Sunday, December 15, 2024


 


'অভিমানের তাপজ্বালা সঞ্চার করে চলে/ তুমি নিশ্চয়ই ব্যালেন্স, প্রিন্সিপাল বা ইন্টারেস্ট গুনছো...'
'ধৌত হচ্ছে মস্তিষ্ক/ দোদুল্যমান ভাগ্যশ্রী',
'দৈনন্দিন পলির ফর্দকে ফসিলে রূপান্তরিত করব',

বিস্মিত হচ্ছেন? ভাবছেন এমন কথা বলছেন কে? অবাক হবেন না। এগুলি নমুনা মাত্র।

এলিয়ট একবার বলেছিলেন, `Birth of a poetry is like the birth of a baby` কবিকে এই বেদনার মধ্যে দিয়েই যেতে হয়। তবে আজকাল এই `এত কবি কেন`-এর যুগে ক`জন সে যাত্রা করেন জানা নেই।

উদয় করেন। উদয় সাহা। প্রচারের আলো থেকে দূরে নিভৃতে নির্জনে তাঁর বাস। আর সেখান থেকেই উঠে আসে তাঁর বোধ, দর্শন ও সৃষ্টি।

মুজনাই সাহিত্য সংস্থা উদয় সাহার `ছাই ও ছায়ার পরবর্তী` শীর্ষক কাব্যগ্রন্থের প্রকাশক হতে পেরে গর্বিত।

মুজনাই অত্যন্ত আশাবাদী যে, মুজনাইয়ের পাঠক ও শুভানুধ্যায়ীরা মুজনাইয়ের এই প্রয়াসের সঙ্গে থাকবেন। নবীন কবির দ্বিতীয় কাব্যগ্রন্থকে নিজেদের করে নেবেন।

কোচবিহার বইমেলার পাশাপাশি অনলাইনেও থাকবে `ছাই ও ছায়ার পরবর্তী` হাতে পাওয়ার সুবিধে।   

Monday, December 9, 2024


 

পাঠ প্রতিক্রিয়া 

পদ্য

সম্পাদক: রিমি দে 

`সত্য ও সততা` নিয়ে রিমি দে সম্পাদিত `পদ্য`- এর উৎসব সংখ্যা ২০২৪  নিজস্ব দ্যুতিতে উজ্জ্বল। বিষ্ণু সামন্তের প্রচ্ছদে ছিমছাম মেদহীন পত্রিকাটি মূলত কবিতা ও কবিতা বিষয়ক।  প্রচ্ছদ ছবিতে রঙের ব্যবহারে শিল্পী তাঁর নিজস্ব মুন্সিয়ানার ছাপ রেখেছেন। ব্যাক কাভারে পদ্যের বিভিন্ন সংখ্যার প্রচ্ছদ ছবি রাখবার ভাবনাটিও অভিনব। বিস্মৃতপ্রায় সঞ্জয় ভট্টাচার্য্য, সত্যপ্রসন্ন দত্ত প্রমুখের উল্লেখে একটি শক্তিশালী সম্পাদকীয় লিখেছেন রিমি দে। এই অসত্য ও মিথ্যের সময়ে এইরকম সম্পাদকীয় দুবার ভাবায় বৈকি ! 

'কিছুটা সময়' পর্বে শুভংকর গুহ, বিজয় দে, প্রবাল কুমার বসু, তৃপ্তি সান্ত্রা, বিপুল দাস প্রমুখ ব্যক্তিত্বদের সঙ্গে কথা যথাক্রমে মানসী কবিরাজ, জয়শীলা গুহ বাগচী,, প্রিয়াঙ্কা চৌধুরী, নবনীতা সান্যাল, তপতি বাগচী। প্রতিটি সাক্ষাৎকারেই অত্যন্ত খোলামেলাভাবে কথা বলছেন এই লেখক-কবিরা। তাঁদের কথা পাঠে আগামী প্রজন্ম যেমন দিশা পাবে, তেমনি তাঁদের পাঠকেরাও প্রিয় লেখকদের সম্পর্কে জানতে পারবে। যেমন শুভংকর গুহ বলছেন, `মহৎ ও কালজয়ী সাহিত্য রচনা কখনোই বেষ্ট সিলিংয়ের তকমা অর্জন করে না। সেই সব রচনা ভাষা ইতিহাসের অংশীদার হয়ে ওঠে। যুগ যুগ ধরে পাঠক সেই সব গ্রন্থ বা রচনা সংগ্রহ পড়ে যান`। আবার বিপুল দাস মনে করেন, `জীবনের সত্যকে অনুসন্ধান করাই তো সাহিত্যের প্রধান লক্ষ্য। এই সত্যকে খুঁজতে গিয়ে লেখককে অবশ্যই ইতিহাস-সচেতন হতে হয়`। এইরকম টুকরো টুকরো কথার মধ্যে দিয়ে এই সৃষ্টিশীল মানুষদের মনন ও বীক্ষা খুঁজে পাই আমরা। সেদিক থেকে দেখতে গেলে `পদ্য`-এর এই সংখ্যাটি অভিনব। উল্টোদিকে এটাও ঠিক যে, প্রশ্নগুলি যথেষ্ট অনুশীলনের ফসল এবং সত্য ও সততা বিষয়ক। 

সত্য ও সততা সম্পর্কে তাঁদের নিজস্ব ধারণা মেলে ধরেছেন চৈতালি চট্টোপাধ্যায় থেকে কৌশিক জোয়ারদার সহ অনেকেই `সমীক্ষা` অংশে। ব্যক্তিগতভাবে অনেকের সঙ্গে আমার ধারণা না মিললেও, সমৃদ্ধ হয়েছি এই বিশিষ্টজনেদের মতামত জেনে। সম্ভবত এই অংশটি সম্পাদকের নিজস্ব উদ্ভাবন। ভাল লাগল চেনা বৃত্তের বাইরে তিনি অন্যরকম ভেবেছেন।

মহাত্মার সত্য, অনুভবের সত্য, সত্যজিতের সত্য, মাটির সত্য, সত্যর গল্প, সত্যি কথা, শিল্পের সত্য ইত্যাদি শিরোনামে সৈয়দ কওসর জামাল, চিত্তরঞ্জন হীরা, সুতপা সাহা, মৌকণা, কল্যাণী লাহিড়ী, সোমনাথ ঘোষাল, শবরী শর্মা রায়, সুবীর সরকার, শংকর চক্রবর্তী, বিতান চক্রবর্তী, সব্যসাচী মজুমদার, শ্যামলী সেনগুপ্ত, শ্রেয়সী গঙ্গোপাধ্যায় প্রমুখের সৃষ্টিগুলি নিজস্ব আলোতে ভাস্বর। প্রত্যেকেই নিজের সুনাম বজায় রেখেছেন। তবে `সত্য ও সত্যতা: পারাপারের খেয়ে ও কিছু পূর্বমুহূর্ত` ব্যক্তিগত পছন্দে খুব ভাল লেগেছে।  `ভাদু রূপেতে আলা/ গলেতে মালা/ জরি বসানো ভাদুর গামছা` অত্যন্ত তথ্যমূলক এবং জানবার আগ্রহ বাড়িয়ে তোলে। `সত্য ও সততা` লেখাটিতে লেখকের ব্যক্তিগত অভিজ্ঞতায় যাঁর কথা বলেছেন, সেরকম প্রণম্য মানুষদের আজ বড্ড অভাব। কোনও তত্ব কথা নেই, শব্দের মায়াজাল নেই, একই বিষয় ও গদ্যের একঘেয়েমি নেই এই লেখাটিতে। নিটোল একটি ছোট্ট লেখা।     

'সত্য নিয়ে কথাবার্তা' অংশে স্বপন রায় ও উমাপদ কর যে ফুল ফুটিয়েছেন তা বুঝতে গেলে রীতিমতো পড়াশোনা দরকার। আসলে পাঠককেও তো লেখাপড়া জানতে হয়। পাঠের অভ্যাস করতে হয়। যে মিথষ্ক্রিয়ামূলক বীক্ষণের সাক্ষ্য তাঁরা রেখেছেন তা সত্যিই অসামান্য। এইরকম আলোচনা আরও হওয়া দরকার। তাহলে আমার মতো সাধারণ পাঠকরা উপকৃত হবেন। কেননা বোধের একটি নির্দিষ্ট স্তরে না পৌঁছলে এরকম সুচিন্তিত কথাবার্তার ধরতাই সম্ভব নয়। 

অনুবাদ কবিতা সহ পরিচিত অপরিচিত, নামী অনামী বহু কবির কবিতা রয়েছে এই সংখ্যায়। আলাদা করে কারও নাম উল্লেখ করছি না। অধিকাংশ কবিতাই প্রত্যাশা পূরণ করে। তবে সম্পাদককে অনেক সময় সাহিত্যের স্বার্থে সত্যের মুখোমুখি হতে হয়। কঠোর হাতে অনেক লেখাকে প্রকাশের বাইরে রাখতে হয়। সেখানে ব্যক্তিগত সম্পর্ক দেখলে চলে না। কিছু কবিতার ক্ষেত্রে আমার মনে হয়েছে, সম্পাদককে অনুরোধের বা সুপারিশের ঢেঁকি গিলতে হয়েছে । 

একশো বারো পাতার শীর্ষকে কবিতা ৩ এবং ১৪৭ পাতার শীর্ষকেও কবিতা ৩ ছাপা হয়েছে। সম্পাদকের নজর এড়িয়ে গেছে এটি। সূচিতে অবশ্য ১৪৭ পাতায় কবিতা ৪ উল্লেখ আছে। একশো আটত্রিশ পাতার কবি মহুয়া  ও ১৫০ পাতার মহুয়া নামের কবি কি আলাদা? সেক্ষেত্রে আলাদা ব্যাপার। তবে যদি একই ব্যক্তি হন,  তাহলে দুটি কবিতা আলাদা আলাদা করে রাখার অর্থ বুঝলাম না। 

মুদ্রণ ভাল। কাগজও ঝকঝকে। ছাপার কিছু ভুল আছে। সামান্যই। সম্পাদকীয়তে যতিচিহ্নের পরে নতুন লাইন শুরু হওয়ার মুখে স্পেস না থাকাও বাঞ্ছনীয় ছিল না।তবে সুবিশাল কাজ করতে গেলে এরকম দু`একটা হয়ে থাকে। সেটা বড় ব্যাপার নয়। 

