কলকাতা তিলোত্তম শহরের জীবন বড্ড উত্তাল
বটু কৃষ্ণ হালদার
এত দিন জানতাম পশ্চিম বঙ্গ কাঠমানি,শিক্ষা দুর্নীতি, কয়লা গরুর রেশন চুরি, সন্ত্রাসবাদী, বোমাবাজি, অযো গ্য অশিক্ষিত নেতাদের আখড়া। সেই খবর ছাড়িয়ে এবার সংবাদমাধ্যমের শিরোনামে উঠে এলো আরজি কর হাসপাতালে ধর্ষণ কান্ড। ঘুমের মধ্যে এক তরুণী চিকিৎসকের উপর শারীরিক নির্যাতনের পর চালানো হলো হাড় হিম করা পাশবিক অত্যাচার। ভেঙে ফেলা হয় গলার হাড়,দুই চোখ দিয়ে ঝরে পড়ছে সারা শরীর জুড়ে রয়েছে ক্ষতের চিহ্ন,যৌনাঙ্গ ক্ষতবিক্ষত,ঝরছে তাজা তাজা রক্ত। হাসপাতালে তরুনী চিকিৎসকের উপর যে ধরনের ঘটনা ঘটেছে তা দিল্লির নির্ভয়া কান্ডের ছায়া পরিষ্কার। এখন প্রশ্ন কোন সভ্য সমাজের মানুষ দ্বারা এমন নৃশংসতা ঘটানো সম্ভব?যে এমন কান্ড ঘটিয়েছে সেই অপরাধীর বেঁচে থাকার কি কোন অধিকার আছে?
২০১২ সালে ভারতবর্ষের রাজধানী দিল্লির বুকে চলন্ত বাসের মধ্যে কলেজ পড়ুয়া তরুণীকে ধর্ষণ করার পর নির্মমভাবে হত্যা করে চলন্ত বাস থেকে ছুঁড়ে ফেলে ফেলে দিয়েছিল সভ্য সমাজের বুকে এক শ্রেনীর রক্তচোষা হায়নারা দল।যে মর্মান্তিক হৃদয়বিদারক ঘটনায় অপরাধীদের ফাঁসির দাবিতে রাস্তায় নেমে এসেছিল সমগ্র ভারতবর্ষের জনগণ। ভারতবর্ষে জুড়ে মোমবাতির মিছিল নিয়ে প্রতিবাদ শুরু হয়েছিল।দফায় দফায় আন্দোলনের ফলে প্রায় দীর্ঘ সাত বছর পর অপরাধীদের ফাঁসি দেওয়া হয়। তাতেও নারীদের উপর শারীরিক ও পাশবিক অত্যাচারের সংখ্যা কমেনি বরং বেড়েছে। ২০১২ সালে নির্ভয়া ধর্ষণ ও ভয়াবহ হত্যাকাণ্ড ঘটনার পুনরাবৃত্তি হল কলকাতার আরজিকর হাসপাতালে। এক্ষেত্রে অভিযুক্ত হলেন আইনের রক্ষাকারী হিসাবে পরিচিত এক সিভিক ভলেন্টিয়ার। এক্ষেত্রে স্বাভাবিকভাবে প্রশ্ন আসে আইনের রক্ষাকারী যদি রক্ষক হয়ে ওঠে তাহলে সাধারণ নিরীহ জনগণ কোথায় আশ্রয় নেবে?কথায় আছে বন্যেরা বনে সুন্দর/শিশুরা মাতৃক্রড়ে।ঠিক তেমন ভাবে জনগণের সুরক্ষার দায়িত্ব আইন রক্ষাকারীদের হাতে। কিন্তু আইনের রক্ষাকারী ভক্ষকের ভূমিকায় অবতীর্ণ। দিনে দিনে কোথায় নামছে আমাদের সমাজব্যবস্থা?
ডাক্তার হলো ভগবানের এক রূপ। দেশের লক্ষ কোটি জনগণ ডাক্তারের ছোঁয়ায় দুরারোগ্য ব্যাধি থেকে নতুন জীবন লাভ করে। অথচ শিক্ষা, দীক্ষা,সভ্য সাংস্কৃতির মিলনস্থল তিলোত্তমানগরী কলকাতার বুকে আরজিকর হাসপাতালে তরুণী চিকিৎসকের উপর শারীরিক ও পাশবিক অত্যাচারে সমাজের বুকে পুনরায় হাজার প্রশ্ন ছুড়ে দিয়ে গেল?
