Sunday, September 1, 2024


 

দহন বেলা 
অর্পিতা মুখার্জী চক্রবর্তী 


অলিন্দের থেকে ভাঙা থামের উপরে বসে দেখি 
চত্বরের মাঝখানে স্থগিত শবের চারপাশে 
শরিকেরা অন্ধকারে আসাড় মুদিত হয়ে আসে 
ধুনিগুলি জ্বেলে নিয়ে তৃতীয় চোখের দিব্যতায়।
                                                                      -শঙ্খ ঘোষ


একটি ইঁট-কাঠ-পাথরের জনবসতি, তার অলিন্দে জমা করা কতশত ইতিহাস, পরিবর্তন, বিবর্তন, আপাত উন্নয়ন, এবং ‘কতিপয়’ ক্ষয়িষ্ণু ঐতিহ্য। গড়িমসি বিহীন জীবনে সূর্যোদয়ের গেরুয়াতেও ব্যস্ততার রং। নিঃসীম ছুটে চলা। লোকাল ট্রেন, মেট্রো, বাস, অটো - সর্বত্র নাগরিক অরণ্য। পিচডালা রাস্তায় গাড়ির সারি, সিগন্যালে লাল আলো, জ্যাম, মিছিল, অবরোধ, স্লোগান। ফুটপাথ জুড়ে হকার, অগুন্তি ব্যস্ত পায়ের পাতা, “দু’টাকা দাও মা, খেয়ে বাঁচি”-দের ওরাংওটাং চালচুলো। আকাশের গায়ে সিঁটিয়ে থাকা হাসপাতাল, নার্সিংহোম জুড়ে   চিকিৎসা আর চিকিৎসকের, থুড়ি পাপ আর পুণ্যের চু কিৎ কিৎ। ট্রেনের কামরায়, গাড়ির জানলার কাঁচে হঠাৎ হঠাৎ বৃহন্নলাদের  উঁকিঝুঁকি। রঙচঙে সাজে পথের ধারের কিছু অস্তিত্বের টিকে থাকার অভ্যেস, শুকনো বেলির মালায় নিষিদ্ধপল্লীর কিছু রাতজাগা গল্প। কিছু অবৈধ প্রেম, ভ্রূণহত্যা, উচ্ছ্বাস ও উন্মাদনার কিছু রাতের ঠেক, নেশার আখড়া, চোরাকারবার, অন্ধগলি, কিডন্যাপ, ধর্ষণ, খুন। ভৌগলিক লক্ষণরেখা পেরিয়ে অবয়বের পুণরাবৃত্তি বা ঈষৎ হেরফের।

ঘরে বাইরে লক্ষাধিক মানুষের জীবন নির্বাহের অভ্যেস এই শহুরে ঘড়ির সাথে ঘূর্ণায়মান। প্রাত্যহিকতার সেই ধারাবাহিক সুরকে হোঁচট খেতে হয় কোন পৈচাশিক শিরোনামে। ছিটকে পড়ে জীবন নামক নাগরদোলার আরোহীদের গোলাপী চশমা। চেনা থেকে ক্রমশ অচেনা হয়ে ওঠার সেই ঘ্রাণ ছেলেধরার গল্পের মত ছড়িয়ে যায়। থেকে থেকে কাঁটা দেয় গায়ে, একঝাঁক জুজুবুড়ি এসে ছোট্ট মেয়েটিকে দুঃস্বপ্ন দেখায়।ইচ্ছায় অনিচ্ছায় কিছু অবিশ্বাস চিরতরে বাসা বাঁধে মনের অন্ধ কোটরে। বাড়ি থেকে বহুদূরে নতুন জীবনে অভ্যস্ত হবার মুখে প্রবল এক ঝাঁকুনি দিয়ে যায় দানবিকতার বাস্তবচিত্র। গুটিয়ে যায় অদম্য উদ্যম। একলা ঘরে মধ্য রাতে ঘাড়ের কাছে জান্তব নিঃশ্বাস টের পায় যেন অবচেতনে। অসংখ্য চেনা মানুষের ওপর অচিরেই অপ্রতিরোধ্য অবিশ্বাস বীজ বুনে চলতে শেখে তারা। মন বলে এই নীল সাদা গোলকে একলা নারীর কাছে সকলেই তো অচেনা।প্রাণভরে বিশ্বাস করা যেন দুর্বলতা, হাতের বেড়ের আগলে নেওয়ার আশা তখন অলীক। 

