প্রিয় শহর এই জীবন
জয়তী ব্যানার্জী
" এই শহর জানে আমার
প্রথম সবকিছু ,
পালাতে চাই যত ,
সে আসে আমার পিছু পিছু".....
প্রিয় ভাষিনী শৈল রানী; আমার তোমার সকলের প্রিয় শহর দার্জিলিং। তিব্বতি ভাষায় যার নাম ডোরজে লিং অর্থাৎ দর্জি কথার অর্থ হলো থান্ডার বোল্ড এবং লিঙ্ শব্দের অর্থে ভূমি .....যা কিনা বজ্রপাতের দেশ। ১৮৩৫ সালে ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানি দ্বারা সংযুক্ত করা হয়েছিল ।তার আগে দার্জিলিং সিকিমের একটা অংশ ছিল এবং নেপালের সাথে একটা সংক্ষিপ্ত সময়ের জন্য গঠিত হয়েছিল বন্ধন।
এ তো হল দার্জিলিং এর বুৎপত্তিগত অর্থ। মৌনি শৃঙ্গ ধবলগিরি হিমালয়ের সাথে যে এক পরমাত্মিক সংযোগ গড়ে উঠেছিল সেই ছোটবেলা থেকেই।
এই শহরটি ৬৭১০ ফুট উচ্চতায় অবস্থিত। বার্ষিক সর্বোচ্চ তাপমাত্রা ১৪.৯ ডিগ্রি সেন্টিগ্রেড এবং সর্বনিম্ন ৪.১° সেন্টি গ্রেড, বৃষ্টিপাত ৩০৯২ মিলিমিটার। মার্চ মাস থেকে জুন মাসের মাঝামাঝি এবং অক্টোবর থেকে ডিসেম্বর শৈল রানী নব বধুর সাজে অপেক্ষমান থাকে বরমাল্য যথাস্থানে নিবেদনের জন্য।
" যে শহরটি সমস্ত মানুষ দেখতে চায় , যাকে একবার এক ঝলক দেখেও সেই আভাস পৃথিবীর বাকি অংশের মধ্যে প্রতিফলিত হয়, সে যে রয়েছে চির শান্তিতে হিমালয়ের কোলে।"
মার্ক টোয়েনের এই অনুভূতি এমন, যে ....কেউ তার জীবনে একবার দার্জিলিং গেলে, তার রূপ রহস্য আত্মগত করলে ,নতুন রস আস্বাদন করতে পারবে। অনন্ত আকাশের ওপর চকচকে মাউন্ট কাঞ্চনজঙ্ঘার পর্বতমালা---- যাকে বলা হয় পাহাড়ের রানী ,যারা প্রকৃতির সাথে সামঞ্জস্যপূর্ণ হতে চাই তাদের জন্য তৈরি হয় অসাধারণ এক তোরণ। প্রকৃতি যেন রূপের ডালি নিয়ে বসে আছে। সারা বিশ্বজুড়ে সমাদৃতদের দ্বারা শ্রদ্ধেয় দার্জিলিং চায়ের গন্ধযুক্ত স্বাদের দেশ এটি। এটি যে বিশ্ব ঐতিহ্যে মহান। আবার দার্জিলিং- হিমালয়ান রেলওয়ের সদর দপ্তর ,যেখানে শতাব্দী পুরনো ক্ষুদ্রাকৃতির বাষ্পীয় ইঞ্জিন এখনও দ্রুত অদৃশ্য হয়ে যাওয়া ল্যান্ড রোভারদের সাথে ছুটে চলেছে মহাকাশে পাড়ি দেওয়ার জন্য। বারবার যেন মন ছুটে যেতে চায় ওই কু ঝিকঝিক কু ঝিকঝিক শব্দের দেশে। পাহাড় জুড়ে লাল, গোলাপি ,সাদা রড ড্রেনড্রন আর ম্যাগনোলিয়া গাছের অপূর্ব মেলবন্ধন। শহর জুড়ে ছড়িয়ে আছে 'বুদ্ধং শরণং গচ্ছামি'-র লাল সাদা হলুদ সবুজ পতাকা যা কিনা এই অসহিষ্ণু পৃথিবীতে জানান দিচ্ছে ___
"বরিষ ধরা মাঝে
শান্তির বারি"
এই হল আমার তোমার সকলের দার্জিলিং। যেখানে এখনো নেই পাশবিক নারকীয়তা; যেখানে বোনেদের পূর্ণ সম্মান রক্ষার্থে ভাইরা ,দাদারা সবসময় সদা ব্যস্ত; নেই কোন ইভটিজিং এর কলুষতা।
বিশ্বকবি রবীন্দ্রনাথ তার কাব্যিক অনুভূতির সাথে এর অপরূপ সৌন্দর্য বর্ণনা করেছেন
" ফুলের বাগানের
ঠান্ডা শীতল সমীরনে
সূর্য প্রায় সারাদিনই
আমাদের সাথে
করে লুকোচুরি"...
