স্লোগান
আফতাব হোসেন
রাত তিনটে , সেকেন্ড ফ্লোর ।
ঘুম আর আসবে না ধরে নিয়েই ধীমান বাথরুমের দিকে এগোয় । সুলেখা বেঁচে থাকার সময় খিটখিট করতো বেশ । মশারী তুলে বাথরুমে যাওয়ার সময় নাকি মশা ঢোকে বেশি । সে নিয়ে রোজ অশান্তি ছিল একসময় । এ শহর মানুষের চেয়ে বেশি মশাদের এ নিয়ে তর্কও হয়েছে বেশ কয়েকবার । তবে ওই যে , নামেই স্ত্রী , পুরুষদের সাধ্য কোথায় জিতবে । এমনকি করোনার সময়কালেও ইহ জগৎ ছাড়ের কম্পিটিশনেও সুলেখা হারিয়ে দিয়েছে তাঁকে । থাক সে সব । ইদানিং বড্ড খেই হারিয়ে ফেলছে ধীমান । চোখের সামনে সবসময় ভাসতে দেখছে অতীত । গুগল পড়ে দেখেছে ধীমান বয়সকালে এ সব হয় । যে সব অতীত অবচেতন হয়ে নিজেকে এককালে পুরুষ করে তুলেছিল , সে সব অতীত বড্ড নিঃসঙ্গ করে আজকাল । সে প্রায় বিয়াল্লিশ বছর আগে সুলেখার বাবার হাত থেকে রাজদূত নেবার সময় সুলেখার চোখ এর চাউনি হোক , কিংবা আট মাসের মেয়ে মহুয়ার জন্মদিনের দিনেই বংশ রক্ষায় রাহুল কে আমার পরিকল্পনা, কোনটাতেই কেন যে সুলেখা বাধা দেয়নি সে নিয়ে আজও মাঝে মাঝে অনমনা হয়ে পড়ে ধীমান । ছেলে মেয়ের ভরা সংসারে রাহুলকে চার বছর বয়সে রামকৃষ্ণ মিশনে , চোদ্দপুরুষের উঠোনবাড়ির তুলসী গাছের মায়া ছেড়ে থ্রি বি এইচ কে কিংবা মহুয়ার পছন্দের ছেলেকে না করে একটু বেশি বয়সের স্কুল মাস্টারের সঙ্গে মহুয়ার বিয়ে , কোনটাতেই সুলেখা বাধা দেয়নি । শুধু তাকিয়েছে এক বার । সেই তাকানো গুলো বড্ড মনে পড়ে ইদানিং ধীমানের । অথচ ধীমানের দোষ নেই , ধীমান সারাজীবন সংসারের কথাই ভেবেছে ।
বাথরুম থেকে এসে জানলার সামনে দাঁড়ায় ধীমান । দূরে কোথাও স্লোগান ভেসে আসছে । রাত বাঁচানোর লড়াই এর স্লোগান । মেয়ে বাঁচানোর স্লোগান । রাত দখল করার স্লোগান । কোন স্লোগানই স্পষ্ট নয় ধীমানের কাছে । তাও স্লোগান গুলোর আবছা স্বরে ধীমানের কষ্ট হচ্ছে খুব । জানলা গুলো টাইট করে বন্ধ করে ধীমান চিৎকার করে উঠবে নাকি !
চিৎকার করে বলবে নাকি ?
সুলেখা ক্ষমা করে দিও ...কেন ? কে জানে ?