কলেজের ল্যাবরেটরি, লাইব্রেরী, শপিং মল, বাসস্ট্যান্ড, অটো বা রাস্তার মোড় - নির্জনতার সুতোয় নিরাপত্তাহীনতার ফাঁদ বুনে চলা। বহুতল অফিসের লিফটের চার দেওয়ালে কাঁটা হয়ে থাকা মন। সাবলীল স্বাধীনতা শুধু অতীতের সুখকর স্মৃতি। দিনের মানববিহীন পথ, রাতের রহস্যময় আলো, বাধ্যতামূলক দূরপাল্লার ট্রেনের শৌচাগার শুধু তাড়া করে ঘরের দিকে। কিন্তু, এ কথা জানা, ঘরের চারদেয়ালও তার নিরাপত্তার ঠিকানা নয়! রাজনৈতিক কালিমা লেপন, নাটকীয়তার মোড়কে মিডিয়ার ম্যাজিকাল চমক, আবেগহীন গড্ডালিকা প্রবাহে বিচারের বাণীর নীরব হাহাকার। বিকেলের শহরে সুগন্ধী মাধবীলতা যখন মেয়েকে বহুদূরের বাড়ির উঠোনকে মনে করায়, ঠিক তখন ছোট্ট শান্ত নাম-না-জানা পাড়াগাঁয়ের গাছে গাছে খেলে বেড়ানো ছোট্ট চঞ্চল পাখিটি মায়ের মনে মেয়ের শিশুবেলার ছবি আঁকে। আদ্র চোখে ছায়া পড়ে নিরবিচ্ছিন্ন অসহায়তার। সর্বজয়া হয়েও শুধুমাত্র নারী বলেই নিজের ভাগ্যের কাছে পরাজিত হয়ে এই লাঞ্ছনার পথচলা? পৈশাচিক অত্যাচারের কাছে হেরে যাওয়ার অন্ধকারময়তায় 'পরোয়া করিনা’-র বুলি তখন অবাঞ্ছিত দুঃসাহস। দুরাচারি, নরখাদকের থাবায় পিষ্ট তরতাজা প্রাণের উচ্ছ্বাস! কেন? উত্তর মেলেনা। মেলেনা দৃষ্টান্তমূলক শাস্তি, সুবিচার। প্রতিবাদীর হাতের দীপ্ত মশালও এক রাতে নিভে যায় বিষাক্ত ঝোড়ো হাওয়ার দুরাভিসন্ধীতে।

                  তবুও, হয়তো থাকে কিছু আলোর পথ। নানান ফাঁদে গুলিয়ে দেওয়া আইনকানুনের ভুলভুলাইয়ার অন্ধ অলিগলি বেয়ে হয়তো বা একবিন্দু অংশু পথ দেখায় শক্তিশালী প্রতিবাদের, শপথ জারি থাকে দোষীদের কঠোরতম শাস্তির।

                    যে আলোর ইমারত সর্পিল পথের নিস্তব্ধতার কাছে এ শহরের তিল তিল করে গড়ে ওঠা ঐতিহ্যের ও গরিমার গল্প করতো, আজ সে বা তারা আঁধারে মুখ ঢাকে। তাদের দলিত করে শত সহস্র মানুষের পদযাত্রা এগিয়ে যায় আলোর অভিমুখে। শ্লোগানের ধ্বনি আর্তনাদ হয়ে শহরের বুক খানখান করে তোলে। ধিক্কার জাগে প্রলোভনে, প্ররোচনায়,অসত্যে, নিষ্ঠুরতায়। নীরবে বিচার চায় শহরের প্রতিটি ধূলিকণা। হারিয়ে যাওয়া দশভূজাদের অশ্রুজলের সঙ্গে আপামর নারীর ক্রোধাক্ত স্লোগান যেন অপেক্ষা করে ত্রিনয়নের দৈবিক দিব্যতার।

No comments:

Post a Comment