আসলে লিটিল ম্যাগাজিনের জন্য দরদ ও একনিষ্ঠতা থেকে `পদ্য` সম্পাদিত ও প্রকাশিত হয়। এই দুটি বিষয় থাকলে পত্রিকা ভাল হতে বাধ্য। রিমি দে সেই ব্যাপারটি নিয়মিত করে যাচ্ছেন। এখানেই সম্পাদক হিসেবে তাঁর সার্থকতা। সাফল্য? সেটা অবশ্য কী আজও বুঝিনি। 

আলোচনা: শৌভিক রায় 
   

Monday, December 2, 2024


 

মুনা 

অনলাইন অগ্রহায়ণ সংখ্যা ১৪৩১


সম্পাদকের কথা 

কবি বলেছেন, `অন্যায় যে করে আর অন্যায় যে সহে/ তব ঘৃণা যেন তারে তৃণসম দহে।` 

একটি রাষ্ট্রের একটি শিক্ষা প্রতিষ্ঠানের প্রবেশদ্বারে অন্য রাষ্ট্রের জাতীয় পতাকা মাড়িয়ে প্রবেশ করছেন সকলে। এই দৃশ্য আমাদের চমকে দেয়নি শুধু, আহত ও ক্রুদ্ধ করেছে। আমরা ভাবতে পারিনি এই দৃশ্য আমাদের দেখতে হবে। আরও ব্যথিত হয়েছি সেই রাষ্ট্রের শুভবুদ্ধিসম্পন্ন কেউ এর বিন্দুমাত্র প্রতিবাদ করলেন না। অন্তত আমরা করতে দেখিনি। তারা সকলে ভুলে গেছেন, যে রাষ্ট্রের জাতীয় পতাকার এই অবমাননা তারা করছেন, সেই রাষ্ট্রের সাহায্য ছাড়া গত শতকের সাতের দশকে তাদের স্বাধীনতা সম্ভব ছিল না। এর পাশাপাশি যেভাবে তারা হিংসার আশ্রয় নিয়ে মানবতাকে লঙ্ঘন করছেন, তাতে আমরা উদ্বিগ্ন। এই ঘটনার তীব্র প্রতিবাদ করছি। ধিক্কার জানাচ্ছি মৌলবাদী শক্তিকে। 


 মুনা 

অনলাইন অগ্রহায়ণ সংখ্যা ১৪৩১



রেজিস্ট্রেশন নম্বর- S0008775 OF 2019-2020

হসপিটাল রোড 

কোচবিহার 

৭৩৬১০১

ইমেল- mujnaisahityopotrika@gmail.com 

প্রকাশক- রীনা সাহা    

সম্পাদনা, প্রচ্ছদ, অলংকরণ ও বিন্যাস- শৌভিক রায়


এই সংখ্যায় আছেন যাঁরা 

গৌতমেন্দু নন্দী, পার্থ বন্দ্যোপাধ্যায়, শ্রাবণী সেনগুপ্ত,

জয়তী ব্যানার্জী, জনা বন্দ্যোপাধ্যায়, সঞ্জয় সাহা, 

সুদীপা ঘোষ, অনিতা নাগ, অলকানন্দা দে,

ঋতুপর্ণা ভট্টাচার্য, পূর্বা দাস, তাসনিম জারিন,

বিপ্লব তালুকদার, বটু কৃষ্ণ হালদার, শুভেন্দু নন্দী, 

অঙ্কিতা সেন, সূর্য্যদীপ্তা সরকার, মিষ্টু সরকার, 

আজিজুল সেখ, অশোক কুমার ঠাকুর, পরাগ মিত্র, 

প্রাণজি বসাক, দেবর্ষি সরকার, উৎপলেন্দু পাল,

প্রাণেশ পাল, শঙ্খনাদ আচার্য, অমিতাভ চক্রবর্ত্তী,

 চিত্রা পাল, মাথুর দাস, বেলা দে,

তন্ময় ধর, ফিরোজ আখতার, জুলি আখতারী,

পক্ষিরাজ, আশীষ  কুমার  বিশ্বাস,  পিন্টু কর্মকার, 

রবিনা সরকার, অর্পিতা গুহ মজুমদার, সঞ্জয় পাঠক,

শ্রাবণী সেন, রীতা মোদক, সৈকত দাম,

মহঃ সানোয়ার, কবিতা বণিক, প্রদীপ কুমার দে,

রীনা মজুমদার, সুনন্দ মন্ডল, শ্রুতি দত্ত রায়,

প্রতিভা পাল, কল্যানী মন্ডল, আকাশলীনা ঢোল,

পাপু মজুমদার, বাবুল মল্লিক, শঙ্কর জানা,

তিথি পাল সরকার, চিত্রাক্ষী রায়, হৃদান সরকার, অলিপ্রভা পাটোয়ারি


      মুনা 

অনলাইন অগ্রহায়ণ সংখ্যা ১৪৩১


 

প্রকাশক রীনা সাহার কলাম .... 

          এক একটা আস্ত "বিচার" গিলে নিচ্ছে এজলাস.... আপনার পোষমানা ট্রাম্প কার্ড। আমি দেখছি, মানুষ দেখছে , অজগররাও দেখছে।

অজগরদের গলাধঃকরণ পদ্ধতি আপনি রপ্ত করতে চাইলে মুশকিলে পড়ে যাবেন, এটা আপনি মানেন না। তাই যতটা গিলেছেন ততটা হজম হতে না হতেই পঞ্চবার্ষিকী গদি গিলে নেওয়ার ব্লু প্রিন্ট রেডি করতে থাকেন আপনি।  মন ভরলেও পেট ভরে না আপনার।

কই মাছের জিউ নিয়ে জন্মেছেন আপনি। তাই শ্বাসনালী আটকে বেঘোরে জান খোয়াবেন সে বান্দা আপনি নন ! আপনাকে কেটে, ধুয়ে, ভেজে, খেয়ে না ফেলা অবধি আপনি তাকিয়ে থাকেন রাঁধুনির মুখের দিকে। আর এটাই " শ্রী প্রকল্প " মোহিত ভোটারদের ভবিতব্য ।

আপনি ভাল করেই জানেন বিষদাঁত ভেঙে দেওয়া সাধারণ মানুষ ফোঁস করলেও যা, ছোবল মারলেও তা। কেননা মনসা মঙ্গলের আমল থেকে কালনাগিনীর একচেটিয়া পেটেন্ট আপনার দখলে। আর তাই ইভিএম ফুটো করবার কারিগরি দক্ষতায় আপনার কাছে AI-ML ও শিশু ।

আপনার স্বর্গরাজ্যে মাঝে মাঝে উলঙ্গ হয় তুচ্ছাতিতুচ্ছ কিছু ঘটনা। আপনাদের সাজানো চিতায় উপুড় হয়ে শুয়ে থাকতে থাকতে হঠাৎ করেই উঠে দাঁড়ায় কোনো মেয়ে। পুড়ে খাক হবার আগে কাঁধ উঁচিয়ে " শ্রাগ " করে... " নে ছেড়েই দিলাম তোদের। করেই দিলাম মাফ।"  ন্যাংটো পেছন দেখিয়ে বলে...
" হে রাস্ট্র , হে শাসক, হে বিচারক --- Just look at our bum. মাড়ায়ে খা। "
আঁটি থেকে শস্য দানা আলাদা করাকে "মাড়ানো" বলে। নবান্নের মরসুম। উৎসবের রানী আপনি। "মুঠ উৎসবে" মাতুন। ভরে নিন গোলা। হাতে আড়াই মুঠ, গোলায় কুইন্টাল কুইন্টাল... হাতির দাঁতের গল্প শোনান।

শীত আসছে। সংসার ক্লান্ত বিত্তবানদের রিইউনিয়ন, নতুন ভ্রমণ ট্রেন্ড। মধ্যবয়সীয় সংকট। উদ্বাহু রবীন্দ্র নেত্য... একঘেয়ে মুদ্রায় নষ্ট বাল্ব খোলা, ভাল বাল্ব লাগানো । স্টিফ্ কোমরের কান মলে পাক খাওয়ানো ।  কন্টেম্পোরারি, হিপ হপ, জ্যাজ, ব্যালের আদ্যশ্রাদ্ধ ।
অন্যদিকে শাসকীয় বিষ্টুদের রাত পার্টি ,  "আঙুর আঙুর চোখ/ নেশাতে লাল লাল...." 
কামার্ত হোটেল - রিসর্ট, রাত ফোয়ারা, টাকা ওড়া , টাকা ধরা । 

   জিলে লে জিলে লে... সাইক্লোরামা শীতার্ত রাত। পেটের দায়ে কিংবা স্বপ্ন পূরণে পথে থাকবে হাজার হাজার স্ত্রীলিঙ্গ। কনভয় হীন। সততার আস্তিনে লুকিয়ে রাখা নীচু তলার পুলিশ - সিভিকদের সামলে রাখবেন। কেননা শিখণ্ডীরা বিগড়ে গেলে স্বৈরাচারী গদির পতন এক চুটকি সময়ের অপেক্ষা মাত্র । ইতিহাস তো জানেই, আপনিও জানেন । চোখে সুরমা, তার ওপর ঠুলি ... তবুও বিন্দাস সিক্সার হাঁকাচ্ছেন ; ক্লিন বোল্ড করছেন মানুষকে । গরু - গাধার ঠুলির সঙ্গে গন্ডারের চামড়ার ঠুলির তফাৎ আছে বলেই " তুসি গ্রেট হো জাঁহাপনা " !!