আমাদের দেশের আইন ব্যবস্থা নমনীয় ও ভঙ্গুর তা বারবার প্রমাণ হয়ে যাচ্ছে। আমাদের দেশের আইন ব্যবস্থা জঘন্যতম অপরাধীদের মনে এতোটুকু ভয় ধরাতে পারেনি। কারণ এই দেশের আইন ব্যবস্থা বড় লোকদের কাছে যেমন খোলা আকাশ, তেমনি গরিবদের কাছে মাকড়সার জাল। জঘন্যতম অপরাধ ও ধর্ষণের মতো অমানবিক ঘটনা ঘটিয়েও রাজনৈতিক প্রভাবশালী নেতা-নেত্রীদের প্রশ্রয়ে বেড়ে ওঠা হায়নারা টাকার জোরে ছাড়া পেয়ে যায়। আর মাকড়সার যাঁতা কলে পিষে মরতে হয় ধনঞ্জয়দের মত নিরীহ,গরিব অপরাধীদের। যাবজ্জীবন জেল খাটার পরেও ধর্ষণে অভিযুক্ত ধনঞ্জয় চট্টোপাধ্যায়ের ফাঁসি হয়ে যাওয়ার ঘটনা বিশ্বের সংবিধানে বিরল ঘটনা।এক্ষেত্রে আরো প্রমাণ হয়ে যায় আমাদের দেশের আইন ব্যবস্থা একদিকে যেমন বজ্র আঁটুনি, তেমন অপরদিকে ফোসকা গেরোর মত।
পশ্চিমবাংলার হতদরিদ্র অসহায় জনগণের কাছে সরকারি হাসপাতাল হল লাইফ লাইন অন্যদিকে আতঙ্কের এক নাম। দ্রব্যমূল্য বৃদ্ধির পরম পর্যায়ে সাধারণ জনগণকে বাধ্য হয়ে সরকারি হাসপাতালে যেতে হয় চিকিৎসা করানোর জন্য। সরকারি হাসপাতাল মানে ফ্রিতে পরিষেবা।নেতা-মন্ত্রীদের ইশারায় দালাল চক্রের আধিপত্যে টিকিটের লাইন থেকে শুরু করে রোগী দেখানো,ওষুধ নেওয়া,বেড পাওয়া এমন কি অপারেশন হওয়া পর্যন্ত হাজার হাজার টাকার খেলা চলে। শিক্ষা ক্ষেত্রে যেমন টাকা দাও আর চাকরি নাও, ঠিক তেমনি সরকারি হাসপাতালে টাকা দাও আর লাইন ছাড়াই ডাক্তার দেখাও এমন নীতিতে বিশ্বাসী হয়ে উঠেছে। প্রতিবাদ করবেন কাকে? নিচতলা থেকে শুরু করে হাসপাতাল সুপার পর্যন্ত সবাই দুর্নীতির বেড়াজালে ডুবে আছে।তার উপর আছে নেতা,মন্ত্রীদের চোখ রাঙানো।যারা দালাল চক্রকে খুশি করতে পারেনা রোগী নিয়ে এ হাসপাতাল থেকে সে হাসপাতাল ও টেবিল থেকে এ টেবিল ঘুরতে ঘুরতে বহু রোগী এভাবে বিনা চিকিৎসা মারা যায়। সরকারি হাসপাতালগুলোকে সুপার মডেল তকমা দেওয়া হলেও কোন নেতা,মন্ত্রী কিংবা তাদের পরিবারের কাউকে দেখেছেন সরকারি হাসপাতালে চিকিৎসা করাতে? জনগণের টাকা লুটপাট করে বেসরকারি হাসপাতালে নিজেরা চিকিৎসা করান আর জনগণকে বলেন যমপুরি নামক সরকারি হাসপাতালে চিকিৎসা করাতে।
বিগত ১০-১৫ বছরের পরিসংখ্যানটা দেখলে বোঝা যায় পশ্চিমবাংলার বুকে প্রতিভাবান ছাত্র-ছাত্রীদের উপর অত্যাচারের সংখ্যা যেমন বেড়েছে। নির্ভয়া কাণ্ডের মতো হাজার হাজার তরুণী থেকে শুরু করে কলেজ পড়ুয়া স্বপ্নদ্বীপের মৃত্যু আমাদের বিবেকবান সমাজের ভিত কে নড়িয়ে দিতে পারেনি আজও। অথচ বলা হচ্ছে যুবসমাজ দেশের উজ্জল ভবিষ্যৎ। আগামীর কান্ডারী।যাদের চিন্তাধারায় দেশের পরিকাঠামো বদলাবে, দেশ উন্নত হবে এবং বিশ্বের কাছে দেশের উন্নত,উজ্জ্বল পরিকাঠামোর জন্য গর্ববোধ হবে।