১৮৩৯ সালে ক্যাম্পবেল সাহেব তার স্বপ্নকে ত্বরান্বিত করতে এসে পৌঁছেছিলেন এই চা বাগিচায় ।সেই থেকেই এর বিস্তার। এবার আসি, আমার জীবনসঙ্গী দার্জিলিং কে নিয়ে কিছু কথায়। জলপাইগুড়ি রাষ্ট্রীয় বালিকা বিদ্যালয় থেকে উচ্চ মাধ্যমিক পাশ করার পর স্নাতক বিভাগের ডিগ্রী লাভ করার অভিপ্রায়ে আমার দার্জিলিং এর সাথে সখ্যতা, সেই কবেকার কথা ----১৯৯১... প্রথম দর্শনেই শহরটাকে যেন ভীষণ আপন করে নিয়েছিলাম ।দার্জিলিং সরকারি মহাবিদ্যালয়----সে যেন এক অপূর্ব কলেবর সমৃদ্ধ সরকারী মহাবিদ্যালয়। মফ:স্বল শহরের মেয়ে আমি, বাড়ির চার দেওয়ালের মধ্যেই আমার বেড়ে ওঠা। দামাল পাগলাঝোড়ার অশনি সংকেত; তিনধরিয়ার ছোট্ট রেল ঘুমটি পার হয়ে আমাদের বাস যখন ক্রমশ এগোচ্ছে হিমালয়ের শীর্ষে উঠবার জন্য --আমার মনও কেমন যেন এক ভয় মিশ্রিত আনন্দে অবগাহন করতে চলেছে ।বারবার মনে হয় গানটা গেয়ে উঠতে মন চাইছিল-----
টাইগার হিল থেকে
সূর্য ওঠা.....
সেই ঘুমের দেশ পার করে বাস এসে থামলো দার্জিলিং বাসস্ট্যান্ডে। কলেজে ঢোকার মুখেই যেন একটু হোঁচট খেয়েছিলাম। প্রথমেই মনে হয়েছিল পাশ্চাত্যের অনুকরণ আর অনুরণনটা হয়তোবা একটু বেশি ই। আরও চমক অপেক্ষা করছিল আমার জন্য। ব্রিটিশদের তৈরি লাল রঙের বিশাল বাড়ীটি ধাপে ধাপে ওপরে উঠে গিয়েছে ।প্রচুর তার শাখা-প্রশাখা ;কাঠের সিঁড়ি পাহাড়ের ঢাল দিয়ে গুটি গুটি পায়ে এসে পৌঁছলাম ভূগোল বিভাগে--- সেখানে নাম নথিভুক্ত করার পর শুরু হল আস্তানা খোঁজার পালা। দার্জিলিং সরকারি মহাবিদ্যালয়ের তিনটি আবাসিক হোস্টেল, যার একটিতে আমার ঠাঁই হল ।তার নাম স্নো ভিউ। আরেকটি ক্যাসেলটন ---সেটা আবার রবীন্দ্রনাথের বাড়ি। কলেজের দলিলে হস্তান্তরের সময় গুরুদেবের সই নাকি সেখানে আছে। মেঘমেদুর পরিবেশে মনটা যেন উড়ে গেল সেই শিলং পাহাড়ে 'লাবণ্য'র দেশে____ এরা যেন দুই সহোদরা। ডিপার্টমেন্টের পাশে চা আর গোলাপ গাছের সংমিশ্রণে গজিয়ে ওঠা ঝকঝকে ক্যামেলিয়া ;রবি কবি কি একে দেখেই লিখেছিলেন, "নাম তার ক্যামেলিয়া"...