 

 

যাঁর সংগীত সাগরের সলিলে আজও অবগাহন করি প্রাক্ জন্মশতবর্ষে তাঁর প্রতি শ্রদ্ধার্ঘ --- - - গৌতমেন্দু নন্দী





হ্যাঁ, তিনি "আলোর পথযাত্রী", আমাদের এক বিষ্ময়, গীতিকার,সুরকার, সংগীতজ্ঞ সলিল চৌধুরী।

গীত রচনা, সুর সংযোজন---সংগীতের প্রতিটি ক্ষেত্রে তিনি এক স্বতন্ত্র প্রতিভা। বাংলা বেসিক গান থেকে বাংলা ও হিন্দি চলচ্চিত্রের কম্পোজিশনে তিনি  দাপটে বিচরণ করে গেছেন। হয়তো তুলনা চলেনা, তবু বলছি রবীন্দ্রনাথ, নজরুল ইসলাম, রজনীকান্ত সেন, দ্বিজেন্দ্রলাল রায় -- এঁরা যেমন তাঁদের কথা ও সুরে বাংলা সংগীত জগতে স্বাতন্ত্র্য এনেছিলেন, তেমনি সলিল চৌধুরীও বাংলা সংগীত জগৎকে নিজস্ব ভাবনা ও অভিনবত্বে আলোকিত করেছেন। 

        সলিল চৌধুরী তাঁর কালজয়ী সংগীত সৃষ্টির মধ্য দিয়ে আমাদের মধ্যে বেঁচে থাকবেন। তাঁর গান আজকেও আমাদের উদ্বুদ্ধ করে, করে অনুপ্রাণিত।  কলকাতায় এবং মুম্বাই দুই জায়গাতেই  তিনি "ইয়ুথ কয়্যার" তৈরী করেছিলেন।  যেখানে গান  গাইবার জন্য নামীদামী সংগীত শিল্পীরা আগ্রহী 
হয়ে থাকতেন। সলিল চৌধুরীর আমন্ত্রণ একবার পেলেই তাঁরা সেই "কয়্যার"এই আগে সবাই ছুটে যেতেন। তাঁর সুরে বাংলা বেসিক গান থেকে বাংলা ও হিন্দি চলচ্চিত্রে গান গাইতে সমস্ত নামী শিল্পীরা 
সেইসময় ব্যস্ত হয়ে পড়তেন। লতা মঙ্গেশকর থেকে হেমন্ত মুখোপাধ্যায় সলিল 
চৌধুরীর কম্পোজিশনে কতো কালজয়ী গান গেয়েছেন। বাংলা সংগীত জগতে সেই গানগুলো 
চিরকালীন সম্পদ। 

     লতা মঙ্গেশকরের কন্ঠে সেইসব গান---- "যা রে য়ারে উড়ে পাখি যা রে, " সাত ভাই চম্পা 
জাগো রে.." " কেন কিছু কথা বলোনা.." , " ও মোর ময়না গো----এই বেসিক গানগুলো আমাদের বাংলা গানের চিরকালীন সম্পদ।  আর হেমন্ত মুখোপাধ্যায়ের কন্ঠে "গাঁয়ের বধূ", "পাল্কির গান" "রানার"---আজও এক ইতিহাস ! 

        আমরা ভুলতে পারি না "মর্জিনা আবদুল্লা" ,"কবিতা"র মতো আরও বেশকিছু চলচ্চিত্রের গান।সহজ কথা,সহজ সুরে ভারতীয় রাগ-রাগিনীর ওপর সযত্নে সাজানো তাঁর সৃষ্টি যেন এক একটা মণিমুক্তো। প্রাচ্য আর পাশ্চাত্যের এক অসাধারণ  মেলবন্ধন তিনি তাঁর সংগীতে ঘটিয়েছেন। সংগীত নিয়ে তাঁর মতো এতো এক্সপারিমেন্ট খুব কম মিউজিশিয়ানই করে গেছেন। তাঁর গণসংগীত রচনা করার হাতেখড়ি গণনাট্য সংঘ গড়ে ওঠার অনেক আগেই হয়েছিল---তিনি নিজে বলেছেন। "আইপিটিএ"তে তিনি আসার অনেক আগেই অনেক গান তৈরি করেছিলেন।

     তাঁর কলেজ জীবনে বেআইনি ঘোষিত কমিউনিস্ট পার্টির সঙ্গে তাঁর যোগাযোগ থাকার জন্য তাঁকে সেই সময় ব্রাত্য করে রাখা হয়েছিল। সেইসময় শুধু গান নয়, কলেজে কম্পিটিশনে চুটিয়ে বাঁশী, এসরাজও বাজিয়েছেন। যৌবনে গণনাট্য সংঘের সঙ্গে যোগাযোগের কারণে তিনি শ্রমিক আন্দোলনেও সামিল হয়েছিলেন। গণনাট্যে পাশ্চাত্য সংগীতের মডার্ন টেকনিক আনার অপরাধে তাঁকে একসময় গণনাট্য সংঘ থেকেও ব্রাত্য করে রাখা হয়েছিল। 

      শিল্প আর শিল্পীর উপর জারি হওয়া "অতি বাম মনোভাব" এর শিকার তিনি হয়েছিলেন এবং সেই 
ফতোয়া থেকে তিনি মুক্তি পেতেও মরিয়া হয়ে উঠেছিলেন। তিনি  মুম্বাই চলচ্চিত্র জগতের সঙ্গে যুক্ত হলেও সেখানেও তাঁকে "একঘরে" করে রাখার চক্রান্ত শুরু হয়েছিল। এই বাংলার এক বিখ্যাত কবিও  তাঁকে বলেছিলেন আমেরিকার দালাল। দুঃখ, হতাশা, অপমান নিয়েই তিনি মুম্বাই পাড়ি দিয়েছিলেন। তবুও"বিশ্বাসঘাতক", "পলাতক" বিশেষনে তাঁকে ভূষিত করা হয়েছিল। এতো সম্মান, খ্যাতি নিয়েও শেষের দিকে খুব  স্বাভাবিকভাবেই একাকিত্ব গ্রাস করেছিল তাঁকে।

        তাঁর মৃত্যুর প্রায় তিরিশ বছর বাদে আজ তাঁর মূল্যায়ন হচ্ছে। তিনি নিজে কোথায় যেন বলেছিলেন " বেঁচে থাকতে আমাকে কেউ তেমনভাবে চিনতে পারল না, একশো বছর পর বাঙালিরা বুঝতে পারবে...." ঠিক তাই! আজ তাঁর "পথে এবার নামো সাথী, পথেই হবে এ পথ চেনা..." নতুন করে আমাদের  পথ দেখাচ্ছে। তাইতো "আর,জি,কর" কান্ডের জন মিছিলে তাঁর এই গানকে মননে,চেতনে প্রতিবাদের  বীজমন্ত্র করে পথে হাঁটলো শতসহস্র তরুণ প্রজন্ম।

    অনিন্দ্য চট্টোপাধ্যায়ের উদ্ধৃতি দিয়েই বলি, " শুধু এখানেই হয়তো শেষ নয়, আলোর পথযাত্রীরা
 আরও পথ হাঁটবেন,গান গাইবেন। "আর কবে,আর  কবে,আর কবে"-র কোরাসে গলা মেলাবে সব বিক্ষুব্ধ  মন...."----সলিল চৌধুরীর স্বরলিপির খাতা থেকেই যেন উঠে আসা সেই কথা ও সুর! যা উদ্বুদ্ধ ও উৎসাহিত করবে পরের পর প্রজন্মকে। সেখানেই  সার্থক সলিল চৌধুরী ও তাঁর সৃষ্টি। 

(* স্কেচ- লেখক) 


 

রূপচাঁদ পক্ষী : কবি শক্তি চট্টোপাধ্যায়
পার্থ বন্দ্যোপাধ্যায় 

"যেখানেই থাকো,এপথে আসতেই হবে
ছাড়ান নেই
সম্বল বলতে সেই দিন কয়েকের গল্প
অল্প অল্পই। 

আমি যাই, তোমরা পরে এসো
ঘড়ি ঘন্টা মিলিয়ে শাক সবজি বিলিয়ে 
তোমরা এস। "

এক অসাধারণ জীবনবোধের কবি ছিলেন কবি শক্তি চট্টোপাধ্যায়।জীবনানন্দ-পরবর্তীকালের 
 আধুনিক বাংলা সাহিত্যের জগতে যে কজন কবি বা সাহিত্যিক নিজের স্বতন্ত্র বোধে উজ্জ্বল তিনি তাঁদের অন্যতম এবং বাংলা সাহিত্য সেবায় নিয়োজিত একজন প্রধান ঋত্বিক। আমাদের মনের মানুষ,প্রাণের কবি
শক্তি চট্টোপাধ্যায়২৫ শে নভেম্বর, ১৯৩৩ সাল জন্মগ্রহণ করেন।  তিনি ছিলেন একজন বাঙালী কবি, ঔপন্যাসিক, লেখক ও অনুবাদক, যিনি জীবনানন্দ-উত্তর যুগের আধুনিক বাংলা সাহিত্যের একজন প্রধান কবি হিসেবে বিবেচিত। বিংশ শতাব্দীর শেষ ভাগে তিনি বিশেষভাবে পরিচিত এবং আলোচিত ছিলেন। ষাটের দশকে যে চারজন কবিকে হাংরি আন্দোলনের জনক মনে করা হয় তাদের মধ্যে শক্তি চট্টোপাধ্যায় অন্যতম।