স্লোগান এখনো চলছে ।
*********
ভোর চারটে, ফার্স্ট ফ্লোর ।
ধড়পড় করে উঠে বসে বিহান । লজ্জায় নাকি অভ্যেসে নিজের উলঙ্গ শরীরটাকে ঝটপট করে ঢাকতে গিয়েও মিসেস রয় এর শরীরটা দেখে সামলে নেয় খানিক । একটা উলঙ্গ থলথলে পঁয়তাল্লিশ এর মেয়ে শরীর, কত নিশ্চিত ঘুমিয়ে । অথচ এই শরীরটাই রাতভর কতই না বিকৃত লালসা মিটিয়েছে বিহানের ওপর । বিহান অবশ্য এ সবে অভ্যস্থ । এ শহরের সব ময়লা মেখেও নিজেকে পলিসড করার প্রসেস বিহান জানে । কতই বা বয়স তখন , মেরে কেটে বাইশ । ওর মা বলতো ছেলেই আমার দুধে আলতা, বউমা খুঁজে আনা খুব কঠিন । লজ্জায় লাল হত বিহান । মৈত্রী কাছে আসার পর লজ্জাটা বেড়ে আরো লাল হচ্ছিল । গালিবের সায়েরি আর অরিজিৎ এর স্লো মোশন । মৈত্রীর চুমু খাওয়ার ব্যস্ততায় বিহান বুঝিয়েছিল মৈত্রীকে সিঁথির সিঁদুর আর রোম্যান্সের কম্বিনেশন ।
তারপর লক ডাউন । শহর ,পেটের ভাত কাড়লো বিহানের বাবার আর ভাইরাস কাড়লো ছাদ আর মায়ের আঁচল । রূপ আর লাল লজ্জা যে মৈত্রীর মাথার সিঁদুরের যোগ্যতা হতে পারে না সে অভিজ্ঞতা বিহানকে কখন আজকের এই ' দেশী বয়েস ' মার্কা বিহান করলো সে নিজেও গুছিয়ে উঠতে পারে নি আজ অব্দি । স্বপ্নের যে রাতগুলো সিঁদুর আর ফুলশয্যার শায়েরিতে সাজিয়েছিল , প্রতিরাতে ধারালো নখের আঘাতে ছিন্ন ভিন্ন হয়েও বোবা হয়ে ফুলশয্যা ভোগ করে বিহান । রোজ । কাস্টমার দের বলেও দেয় ওর ট্যাবুর কথা , ফ্যান্টাসির আগে একটু সিঁদুর , ব্যাস ।
শাওয়ার শেষে নিজেকে পরিপাটি করে ফার্স্ট ফ্লোরের ফ্লোরের দরজা খুলে বেরিয়ে যাওয়ার সময় স্লোগান শুনলো বিহান । এ শহরের নারী পুরুষের সমান সমান হওয়ার স্লোগান । রাত গুলো সবার জন্য সমান হোক স্লোগান । সিঁড়ি দিয়ে হাঁটতে হাঁটতে স্লোগান শুনে বড্ড হাসি পেল বিহানের । পকেটে হাত ভরে হদিস পেল সিঁদুর কোটটার । কৌট ছুঁয়ে
বিহান হাসছে বড্ড ...
হাসতে হাসতে চোখে জল এলো বলে ,
স্লোগান তখনো চলছে ।
***********
ভোর পাঁচটা , গ্রাউন্ড ফ্লোর ।
ফুলমতি বাচ্চাটাকে আর এক রাউন্ড ঘুম পাড়িয়ে , জগজিৎ কে পাঠায় মিউনিসিপ্যাল এর কল থেকে জল আনতে । ভোর বেলায় ভিড় কম থাকে বলে জগজিৎ সারাদিনের পানি ভরে নেয় এ সময় জ্যারিকেনে । ফুলমতিও এ সময় ওর থাকা পছন্দ করে না । ফ্ল্যাটের লিফ্ট ম্যান টু সিকিউরিটি , সব এক হতেই সামলাতে হয় জগজিৎ কে । ফুলমতি ঝাড়ু পোছা সামলায়। গ্রাউন্ড ফ্লোরে লিফট্ এর পাশের এক কামরার জায়গাটা এখন সংসার ওদের ।
ফুলমতির ঝাড়ু পোছা সদ্য শুরু ,
পায়ের আওয়াজ শুনে ফুলমতির মনে হয় সেকেন্ড ফ্লোরের বুড়া বাবু নামছে , মর্নিং ওয়াকে । বুকের ওড়নাটা একটু এলোমেলো করে রাখে ফুলমতি , পুরুষের নজর ছোট থেকেই চিনে মনে হয় । রোজ দশ টাকা পায় ফুলমতি বাবুর কাছে । বুড়া বাবু ভালো মানুষ না কি ওড়নার দাম দশ টাকা কে জানে । ফুলমতি শুধু জানে গেল মাস থেকে আমূল দুধের দাম দশ টাকা হয়েছে ।
তবে আজ বুঝতে ভুল করলো মনে হয় । বাবুর বদলে ফার্স্ট ফ্লোরের মালকিন নামছে কাকে যেন খুঁজে ।
না পেয়ে ফেরার আগে শাসিয়ে গেল ফুলমতির দিকে চেয়ে ,কাপড় ঠিক করে পরার জন্য , না হলে জগজিৎ সমেত তাড়াবে।
ফুলমতির মন খারাপ । নিজের জন্য নাকি মালকিনের বকা খাওয়ায় কে জানে ?
দূরে স্লোগানটা এখনো বাজছে...
কাকে বাঁচাতে কে জানে ...
No comments:
Post a Comment