স্বাধীনতার আন্দোলন থেকে শুরু অফিস ঘাট,কলকাচারি, জল, স্থল, অন্তরীক্ ষে এমনকি দেশের হয়ে পদক জেতা পর্যন্ত নারীদের অবদান একেবারেই অনস্বীকার্য। বিদ্রোহী কবি কাজী নজরুল ইসলাম লিখেছিলেন:_ বিশ্বে যা কিছু মহান সৃষ্টি চির কল্যাণকর/ অর্ধেক তার করিয়াছে নারী অর্ধেক তার নর। বর্তমানে যেভাবে সমাজের বুকে নারী ধর্ষণের ঘটনা বেড়ে চলেছে তাতে এ বাণী খাতা-কলমে সীমাবদ্ধ পড়েছে।যে নারী কুমারী রূপে পূজিত হয়, সেই নারী আজ প্রতি পদে পদে ধর্ষিত,লাঞ্ছিত,উপেক্ষিত অত্যাচারিত। আজ দুধের শিশু থেকে মাঝ বয়সী,এমনকি ষাটউর্ধ্ব নারী ও আজ বেয়াব্র। বর্তমান সময়ে দাঁড়িয়ে কেন্দ্রীয় ও রাজ্য সরকার নারীদের জন্য হাজার প্রকল্প তৈরি করেছে। কিন্তু নারী সুরক্ষার ব্যবস্থায় আজও কোনরকম সুদৃঢ় পদক্ষেপ গ্রহণ করতে পারেননি। পারবে কি করে? শুধু আইন ব্যবস্থায় নয় রাজনৈতিক ক্ষমতার অপব্যবহারকারীদের দ্বারা ও নারীরা লাঞ্ছিত,ধর্ষিত। যারা দেশের জনগণের সুরক্ষা ব্যবস্থার সঙ্গে যুক্ত তারা কিভাবে ভক্ষক হয়ে ওঠে? যেভাবে আমাদের ভারতবর্ষে ক্ষমতার অপব্যবহার হতে শুরু করেছে তাতে ভারতবর্ষের জনগণ যদি বাংলাদেশের মতো রাস্তায় নামতে বাধ্য হয় তাহলে সে আগুনের শিখায় হাজার হাজার অত্যাচারী, ক্ষমতাশীল প্রভাবশালী আইনের রক্ষাকারী হোক কিংবা রাজনৈতিক প্রভাবশালী নেতা-মন্ত্রী পুড়ে মরবে তা বলা বাহুল্য।মনে রাখবেন সব অত্যাচারের একটা শেষ সীমারেখা আছে। আর দেশের জনগণ যদি একবার রাস্তায় নেমে আসেন তাহলে কোন প্রধানমন্ত্রী,রাষ্ট্রপতি পুলিশি ব্যবস্থা একেবারেই অকেজ হয়ে যাবে। তার জ্বলন্ত নমুনা এই মুহূর্তে বাংলাদেশ।
আর জি করের ঘটনায় সমস্ত হাসপাতালগুলো জুড়ে ডাক্তাররা কর্মবিরতির ডাক দিয়েছে। তার প্রভাব হাসপাতালগুলোতে ডাক্তার দেখাতে যাওয়া অসহায় মানুষগুলোর উপর পড়বে তা বলা বাহুল্য। তবে তাদের প্রতিবাদ করাটাই স্বাভাবিক। রাজ্যের সমস্ত ডাক্তাররা একটা পরিবারের মত। আজকে একজন জুনিয়ার ডাক্তারের সঙ্গে এমন ঘটেছে আগামীকাল অন্য কারো সঙ্গে ঘটবে না তার নিশ্চয়তা কেউ দিতে পারবে কি? সেই সঙ্গে যারা এই মুহূর্তে ডাক্তারি পড়ার চিন্তাভাবনা নিয়েছেন তারাও কিন্তু আতঙ্কের মধ্যে রয়েছে? কোন পিতা-মাতা সন্তানদের জীবনের সঙ্গে আপোষ চাইবে না নিশ্চয়ই। আতঙ্কের কারণে যদি কেউ ডাক্তারি পড়তে না চায় তাহলে বুঝতে পারছেন কি অবস্থা হতে পারে? তাই কঠোর নিরাপত্তার বিষয়টা একেবারেই উড়িয়ে দেওয়া যায় না। তাতেই হয়তো ফিরবে গণতান্ত্রিক সচল অবস্থা।
তবে এই ঘটনার একটা সুস্থ সমাধান হওয়া দরকার। এক্ষেত্রে অপরাধীদের কঠিনতম শাস্তি পাওয়াটা খুবই জরুরী।নইলে ডাক্তাররা যদি দীর্ঘদিন এভাবে কর্ম বিরতির ডাক দিয়ে থাকেন তাহলে সমাজ কিন্তু উল্টো পথে হাঁটবে,সেই সঙ্গে কলকাতা লাশের নগরীতে পরিনত হবে। দোষীদের কঠিন শাস্তি হোক,এমনটা আমরা সবাই চাই। তবে শুধু আরজিকরের ঘটনায় অপরাধীদের শাস্তি দিলেই সমাজ ধর্ষণমুক্ত হবে এমনটা নয়। কারণ আমাদের সমাজের আনাচে-কানাচে এমন বহু ধর্ষক ঘুরে বেড়াচ্ছে তাদের চিহ্নিত করা খুবই প্রয়োজন।এক্ষেত্রে মনে রাখা দরকার নির্ভয়া কান্ডে দোষীদের ফাঁসি হওয়া সত্ত্বেও ধর্ষণের সংখ্যা বেড়েছে।
No comments:
Post a Comment