১৯৮২ সালে প্রকাশিত তাঁর "যেতে পারি কিন্তু কেন যাবো ?" কাব্যগ্রন্থ ইংরেজি এবং মৈথিলী ভাষায় অনূদিত হয়েছে। ১৯৭৪ সালে তিনি পূর্ণেন্দু পত্রী পরিচালিত 'ছেঁড়া তমসুখ' চলচ্চিত্রে অভিনয় করেন। শক্তি চট্টোপাধ্যায় দক্ষিণ
 চব্বিশ পরগণা জেলার জয়নগরে জন্মগ্রহণ করেন। তাঁর মা কমলা দেবী এবং বাবা বামানাথ চট্টোপাধ্যায়, যিনি কলকাতার দ্য কাশিমবাজার স্কুল অব ড্রামায় পড়তেন। চার বছর বয়সে শক্তির বাবা মারা যান এবং পিতামহ তাঁর দেখাশোনা শুরু করেন। ১৯৪৮ সালে শক্তি কলকাতার বাগবাজারে আসেন এবং মহারাজা কাশিম বাজার পলিটেকনিক বিদ্যালয়ে চতুর্থ শ্রেণিতে ভর্তি হন। সেখানে তিনি বিদ্যালয়ের এক শিক্ষকের কাছে মার্কসবাদের পরিচিতি লাভ করেন।  ১৯৪৯ সালে তিনি প্রগতি লাইব্রেরি প্রতিষ্ঠা করেন এবং "প্রগতি" নামে একটি হাতে-লেখা পত্রিকা প্রকাশ করতে শুরু করেন, যা খুব শীঘ্রই পরবর্তীতে মুদ্রিত রূপ নেয় এবং পুনরায় নাম বদলে "বহ্নিশিখা" রাখা হয়।১৯৫১ সালে তিনি ম্যাট্রিকুলেশন পরীক্ষায় উত্তীর্ণ হন এবং সিটি কলেজে ভর্তি হন তার এক মামার কাছে, যিনি ছিলেন একজন ব্যবসায়ী এবং তখনকার অভিভাবক, যিনি শক্তির হিসাবরক্ষকের চাকরি পাইয়ে দেওয়ার প্রতিশ্রুতি দেন।  ১৯৫৩ সালে তিনি আই কম (বাণিজ্য) পরীক্ষায় উত্তীর্ণ হন। যদিও তিনি বাণিজ্য বিভাগের পড়া ছেড়ে বাংলা সাহিত্যে স্নাতক হওয়ার জন্যে প্রেসিডেন্সি কলেজে ভর্তি হন, কিন্তু পরীক্ষায় বসেন নি।১৯৫৬ সালে শক্তিকে তাঁর মামার বাড়ি ছেড়ে আসতে হয়েছিল এবং তিনি তাঁর মা 
ও ভাইয়ের সঙ্গে উল্টোডাঙ্গায় একটি বস্তিতে চলে যান। সে সময়ে তিনি সম্পূর্ণরূপে তাঁর ভাইয়ের স্বল্প আয়ের ওপর নির্ভরশীল ছিলেন।  দারিদ্রের কারণে শক্তি স্নাতক পাঠ অর্ধসমাপ্ত রেখে প্রেসিডেন্সি কলেজ ত্যাগ করেন এবং সাহিত্যকে জীবিকা করার উদ্দেশ্যে উপন্যাস লেখা আরম্ভ করেন। শক্তি চট্টোপাধ্যায় বিভিন্ন পেশায় নিয়োজিত থাকলেও কোনো পেশায় দীর্ঘস্থায়ী ছিলেন না। একসময় তিনি দোকানের সহকারী হিসেবে "সাক্সবি ফার্মা" লিমিটেডে কাজ করেছেন। এবং পরে ভবানীপুর টিউটোরিয়াল হোমে (হ্যারিসন রোড শাখায়) শিক্ষকতা করেন। ব্যবসা করার চেষ্টাও করেছিলেন এবং ব্যর্থ হওয়ার পর একটি মোটর কোম্পানিতে জুনিয়র এক্সিকিউটিভ হিসেবে যোগ দেন।  তিনি ১৯৭০ থেকে ১৯৯৪ সাল পর্যন্ত কলকাতার আনন্দবাজার পত্রিকায় কাজ করেছেন।

শক্তি চট্টোপাধ্যায় মীনাক্ষী চট্টোপাধ্যায়কে বিয়ে করেছিলেন, যিনি একজন লেখিকা। ১৯৬৫ সালে আড্ডার মধ্য দিয়ে তাদের প্রথম সাক্ষাত ঘটে। তাদের মেয়ে তিতি চট্টোপাধ্যায়।
মার্চ ১৯৫৬ সালে, শক্তির কবিতা "যম" বুদ্ধদেব বসু প্রকাশিত কবিতা সাহিত্য পত্রিকায় প্রকাশিত হয়। এরপর তিনি কৃত্তিবাস এবং অন্যান্য পত্রিকার জন্য লিখতে শুরু করেন।
 বুদ্ধদেব বসুও তাঁকে নব প্রতিষ্ঠিত যাদবপুর বিশ্ববিদ্যালয়ে তুলনামূলক সাহিত্য কোর্সে যোগ দিতে আমন্ত্রণ জানান। শক্তি কোর্সে যোগদান করলেও সম্পূর্ণ করেন নি। প্রথম উপন্যাস লেখেন কুয়োতলা। কিন্তু কলেজ - জীবনের বন্ধু সমীর রায়চৌধুরীর সঙ্গে তার বনাঞ্চল - কুটির চাইবাসায় আড়াই বছর থাকার সময়ে শক্তি চট্টোপাধ্যায় একজন সফল লিরিকাল কবিতে পরিণত হন। একই দিনে বেশ কয়েকটি কবিতা লিখে ফেলার অভ্যাস গড়ে ফেলেন তিনি।  শক্তি নিজের কবিতাকে বলতেন পদ্য। ভারবি প্রকাশনায় কাজ করার সূত্রে তাঁর শ্রেষ্ঠ কবিতার সিরিজ বের হয়। পঞ্চাশের দশকে কবিদের মুখপত্র কৃত্তিবাস পত্রিকার অন্যতম কবি হিসেবে প্রতিষ্ঠিত হন।  তাঁর প্রথম কাব্যগ্রন্থ 'হে প্রেম,
 হে নৈঃশব্দ' ১৯৬১ সালে প্রকাশিত হয় দেবকুমার বসুর চেষ্টায়। ১৯৬১ সালের নভেম্বরে ইশতেহার প্রকাশের মাধ্যমে  যে চারজন কবিকে হাংরি আন্দোলনের জনক মনে করা হয় তাদের মধ্যে শক্তি চট্টোপাধ্যায় অন্যতম। অন্য তিনজন হলেন সমীর রায়চৌধুরী, দেবী রায় এবং মলয় রায়চৌধুরী। শেষের তিনজনের সঙ্গে সাহিত্যিক মতান্তরের জন্য ১৯৬৩ সালে তিনি হাংরি আন্দোলন ত্যাগ করে কৃত্তিবাস গোষ্ঠীতে যোগ দেন। তিনি প্রায় ৫০টি হাংরি বুলেটিন প্রকাশ করেছিলেন। পরবর্তীকালে কৃত্তিবাসের কবি সুনীল গঙ্গোপাধ্যায় ও শক্তি চট্টোপাধ্যায়ের নাম সাহিত্যিক মহলে একত্রে উচ্চারিত হতো।  যদিও সুনীল গঙ্গোপাধ্যায় হাংরি আন্দোলনের ঘোর বিরোধী ছিলেন এবং কৃত্তিবাস পত্রিকায় ১৯৬৬ সালে সেই মনোভাব প্রকাশ করে সম্পাদকীয় লিখেছিলেন। তাঁর উল্লেখযোগ্য কাজগুলো হ'ল

"অবনী বাড়ি আছো" - কবিতা, কাব্যগ্রন্থ: ধর্মে আছো জিরাফেও আছো (১৯৬৫) ১৯৭৫ তিনি আনন্দ পুরস্কার লাভ করেন। ১৯৮২ সালে, তাঁর যেতে পারি কিন্তু কেন যাবো ? (১৯৮৩) কাব্যগ্রন্থের জন্য তিনি সাহিত্য অ্যাকাদেমি পুরস্কার লাভ করেন।  এছাড়া তিনি একাধিক পুরস্কার পেয়েছেন।

শক্তি চট্টোপাধ্যায়ের কাব্যগ্রন্থ 

এ প্রেম হে নৈঃশব্দ্য (১৯৬২),ধর্মে আছো জিরাফেও আছো (১৯৬৭),সোনার মাছি খুন করেছি (১৯৬৮),অন্ধকার নক্ষত্রবীথি তুমি অন্ধকার (১৯৬৮),হেমন্তের অরণ্যে আমি পোস্টম্যান (১৯৬৯),চতুর্দশপদী কবিতাবলী (১৯৭০),পাড়ের কাঁথা মাটির বাড়ি (১৯৭১),প্রভু নষ্ট হয়ে যাই (১৯৭২),সুখে আছি (১৯৭৪),ঈশ্বর থাকেন জলে (১৯৭৫),অস্ত্রের গৌরবহীন একা (১৯৭৫),জ্বলন্ত রুমাল (১৯৭৫),ছিন্নবিচ্ছিন্ন (১৯৭৫),সুন্দর এখানে একা নয়,(১৯৭৬),কবিতায় তুলো ওড়ে (১৯৭৬),ভাত নেই পাথর রয়েছে (১৯৭৯),আঙ্গুরী তোর হিরণ্য জল (১৯৮০),প্রচ্ছন্ন স্বদেশ (১৯৮১),যেতে পারি কিন্তু কেন যাবো (১৯৮৩),কক্সবাজারে সন্ধ্যা (১৯৮৫)
ও চির - প্রণম্য অগ্নি (১৯৮৫),মিষ্টি কথায়, বিষ্টিতে নয় (১৯৮৫),সন্ধ্যার সে শান্ত উপহার (১৯৮৬),এই তো মর্মর মূর্তি (১৯৮৭),বিষের মধ্যে সমস্ত শোক (১৯৮৮),আমাকে জাগাও (১৯৮৯)
ছবি আঁকে ছিঁড়ে ফ্যালে (১৯৯১),জঙ্গলে বিষাদ আছে (১৯৯৪),বড়োর ছড়া (১৯৯৪),সেরা ছড়া (১৯৯৪),টরে টক্কা (১৯৯৬),কিছু মায়া রয়ে গেল (১৯৯৭),সকলে প্রত্যেকে একা (১৯৯৯),পদ্যসমগ্র - ১ম থেকে ৭ম খণ্ড। 

রুপচাঁদ পক্ষী ছাড়াও স্ফুলিঙ্গ সমাদ্দার ছদ্মনামে তিনি অনেক প্রবন্ধ, নিবন্ধ লিখে গিয়েছেন। ২৩ শে মার্চ ১৯৯৫ সালে আমাদের প্রাণের কবি চলে যান না ফেরার দেশে। কবি শক্তি চট্টোপাধ্যায়ের নাম সর্বকালে  বাংলা সাহিত্যের ইতিহাসে উজ্জ্বল হয়ে থাকবে।


*******************************
(ঋণ স্বীকার : সনৎকুমার বটব্যাল,  সম্পাদক পৃত্থী সাহিত্য পত্রিকা,  উইকিপিডিয়া ও সমসাময়িক  পত্র পত্রিকা)


 

ধর্ম পুজা 

শ্রাবণী সেনগুপ্ত 

নদীয়ার ধর্ম ঠাকুর ধর্মরাজ নামে পরিচিত।ধর্ম ঠাকুর আদি জনগোষ্ঠীর লৌকিক দেব, পরে বৌদ্ধরূপের ভিতর দিয়ে ব্রাহ্মণীকৃত।নদীয়ার অন্ত্যজরা এই পুজো করেন।এই পুজো উপলক্ষ্যে চাষী বউয়েরা উঠোনে ও মাটির দেওয়ালে আদিম শস্য ভাবনার প্রতীকস্বরূপ আলপনা দেন।দরজার উপরে ও দুই পাশে দুটি ধানের শীষের আলপনা আড়াআড়িভাবে (x চিহ্নের মতো)থাকে। ডক্টর অমলেন্দু মিত্রের মত অনুযায়ী নদীয়ার ধর্ম পুজোর সঙ্গে বীরভূম ও বাঁকুড়ার ধর্ম পুজোর মিল আছে,যদিও পুজা পদ্ধতি ও প্রকরণে সামান্য পার্থক্য আছে।

