধি উঠে গেল, ঢেকে গেছে আকাশের চাঁদ তারা এমনকি সূর্য দেব অব্দি। প্রত্যন্ত গ্রাম এলাকা থেকেও এখানে এসে মাথা উঁচু ম্যানসন তৈরী করে ফেলেছে, ইমারত ঢাকা এই শহরটাকে বড় অচেনা লাগে সময় সময়।
আমি ডুয়ার্সের এক পল্লী শহর থেকে আসা, সেই শ্যামলছায়া এখনো লেগে আছে মননে যাপনে প্রাণের গহীনে। চাই শস্যশ্যামল রঙের মাখামাখি, বাড়িতে তাই ফুলবাগানে ঘিরে আছি। অফুরান জমিজমা সেদিন মানুষের, কেউ বিক্রি করে দিয়েছে কেউ প্রমোটারের হাতে তুলে দিয়েছে কেউবা ফুলচাষ করে শান্তিলাভ করছে, আমার শশুরবাড়ি ১৫ কাঠায় ছিল যৌথ পরিবার, সবাইকার জন্য একটা ভগ্নাংশ করে পরেছে। আমাদের বাড়ির এক কি মি পথ পেরিয়ে শুধুই ধানক্ষেতে ছয়লাপ আর ঘন জঙ্গল রাতে সমবেত শিয়াল কুকুরের ডাক, টাউনশিপ এখন এতটাই বেড়েছে যে এর শেষটাও আমরা চিনি না।নিত্যনতুন গজিয়ে উঠেছে শপিং মল, ইংরেজি মাধ্যম স্কুল সাইবার কাফে আর অজস্র দোকান অথচ মাছি মারছে সবাই। ভাবতাম এই শহরটা আমার হাতের চেটোয় ধরা, সে ধারণা ভুল প্রমাণিত, এলাকার পথঘাট এখন যেন চিনতেই পারি না। শুধু বসে গেল পুরাতন সিনেমা হলগুলো বেকার হল কতিপয় খেটে খাওয়া কর্মী জীবন। এস পি রায়, বি সি ঘোষ,এবং রাহুতবাড়ির মতো রক্ষনশীল চা শিল্পপতিরা ওদের চা বাগান সব বিক্রি করে এ প্রজন্মের সবাই চলে গেছে কলকাতায়, রাহুতদের কয়েকটি বাগান এখনো আছে টলমল অবস্থায়। যখন বারোয়ারী পূজা সংখ্যায় খুব কম আমাদের ভিড়ভাট্টায় পুজার
আনন্দ জমায়েত সব বাগিচা শিল্পপতিদের বাড়িতে। এখনও ওদের বাড়ির কাছাকাছি গেলে মন ভেঙে যায়, বাঙালির শিল্প কোথায় গেল। এ শহরে যা বহুলাংশে বর্ধিত হয়েছে তা হল মানুষের সংস্কৃতি ও কলম চাষের ইচ্ছা। আমাদের এ বাড়িতেও আগে নিয়মমাফিক চর্চা ছিল, শাশুড়ি পিসিশাশুড়ি ননদ, আমার কর্তা বেহালাশিল্পী, চিত্রশিল্পী, গায়ক আবার বাগিচাশিল্পীও বটে। বাড়ির নিশানাই ছিল ফুলবাগান বাড়ি। আমার একমাত্র কন্যাকেও আমি নাচ,গান, অঙ্কন, সবরকম শিক্ষাই দিয়েছি। কলম পেশা আর নাটক অবশ্য ওর নিজের ভিতরকার। এই শহরটা না হলে হয়তো ওকে এতটা প্রাপ্তি এনে দিতে পারতাম না। মোটমাট নিজের বাড়ি থেকে ওর প্রথম প্রেরণা, ওর ঠাকুমা ছিলেন গায়িকা, সেলাই শিক্ষিকা, মহিলা সমিতির কার্যকরী সদস্য। এ শহরে শিক্ষিত অর্ধশিক্ষিত সব মেয়েরাই স্বচ্ছন্দে সর্বক্ষেত্রে কাজ করে চলেছে পুরুষের সাথে।সন্ধ্যা থেকে রাত অব্দি ফ্রাষ্টফুডের দোকান চলে রমরমিয়ে, কেউ নেই বসে শুয়ে। খুব গর্ব অনুভব করি আমি আমার জলপাইগুড়ি শহরটা নিয়ে। আমি নিজেও আজ যা হয়েছি যতটুকু সম্ভব জীবন চিনতে পেরেছি সবটা এশহরের অবদান।
No comments:
Post a Comment