দুর্বল পাক যন্ত্রের পরিবর্তনের জন্য ক্যাসেলটনের বসবাসের শেষ দিনে গুরুদেবকে দেওয়া তনুকার এই সেই ছোট্ট উপহার____
"একটা জিনিস দেবো
আপনাকে ,
যাতে মনে থাকবে
আমাদের কথা..... একটি
ফুলের গাছ ।
.............
দামি দুর্লভ গাছ,
এদেশের মাটিতে অনেক যত্নে বাঁচে,
সে বললে ;
নাম তার ক্যামেলিয়া।"
তারপর শুরু হল আমার নতুন জীবন ।আমার নতুন পরিচয় দার্জিলিং সরকারি মহাবিদ্যালয়ের আবাসিকা। পাশ্চাত্যের অনুকরণে আবৃতা শহরটিকে নিজের করে নিতে বেশ কিছু সময় লেগেছিল জানো, কিন্তু কখন যে ওদের সাথে একাত্ম হয়ে গিয়েছিলাম জানি না। হোস্টেলে পাহাড়িয়া দের সংখ্যাই ছিল বেশি কিন্তু কখনোই তা মনে হতো না। আস্তে আস্তে আপদে বিপদে ওরাই হয়ে গেল নিজের লোক ।আজও কিন্তু সকলের সাথে না হোক অনেকের সাথেই রয়েছে নাড়ির টান। এ বন্ধন অমর অটুট ।পাহাড়িয়া রা জানে কিভাবে বিদেশিনীদের কাছে টেনে নিতে হয়। বিজ্ঞানী জগদীশচন্দ্র বোস তার রায় ভিলাতে অনেক বিদগ্ধ লোককে করেছিলেন আপ্যায়িত। তার বৈজ্ঞানিক গবেষণার জন্য বানিয়েছিলেন রিসার্চ সেন্টার। আবার চিত্তরঞ্জন দাসের সুন্দর বাড়িটি অনেক ইতিহাসের সাক্ষ্য বহন করে। রায় ভিলাতে ভগিনী নিবেদিতা আজও ঘুমিয়ে আছে শান্তিতে নীরবে ।পাহাড়ের আরেক প্রান্তে ক্যাসেলটনের কাঠের ঘরের কাঁচের জানালায় বসে রবীন্দ্রনাথ গাইছেন----
" তোমারও অসীমে প্রান মন লয়ে,
যত দূরেই আমি ধাই ই"....
সিঙ্গালীলা পর্বতের প্রতিটি খাঁজে খাঁজে তা বোধহয় জানান দিয়ে যাচ্ছে। আবার পদ্মজা নাইডু পার্কের সেই সাইবেরিয়ান লেপার্ড টি ও বোধহয় আমাদের মতই বিদেশিনী। তাকেও তো শৈল রানী আপন করে নিয়েছে। সে তো আর ফিরে যায় না ,সে জানে----
" ছেঁড়া শিকড় পাবে কি আর
পুরনো তার মাটি"....
তাইতো আগুন্তক,
দার্জিলিং আমার অনেকটা ।এই শহর আমার প্রথম সবকিছু। জলপাইগুড়ি রাষ্ট্রীয় বালিকা বিদ্যালয় যদি আমার চলার পথের হাতে খড়ি হয় ;তবে দার্জিলিং সরকারি মহাবিদ্যালয় আমার পথ চলার পাথেয়..... ভালো থেকো শৈলশহর।
আর আমার আত্মজা কে তোমার মত দৃঢ় অথচ নমনীয় কমনীয় করে তুলো। সে যেন বজ্র দীপ্ত কন্ঠে উন্নত শিরে তোমার থেকে জীবনের রসদ সংগ্রহ করে যুগিয়ে নিতে পারে তার আগামীর দিন চলার পাথেয়।
ভালো থেকো।
No comments:
Post a Comment