               নদীয়ার চাকদহ থানার গোটরা গ্রামে একটি বড় পুকুরের পাশে মাঠ আছে।সেখানকার ধর্ম ঠাকুর থানে অগ্রহায়ন মাসের শেষে সাত দিনের মেলা হয়। ধর্মরাজের থানে টিনের চাল দেওয়া মাটির ঘরে নিত্য পুজো হয়।এখানে ধর্মরাজের শিলাখণ্ডের সঙ্গে অষ্টনাগ, নারায়ণ ও শিব প্রভৃতি আরও আঠেরোটি শিলাখন্ড আছে। অগ্রহায়ণ মাসের শেষ শনিবার মূর্তিগুলি বাইরে এনে ঐ বড় পুকুরে স্নান করিয়ে পুকুরের কাছে কামারশালায় চাঁদোয়ার তলায় বেদিতে পুজো করা হয়।জনশ্রুতি অনুযায়ী প্রথম সেবাইত বিধু পন্ডিত একদা ঐ পুকুরে স্নান করতে গিয়ে মূর্তিগুলি পান।স্বপ্নেই তিনি মন্ত্র ও পুজা পদ্ধতি জানতে পারেন।ধর্মরাজ যমরাজ নামেও পরিচিত।তাঁর পুজোতে কোনো ভুল হলে সেবাইত বা পূজারীর বংশ থাকেনা বলে বিশ্বাস। হিন্দু মুসলমান নির্বিশেষে তাঁর কাছে মানত করেন। ধর্মরাজের সেবাইত রোগমুক্তির জন্য তাবিজ কবচ মাদুলি জলপড়া দেন।চাষীরাও মানত করে,যাতে তাদের জমির ধান পোকায় নষ্ট না করে,চুরি না যায়, অতিবৃষ্টি বা বন্যায় ডুবে না যায়।মেলা সংলগ্ন পুকুরটি থেকে এইসময় মাছ ধরা ও বিক্রী করা হয় ।

         কৃষ্ণনগরে মালোপাড়ায় লোকায়ত দেব ধর্মরাজের শিলাখন্ডের দেড়শ বছরের প্রাচীন দালান মন্দির আছে।এখানে বৈশাখী পূর্ণিমায় ও অগ্রহায়ণ মাসের শেষ শনিবার পুজো হয়।এখানে সেবাইত ব্রাহ্মণ।মেয়েরা উপোসী থেকে পুজো দেন।ঘূর্ণি এলাকাতেও ধর্ম ঠাকুরের পুজো হয়।ভালুকা গ্রামে ধর্মরাজের শিলাখণ্ডে পুজা হয়। চাপড়া থানার জলকর মথুরাপুর পলদা মুরাগাছা ও যোগিনীদহ গ্রামে চাষী ও মৎস্যজীবীরা ধর্ম পুজা করে থাকেন। নবদ্বীপের দণ্ডপানি তলায় দন্ডপানি যমরাজ ,জামালপুরে
বুড়োরাজ(বুড়োশিব ও ধর্মরাজের সংমিশ্রিত লোকায়ত দেব),করিমপুর থানার ভৈরব নদীর তীরে ধর্মরাজ,কালীগঞ্জ থানার আকন্দবেড়িয়া, পলাশী ,দেবগ্রাম ও হিজলী ও ঘোড়াইক্ষেত্র গ্রামগুলির ধর্মঠাকুর চালাঘরে গাছের তলায় পূজিত হন।

                 ধর্ম ঠাকুরের কুর্মমূর্তিই অকৃত্রিম মূর্তি।কালীগঞ্জ থানার ঘোড়াইক্ষেত্র গ্রামের ধর্ম ঠাকুর ডিম্বাকৃতি কুর্মমূর্তির মতন। পন্ডিতদের মতে ধর্মরাজের কুর্মাকার বিগ্রহ হল বৌদ্ধস্তূপের অনুকরণ।


 

তথাগত বুদ্ধ

জয়তী ব্যানার্জী 


"হাজার বছর ধরে আমি পথ হাঁটিতেছি পৃথিবীর পথে"---
এমন একটি আশ্চর্য উক্তি দিয়েও তাঁকে মূর্ত করা যায় না। কারণ হাজার বছর ধরে তাঁর দীর্ঘ পথ পরিক্রমার একটি ভগ্নাংশ মাত্র আমরা উপলব্ধি করেছি। পৃথিবীর পথে তিনি হেঁটে চলেছেন আড়াই হাজার বছর ধরে।
গৌতম বুদ্ধ______
আড়াই হাজার বছর ধরে এই পৃথিবীর পথে প্রান্তরে অক্লান্ত হেঁটে চলেছেন এক অপ্রতীম মানসপুত্র।
একটি দর্শন ;একটি ধর্মমত ;একটি ভাবধারার প্রচারক এই অপ্রতীম মানব পুত্রটি। যে দর্শন যে ধর্মমত যে ভাবধারা অনুপ্রাণিত করেছে পৃথিবীর অগণিত মানুষকে। আলো দেখিয়েছে অন্ধকারে ।যা কিনা আড়াই হাজার বছর ধরে দেখিয়ে চলেছে। আজও দেখিয়ে চলবে আর ,আরো বহু বছর আরো বহু হাজার হাজার বছর।
জন্মসূত্রে তর্কের খাতিরে রাজপুত্র তিনি। রাজপদের হাতছানি উপেক্ষা করে নেমে এসেছিলেন পথে, সিদ্ধার্থ থেকে গৌতম-- গৌতম থেকে উপনীত হয়েছিলেন তথাগত বুদ্ধে।
কিন্তু এই যে রূপান্তর সিদ্ধার্থ থেকে বুদ্ধ হয়ে ওঠার এক যে দুস্তর প্রক্রিয়া, এর উৎস কোথায়?
প্রচলিত গল্পকথা অনুসারে--
জরা ব্যাধিমৃত্যুকে স্বচক্ষে দেখার পর জীবনের অর্থ ভাবিত করে সিদ্ধার্থকে ।তারপর এক সন্ন্যাসীকে দেখে তিনি পথ খুঁজে পান ।রাজপথের হাতছানি স্ত্রী পুত্রে ঘেরা সংসারের শান্তিচ্ছায়া ;বৈভব মণ্ডিত জীবনের নিশ্চিন্ত আশ্রয় ছেড়ে সত্যের সন্ধানে যাত্রা করেন।
এই গল্পটা কিন্তু আমরা নির্দ্বিধায় মেনে নিই ।ভেবে দেখার চেষ্টা করি না কতটুকু সত্য আছে এর পেছনে, এর সত্যাসত্য নিয়ে আমরা ভাবি না ।কারণ এই আশ্চর্য মানব পুত্রটিকে আমরা উন্নীত করেছি দেবত্বে, পরিণত করেছি নবম অবতারে। ভক্তি এসে পথ ঢেকেছে যুক্তির।
এক রাজ পরিবারের রাজপুত্র হিসেবে জন্মেছিলেন তিনি। কেমন ছিল সেই রাজ পরিবারের চিত্রটি। বড় হয়ে ওঠার পথে কোন্ মোড় বাঁক নিয়েছিল সেই রাজপুত্রের জীবনে ।এইসব বাঁক মোড় ফেরানোর পথেই তার জীবনে এসেছিলেন স্ত্রী গোপা।রূপ নিয়েছিল তাদের যৌথ জীবনের দশ বছরের পরবর্তী ফসল পুত্র রাহুলকে ঘিরে। গৃহত্যাগের পর থেকে শুরু করে কঠিন সাধনার পথ বেয়ে বুদ্ধতে উপনীত হওয়ার পথে সিদ্ধার্থর জীবন গল্পকথা থেকে আমরা আরো এক নারীর খবর পাই। তপস্যারত সিদ্ধার্থের জন্য পায়েস নিয়ে এসেছিলেন সুজাতা, সেই পায়েস খেয়ে শক্তি ফিরে পেয়েছিলেন সিদ্ধার্থ।

 তাহলে সিদ্ধার্থ গৌতম হলেন যিনি সেই আধ্যাত্মিক সাধনা ও জীবন নিয়ে নিজস্ব জ্ঞান উপলব্ধির পর তিনি বুদ্ধ নামটি গ্রহণ করেন। তার জন্ম ৫৬৩ খ্রিস্টপূর্বাব্দ এবং পরিনির্বাণ ৪৮৩ খ্রিস্টপূর্বাব্দ । তাঁর বুদ্ধত্ব লাভই হল বোধিলাভ। দুঃখ ও দুঃখের কারণ সম্বন্ধে জানতে সিদ্ধার্থ তাঁর যাত্রা অব্যাহত রেখেছিলেন। প্রথমে বিভিন্ন সন্ন্যাসী তারপর উদ্দগ্ ---এদের কাছে ঘুরে সন্তুষ্ট না হতে পেরে উরুবিল্ল নামক স্থানে গমন করেন ।সেখানে প্রথমে একটি উত্তর-পূর্বমুখী শিলাখণ্ডের উপর বোধীসত্ত্ব জানু পেতে বসে আপন মনেই বলেছিলেন যে----
"যদি আমাকে বুধ্ধ্বত্ব লাভ করতে হয় তাহলে বুদ্ধের একটি প্রতিচ্ছায়া আমার সম্মুখে দৃশ্যমান হোক "--এই কথা উচ্চারিত হওয়ার সাথে সাথে শিলাখণ্ডের গায়ে ৩ ফুট উঁচু একটি বুদ্ধের প্রতিচ্ছায়া প্রতিফলিত হলো।
বোধিলাভ এর পরই তাঁর দর্শন ও বাণী প্রচার শুরু হয়, প্রায় আড়াইশো বছর পরে । তাঁর বাণী প্রচারের প্রথম দায়িত্ব নিয়েছিলেন সম্রাট অশোক ।চন্ডাশোক থেকে ধর্মাশোকে পরিণত হয়েছিল। একমাত্র বুদ্ধের বাণীর দাঁড়াই এটা সম্ভব। তাই বুদ্ধচরিত আলোচনা করতে গেলে অশোককে বাদ দিয়ে আমরা তা করতে পারি না।
বুদ্ধদেবের জীবন চর্চা ও দর্শন আদি বৌদ্ধ দর্শনের মূল ভিত্তি। আমাদের দেশে বুদ্ধের চিন্তাধারা হাজার বছর ধরে বিবর্তিত হয়েছে ।বুদ্ধদেবের তপস্যালব্ধ জ্ঞান বা উপদেশ বৌদ্ধধর্ম ও বৌদ্ধ দর্শনের মর্ম বাণী। মুখে মুখে তিনি তাঁর বাণী প্রচার করতেন ।তিরোধান এর পর তাঁর শিষ্যরা তাঁর উপদেশগুলোকে পালি ভাষায় গ্রন্থের আকারে সংরক্ষিত করেন ।এই গ্রন্থ গুলিকেই বলা হয় পিটক।
বুদ্ধের আর্য সত্যকে বিশ্লেষণ করে তিনটি দার্শনিক তত্ত্ব পাওয়া যায়। কোন বস্তুই স্বয়ংসম্পূর্ণ বা স্বয়ম্ভু নয় বৌদ্ধ দর্শন অনুযায়ী বোধ্জগত এবং মানসিক জগতে যে ঘটনাগুলি ঘটে, তার মূলে যে কার্যকারণ বিদ্যমান তাকেই দর্শনে প্রত্বীত্ত বলা হয়েছে। জগতে বিনা কারণে কোন কিছু ঘটে না অর্থাৎ "অস্মিন সতি ইদম্ ভবতি "-----আবার এই তত্ত্বের ওপর ভিত্তি করেই বলা যায় সকল বস্তুই সতত পরিবর্তনশীল। কোনো বস্তু স্থায়ী বা সনাতন নয়। সবই সর্বপ্রথম অনিত্য বা অস্থায়ী---- যার উৎপত্তি আছে আবার বিনাশও আছে। সমগ্র জগতের পরিবর্তনের ধাপ সর্বক্ষণ চলমান ।প্রতিটি ক্ষণেই নতুনের আবির্ভাব পুরাতনের বিনাশ অর্থাৎ "সর্ব অনিত্তম্"----- তবে বৌদ্ধ মতে জগত আত্মা 
কোন কিছুর চরম সত্যতা নেই সকল বস্তুই অসাঢ় অর্থাৎ "সর্যম অনাত্মাম্"---একটির পর একটি মানসিক প্রক্রিয়ার অবিরাম প্রবাহকেই বুদ্ধদেব আত্মা বা সোল্ বলেন।
তবে একথা সকলের স্বীকার্য যে "বৈদিক সংস্কৃতির ভয়ানক হিংসার বাতাবরণে অহিংসায় আরাধিতা বৌদ্ধ ধর্ম তৎকালীন মানব জীবনে প্রবাহমান দুঃখের কোন চূড়ান্ত সামাজিক সমাধান দিতে না পারলেও গৌতম বুদ্ধ দুঃখ নিবৃত্তির যে ভাববাদী ধর্মমত প্রচার করেন তা ক্রমে ক্রমে লোকপ্রিয় হয়ে ওঠে এবং তা কেবল ভারতে সীমিত না থেকে তাঁর অনুসারী ভিখ্খুদের মাধ্যমে ভারতের বাইরে অন্যান্য দেশেও ছড়িয়ে পড়ে।"
মহামতি বুদ্ধকে নিয়ে লেখা "বুদ্ধদেব "নামক গ্রন্থটিতে বিশ্ব কবি লেখেন,
"ভারতবর্ষে বুদ্ধদেব মানবকে বড় করিয়াছিলেন তিনি জাতি মানেননি :যাগযজ্ঞের অবলম্বন হইতে মানুষকে মুক্তি দিয়েছিলেন ;দেবতাকে মানুষের লক্ষ্য হইতে অপসৃত করিয়াছিলেন; মানুষ যে হীন দেবাশীষ জড়পদার্থ নহে তাহা তিনি প্রথম ঘোষণা করিয়াছিলেন"
তার ভিক্ষু সংঘ কে লক্ষ্য করে বলেছিলেন-----
"ওহে ভিক্ষুগণ বহুজনের হিতের ও বহুজনের সুখের জন্য দেবতা ও মানুষের কল্যাণের জন্য তোমরা দিকে দিকে বিচরণ কর ;তোমরা স্বধর্ম প্রচার কর; যার আদিতে কল্যাণ; মধ্যে কল্যাণ ;অন্তে কল্যাণ; যার অর্থ -যুক্ত ব্যঞ্জনযুক্ত পরিপূর্ণ ও পরিশুদ্ধ ;সেই ব্রহ্মচর্য প্রচার করো।
বৌদ্ধ ধর্মে তাই দেখা যায় মানুষেরই রাজকীয় আধিপত্য। মানুষই এখানে দেবতার স্থানে অধিষ্ঠিত ।এখানেই যেন বৌদ্ধ দর্শন ও বেদান্তের মেলবন্ধন ঘটেছে। যে বেদান্ত আমাদের শিখিয়েছে____
আমাদের পূজ্য ভগবান রুপী নারায়ণ নয়, নররূপী নারায়ণ---
আজকের হিংসায় উন্মত্ত পৃথ্বীতে মানুষে মানুষে; সম্প্রদায়ে সম্প্রদায়ের ;জাতিতে জাতিতে এবং রাষ্ট্রের রাষ্ট্রের ক্রমবর্ধমান হিংসা-বিদ্বেষ যুদ্ধবিগ্রহ লোভ-লালসা এবং বৈরিতার আবহে হানাহানির মধ্যে মরুদ্যান হয়ে জেগে থাকেন____ সেই পরম করুণাময় মহামতি বুদ্ধ -- আর তার গভীর দর্শন----
তাইতো এই পূণ্য দিনে সকলের ওপর বর্ষিত হোক-
বরিষধারা মাঝে
শান্তিরবারি
শুষ্ক হৃদয়ে লয়ে আছে দাঁড়ায়ে,
ঊর্ধ্ব মুখে নরনারী
বরিষ ধারা মাঝে শান্তির বারি।।


 

ঘন্টাকর্ণ 

জনা বন্দ্যোপাধ্যায়


 স্নিগ্ধ বরফঘেরা পাহাড়ী এলাকা খিরসুতে ঘন্টাকর্ণের মন্দির লক্ষিত হয় l বদ্রীনাথ মন্দিরের প্রবেশপথের ডানপার্শ্বেও দ্বাররক্ষীরূপে ঘন্টাকর্ণের মূর্তিটি সকল দর্শনার্থীর দৃষ্টি আকর্ষণ করে l "ঘন্টাকর্ণ"কে নিয়ে বিভিন্ন পৌরাণিক কাহিনীগুলো অনেকেরই অজানা l মহাভারতের "হরিবংশম"এর বৈশ্য পর্বের একাদশ অধ্যায়ে "ঘন্টকর্ণ" এক পিশাচরূপে বর্ণিত,কৃষ্ণের কৈলাস যাত্রার পথে ঘন্টাকর্ণের সঙ্গে তাঁর সাক্ষাৎ হয়,ঘন্টাকর্ণ কৃষ্ণের প্রকৃত পরিচয় জানতেননা,ঘন্টাকর্ণ কৃষ্ণের কাছে নিজেকে কুবেরের অনুচর ও শিবের ভক্ত বলে পরিচয় দেন ,শিবভক্ত ঘন্টাকর্ণ নিজের দুই কানে দুটি ঘন্টা পরতেন,যাতে বিষ্ণুর নাম তাঁর কানে প্রবেশ না করে l

    ঘন্টাকর্ণ শিবকে তাঁর ভক্তি দ্বারা তুষ্ট করে মোক্ষ প্রার্থনা করেছিলেন, শিব বলেছিলেন বিষ্ণুই একমাত্র মোক্ষদান করতে পারেন l এরপর ঘন্টাকর্ণ বিষ্ণুর উপাসনা আরম্ভ করেন, কৃষ্ণ নিজের স্বরূপ প্রকাশ করেন,ঘন্টাকর্ণ বিষ্ণুর দর্শন লাভ করেন এবং নৃত্যে রত হন,কৃষ্ণের প্রভাবে ঘন্টাকর্ণর পিশাচ শরীরের দৈবশরীরে উত্তরণ ঘটে l

      নীলাচল পর্বতে অবস্থিত কোন কোন মন্দির ভৈরব  ঘন্টাকর্ণর নাম ও কাহিনীর সঙ্গে যুক্ত l নেপালের কাঠমান্ডু ভ্যালির একটি বিশেষ সম্প্রদায় তিনদিনের একটি উৎসব পালন করে যা "গাথেমঙ্গল "নামে খ্যাত,সেখানে এটাই বিশ্বাস করা হয় যে,ঘন্টাকর্ণ একজন  দানব এবং এই উৎসবে দানবের মৃত্যু সূচিত হয়,,অশুভ শক্তির নাশই এই উৎসবের মুখ্য তাৎপর্য্য l

      তবে হরি রাম যোশীর মতো কিছু বিদগ্ধ পন্ডিতের মতে "ঘন্টাকর্ণ" হলেন কুমার কার্তিক,দেবতারা কার্তিককে যেসকল উপহার প্রদান করেছিলেন,সেগুলোর মধ্যে কার্তিক দুটি  ঘণ্টা পছন্দ করে কর্ণে পরেছিলেন বলে তাঁর নাম হয়েছিল "ঘন্টাকর্ণ" l এভাবে নেপালের  সাধারণ মানুষের কাছে ঘন্টাকর্ণ দানব ও বিদগ্ধ পন্ডিতদের কাছে "স্কন্দ" রূপে পরিচিত l

    শৈব পুরাণ অনুযায়ী শিবের চৌষট্টিটি ভৈরবরূপের অন্যতম একটি হল "ঘন্টাকর্ণ" l

     কোনার্কের সূর্য মন্দিরের দুদিকেই দুটি ঘন্টাকর্ণ ভৈরবের মূর্তি স্থাপিত আছে,যাঁরা ছোট্ট নৌকায় নৃত্যরত l এর তাৎপর্য্য-ওই নৌকাটি হল জগৎরূপ নৌকা,ইহলোক থেকে পরলোকের যাত্রাপথে মাঝিরূপে "ঘন্টাকর্ণ "খোদিত হয়েছে l উত্তর থেকে দক্ষিণ সমগ্র ভারতে এরকম বিবিধ তাৎপর্য্যব্যঞ্জক পৌরাণিক কাহিনী "ঘন্টাকর্ণ"-র নামের সঙ্গে যুক্ত l

           পরবর্তীকালে গ্রামবাংলায় ঘণ্টাকর্ণ ঘেঁটু ঠাকুর নামে খ্যাত হন। তিনি সূর্য ও ধর্মঠাকুরের লৌকিক রূপ। কারণ সূর্য ও ধর্মঠাকুর দুজনেই কুষ্ঠ ও নানারকম চর্মরোগ থেকে মুক্তি দেন। চর্মদেবতা ঘেঁটুর নাম ও আচরণ অদ্ভুত। ব্যবহৃত হওয়া আধভাঙা হাঁড়ি উল্টো করে রাখা হয়। এটি আসন হিসাবে ব্যবহৃত হয়। এর ওপর পাঁচদলা গোবর দিয়ে করা হয় ঘেঁটু দেবতার মুখ। চোখ তৈরী করা হয় দুটি কড়ি দিয়ে। কপালে সিঁদুরের তিলক আঁকা হয়। পাঁচ পাক সাদা সুতো দিয়ে ঘেঁটু ঠাকুরদের বন্ধনের ব্যবস্থা করা হয়। হাঁড়ির ওপর ঘেঁটু ফুল রেখে পুজো করা হয়। ফাল্গুন মাসের শেষ দিন এই পুজো হয়।

           এছাড়া অন্য একটি মত অনুসারে একাদশ শতাব্দীতে বাঁকুড়া পুরুলিয়ার বিস্তীর্ণ অংশ জুড়ে বিশেষ করে দ্বারকেশ্বর নদীর তীরে গড়ে ওঠা সমস্ত মন্দির মূলত: জৈন মন্দির। সে সময় জৈন ধর্ম বিস্তার লাভ করায় শৈব বিরোধিতা শুরু হয়। বিষ্ণুপুর ষন্ডেশ্বর মন্দির, পুরুলিয়ার দেউলঘাটার প্রাচীন মন্দিরে জৈন স্থাপত্য লক্ষিত হয়। ঘন্টাকর্ণ শৈব উপাসক ছিলেন। তিনি শিব নিন্দা শুনবেন না বলে কানে ঘণ্টা ঝুলিয়ে গ্রাম থেকে গ্রামান্তরে ভিক্ষা করতেন। ধারণা করা হয় শৈব ধর্মের পাশাপাশি জৈন ধর্ম গড়ে ওঠায় জৈন ধর্মের ভিক্ষা আচারের সাদৃশ্য লক্ষিত হয়। ঘেঁটু হলেন ভিখিরি ঘন্টাকর্ণর লৌকিক রূপ। ফাল্গুন মাসের বিকেল বেলা বাংলার গ্রামে শহরে বাচ্চারা ছোট্ট ঝুড়িতে ঘেঁটু নিয়ে ভিক্ষা করতে বেরোয়।


 

রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের ছোটগল্পে মানবতার প্রভাব 

সঞ্জয় সাহা 



ঊনবিংশ শতাব্দীর দ্বিতীয়ার্ধে ফ্রান্স,রাশিয়া, ইংল্যান্ড,আমেরিকায় ছোটগল্পের যে শিল্পিত বিকাশ ঘটেছে,  তার প্রভাব পড়েছে পৃথিবীর বিভিন্ন দেশে, ভারতবর্ষেও । পাশ্চাত্য রেনেসাঁসের প্রেরণায় উনবিংশ শতাব্দীতে বাংলার সংঘঠিত হয়েছিল সীমাবদ্ধ নবজাগরণ । রেনেসাঁসের ফলে শিল্প- সাহিত্য- ধর্মচর্চা সর্বত্র বিপুল পরিবর্তন পরিলক্ষিত হয় । নতুন নতুন শিল্পআঙ্গিকে পূর্ণ হতে থাকে বাংলা সাহিত্যের অঙ্গন । পঞ্চাশ-ষাটের  দশকেই নাটক- প্রহসন- মহাকাব্য - গীতিকবিতা-  উপন্যাস রচিত হলেও ছোটগল্পের আবির্ভাব বিলম্বিত হয়েছিল শতাব্দীর শেষ দশক অবধি । উনিশ শতকের নব্বইয়ের দশকেই, বস্তুত প্রকৃত অর্থে বাংলা ছোটগল্পে যাত্রা শুরু এবং বলা বাহুল্য রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরই আধুনিক বাংলা ছোটগল্পের প্রাণ প্রতিষ্ঠাতা, তাঁর হাতেই ঘটে বাংলা ছোটগল্পের উজ্জ্বল মুক্তি । কেবল নতুন রূপকল্প হিসেবেই নয়, বাঙালির বাস্তব জীবনের স্বাদ আর সৌরভ, আশা আর আনন্দ, দুঃখ আর বেদনার শব্দ প্রতিমা হিসেবে গল্পগুচ্ছ আমাদের সাহিত্যের এক উজ্জ্বল সম্পদ। উপনিবেশিক শাসনের এক বিশেষ পর্যায়ে বাংলার পল্লীগ্রাম যে অর্থনৈতিক গুরুত্ব অর্জন করে এবং বুর্জোয়া মানবতাবাদের প্রভাবে বাংলায় দেখা দেয় যে নবতর জীবন বোধ,  বস্তুত এই দ্বৈত প্রবণতাই সম্ভব করেছিল ছোটগাল্পিক হিসেবে রবীন্দ্রনাথের উজ্জ্বল আবির্ভাব। 


রবীন্দ্রনাথের মানবতাবাদ প্রত্যক্ষবাদ সঞ্জাত,তার কেন্দ্রে রয়েছে মুক্তবুদ্ধির ব্যক্তিমানুষ । তাঁর শ্রেষ্ঠতার আদর্শ ও সৃজনী কল্পনাবৃত্তি । একদিক থেকে তার মানবতাবাদ কান্টের কোপারনিকাস বিপ্লবের সঙ্গে তুলনীয় । তবে নৈতিকতাই তার মুখ্য স্বর। ভারতীয় দর্শনে যে সত্তাকে আত্মা বলা হয়, রবীন্দ্রনাথ তাকে মানুষের শ্রেষ্ঠতার ক্রিয়াশীল বোধের সঙ্গে একাত্ম করে রেখেছেন । তাঁর মতে মানুষের আত্মা তার ক্ষুদ্র স্বার্থকে অতিক্রম করে তাকে বিশ্বজনীন ঐক্যের আদর্শের দিকে নিয়ে যায় । রবীন্দ্রনাথের মতে নৈতিকতা মানুষের ভূমার প্রেক্ষিতে স্থাপিত । নৈতিকতার মূল শ্রেয়োধর্ম, নৈতিকতা কখনোই প্রয়োগবাদ (hedonism) তত্ত্বে আধারিত হতে পারেনা । কারণ প্রেয়োবাদ মানুষের জীবস্বভাবের চাহিদার উপর স্থাপিত, তাতে মানুষের শ্রেষ্ঠতার আদর্শ ও তার আকর্ষণের প্রসঙ্গটি অনুক্ত থাকে । কাজেই প্রেয়োবাদ মানুষের সম্পূর্ণ সত্তার ব্যাখ্যা দেয়না, আর সেই কারণে তা একদেশদর্শিতার দ্বারা খন্ডিত । স্বার্থসিদ্ধিতে মানুষের আত্মপরিচয় বাহ্যিক,সীমিত ও বস্তুগত, ভূমা বা আদর্শের অসীমতায় তার প্রকৃত পরিচয় । সেই আদর্শকে জীবনে ও কার্যে উপলভ্যমান করে তোলাই মানুষের সভ্যতার ইতিহাস । মানুষের জীব স্বভাবকে রক্ষা করার যে উদ্যম ও ক্ষমতা আমরা নিয়ত ব্যয় করি, সেই কার্যসম্পন্ন হওয়ার পর যা উদ্বৃত্ত থাকে তার দ্বারাই আমাদের শ্রেষ্ঠতার আদর্শ ও কল্পনাকে দেশ ও কালে রূপদানের আয়োজন করা হয় । এই উদ্বৃত্তের ভূমিতেই মানবত্বের প্রকৃত পরিচয় । মানুষের যথার্থ পরিচয় হল প্রকৃতির আয়োজনকে পেরিয়ে সৃজনশীলতায় । এই উদ্বৃত্তকে রবীন্দ্রনাথ বলেছেন, 'The surplus in men ' বা মানব উদ্বৃত্ত । যাবতীয় মানবগুণের যোগে আমাদের জীবধর্ম, সীমার উপরে অতিরিক্ত এই সত্তাকে রবীন্দ্রনাথ বলেছেন, 'মানবব্রহ্ম' সত্য ধর্মে এই বৃহৎ মানুষকে আমরা আত্মবিষীকৃত করে তুলি । মানবব্রহ্ম হল মানবিক ভূমা। জাগতিক ভূমা আমাদের জ্ঞানের বিষয়, আর মানবিক ভূমা আমাদের সমগ্র দেহমন ও চরিত্রের পরিতৃপ্তি ও পরিপূর্ণতার বিষয়। এই বিষয়গুলোই সুন্দরভাবে ফুটিয়ে তুলেছেন রবীন্দ্রনাথ তাঁর ছোট গল্পগুলোতে।



এই প্রসঙ্গে রবীন্দ্রনাথের "মানুষের ধর্ম " থেকে উদ্ধৃতি দিয়ে বলতে পারি,  " আমার বুদ্ধি মানব বুদ্ধি , আমার হৃদয় মানবহৃদয় , আমার কল্পনা মানবকল্পনা । তাকে যতই মার্জনা করি, শোষন করি, তা মানবচিত্ত কখনোই ছাড়তে পারে না । আমরা যাকে বিজ্ঞানী বলি তা মানবুদ্ধিতে প্রমাণিত বিজ্ঞান, আমরা যাকে ব্রহ্মানন্দ বলি তাও মানবের চৈতন্যে প্রকাশিত আনন্দ। এই বুদ্ধিতে, এই আনন্দে যাঁকে উপলব্ধি করি, তিনি ভূমা কিন্তু মানবিক ভূমা । তার বাইরে অন্য কিছু থাকা না থাকা মানুষের পক্ষে সমান । মানুষকে বিলুপ্ত করে যদি মানুষের মুক্তি, তবে মানুষ হলুম কেন ।"



রবীন্দ্রনাথের গল্পের সমাজের মানবতাবাদী ভাবনা গুলো মুক্ত হয়ে ফুটে উঠেছে । তাঁর গল্পে সমাজ জীবনে মানুষের অধিকার, স্বাভাবিক জীবন বিকাশ ও অস্তিত্বের সংকটকে কেন্দ্র করে বাস্তব চিত্র গুলো ফুটে উঠেছে । যেমন- পণ-প্রথার হৃদয়হীনতার ছবি ফুটে উঠেছে  দেনা-পাওনা, ঠাকুরদা, পণরক্ষা, হৈমন্তী, অপরাজিতা ইত্যাদি গল্পে । 


'দেনা-পাওনা' গল্পে বিধৃত হয়েছে নির্ধারিত পণ পরিশোধ করতে ব্যর্থ হওয়ায় শ্বশুর বাড়িতে বধুর ওপর নিষ্ঠুর নির্যাতনের ঘটনা ।


'হৈমন্তী' গল্পের পুরুষ গল্পকথকের জবানীতে রবীন্দ্রনাথ প্রণ-প্রথা কবলিত নারীর নিষ্ঠুর অপমাননা জ্বলন্ত ছবি এঁকেছেন । পণ-প্রথা কিভাবে নারীর জীবনকে তিলে তিলে মৃত্যুর দিকে ঠেলে দেয় হৈমন্তী তারই গল্প । 


রবীন্দ্রনাথের মানবতাবাদী দৃষ্টিভঙ্গি গড়ে ওঠার পশ্চাতে তাঁর পারিবারিক প্রভাব ছিল অপরিসীম । মানবজাতির প্রতি গভীর প্রেম ও মানব জীবনের প্রতি এক ইতিবাচক দৃষ্টিভঙ্গির পিছনে তাঁর পারিবারিক উদারনৈতিক ঐতিহ্য অনেকখানি সাহায্য করেছে । তিনি উপলব্ধি করেছিলেন, মানুষ যদি ব্যক্তিগত ক্ষুদ্র ও সংকীর্ণ স্বার্থের জগতে নিজেকে মগ্ন রাখে তাহলে বিহত্তর মানবসত্তা অবহেলিত হয়, বিশ্বজনীন মনুষ্যত্বের উপলব্ধি করতে পারে না ।   



কন্যাপণ ও অর্থলোলুপতার বশবর্তী একশ্রেণীর মানুষের অমানবিক রূঢ়তার ছবি পাওয়া যায় 'অপরাজিতা' গল্পে । মানুষের মনুষ্যত্বের লাঞ্ছনার বেদনাকে মূর্ত করা হয়েছে 'রামকানাইয়ের নির্বুদ্ধিতার' গল্পে । এই গল্পে সত্যনিষ্ঠ ধর্মেভীরু মানুষের মনুষ্যত্বের লাঞ্ছিত ও উপেক্ষিত হওয়ার অসহায় বেদনাকে রামকানাই চরিত্রের মাধ্যমে প্রকাশ করা হয়েছে । 


মানবতন্ত্রী রবীন্দ্রনাথ জীবনের শেষ নিঃশ্বাস থাকা পর্যন্ত মনুষ্যত্বের জয়ে আস্থা রেখেছিলেন ।  তাঁর যাবতীয় চিন্তা ভাবনার কেন্দ্রে ছিল মানুষ । রবীন্দ্রনাথের গভীর উপলব্ধিতে ধরা পড়েছিল যে, মানুষ নিছক এক ইন্দ্রিয়সর্বস্ব প্রাণী নয়, তার মধ্যে রয়েছে অসীম ক্ষমতা, অনন্ত সম্ভাবনা ও ঐশ্বর্যের বিপুল ভান্ডার । 


সামাজিক বিবেচনাহীনতার বিরুদ্ধে তীব্র প্রতিক্রিয়ার পরিচয় রয়েছে রবীন্দ্রনাথের 'বিচারক' গল্পে । যে পুরুষ নারীত্বের রহিমাকে ধুলায় লুটিয়ে দিয়েছে তাকে বিচারকের আসনে বসিয়ে বিবেকহীন সমাজের বিরুদ্ধে ও মানবিকতার পক্ষে রবীন্দ্রনাথ প্রতিবাদমুখর হয়েছেন এই গল্পে । 


রবীন্দ্রনাথের দৃষ্টিতে মানুষের একদিকে আছে তার ব্যক্তিসত্তা বা জৈবিকসত্তা বা অহং এবং অন্যদিকে আছে তার মানবসত্তা বা পরমসত্তা বা বিশ্বজনীন সত্তা । মানুষের পরিচয় পেতে হলে তাই তার ব্যক্তি সত্তাকে জানলেই যথেষ্ট হবে না, সেই বিরাট  বিশ্বসত্তা  কে জানতে হবে । কেন-না রবীন্দ্রনাথের ভাষায় -- একদিকে মানুষের অবস্থান যেমন তার ব্যক্তিগত জীবন জীব সীমানায়,তেমনি অপরদিকে তার অবস্থান ওই সীমানা অতিক্রম করে বিরাটে। 


মানবতাবাদী রবীন্দ্রনাথ তাঁর কয়েকটি গল্পে জাতীয় চেতনা ও সাম্রাজ্যবাদ বিরোধী চেতনাকে প্রকাশ ঘটিয়েছিলেন । তবে এ কথা স্মরণীয় যে, তিনি বিশ্বাস করতেন জীবন সমস্ত রাজনৈতিক আলোড়নের ঊর্ধ্বে । সেই জীবনের পূর্ণমূল্য দিয়েই মানুষের সামাজিক কল্যাণ করা সম্ভব । তাঁর 'মেঘ ও রৌদ্র' গল্পে  ইংরেজদের আমলাতন্ত্রের নিষ্ঠুর বর্বরতাকে চূড়ান্ত ধিক্কার জানানো হয়েছে । ইংরেজ শাসক, মালিক, ম্যানেজার ও বিচারকের জুলুম, আইনের প্রতি সম্পূর্ণ অবজ্ঞা,শাসিত জাতির প্রতি জুলুম ও দম্ভ ইত্যাদি বাস্তব ছবি ফুটে উঠেছে । 


গভীর মানবতাবাদী উদ্দীপিত রবীন্দ্রনাথ বুঝিয়েছেন -- মানুষকেও দেবতার কত বেশি প্রয়োজন । বস্তু রবীন্দ্রনাথ তাঁর মানবতাবাদের মধ্যে এক অফুরন্ত শক্তিকে অনুভব করেছেন । সত্যের আনন্দ রূপকে বাস্তবের মানবদেহপটে মূর্তি লাভ করতে দেখেছেন । সেই অনুভূতি তিনি প্রকাশ করেছেন তাঁর নানা কাব্য, সাহিত্যে ও ছোট গল্পগুলোতে  । তিনি তার ছোট গল্পগুলোতে বুঝিয়েছেন, মনের মধ্যে মানবতার প্রদীপ জ্বেলে  মানবযাত্রী যুগযুগান্তর ধরে এগিয়ে চলছে সত্যের খোঁজে । তার জন্যে ধন-মান - প্রান ও ক্ষুদ্রতাকে বলি দিয়েছে বারংবার । তাই রবীন্দ্র - অনুভূত মানবতাবাদকে মর্ত- অমর্তের মেলবন্ধন বলা চলে । 

রবীন্দ্রনাথের প্রতিটি গল্পে আমরা এই মানবতাকে বা মানবধর্মকে খুঁজে পাই । মানুষের ব্যথা ও বেদনার অনেক কারণ, এই দুঃখবেদনা শুধুমাত্র সরকারি দাক্ষিণ্যে বা আইন প্রণয়ন করে দূরকরা সম্ভব নয় । এর জন্য ভালো মানুষের দরকার । মানবসেবার কাজে সবাইকে নিযুক্ত হতে হবে । আইন করে মানবধর্ম রক্ষা করা যায় না, তার জন্য হৃদয়ের প্রসার দরকার । 'স্ত্রীর পত্র' গল্পে রবীন্দ্রনাথ নারী মুক্তির প্রসঙ্গ টেনেছেন ব্যক্তিত্বসচেতন নারী মৃণালের জবানীতে আত্মবিশ্লেষণের মাধ্যমে । মৃণাল সংসারে অন্যায় অবিচার, হৃদয়হীনতা ও বৈষম্য সইতে না পেরে অবশেষে বিদ্রোহ করেছে । তার বিদ্রোহী নারী হৃদয় হৃদয়হীন সংসারের শৃংখল  থেকে বের হয়ে লাভ করেছে মুক্তির স্বাদ । 'বদনাম' গল্পের সৌদামিনীও এমনিভাবে বিদ্রোহী হয়েছে । সুতরাং দেখা যাচ্ছে কাব্য ও প্রবন্ধে রবীন্দ্রনাথ যেমন মানবতার বাণীকে বাক্সময় করে তুলেছিলেন তেমনি তাঁর ছোটগল্পেও বিচিত হয়েছে তার বহুবর্ণিল ছবি । 

গল্পে নারীর রূপ সম্পর্কে পুরুষতান্ত্রিক সমাজের দৃষ্টিভঙ্গি ও স্বরূপ তুলে ধরে রবীন্দ্রনাথ দেখেছেন যে, তা নারীর মানবিক জীবন চেতনার পথে প্রতিবন্ধকতা স্বরূপ । 'খাতা' গল্পের বালিকা বধূ উমা লেখাপড়ায় আগ্রহ দেখাতে গিয়ে বিরম্বিত হয়েছে তথাকথিত শিক্ষিত স্বামীর কাছে । 'পয়লা নম্বর' গল্পে বুদ্ধিজীবী পুরুষের নিষ্ঠুর নিস্পৃহতা ও কর্তৃত্বপরায়ণ ক্ষমতা বলয়ের বলয়ে পড়া নারীর অবমাননার স্বরূপ ও তার অন্তর্বেদনার রূপটি ফুটে উঠেছে । এক কথায় সামন্তবাদী সমাজব্যবস্থায় নারীর প্রতি অন্যায়-অবিচার ও নারীর অধিকারহীনতার স্বরূপ রবীন্দ্রনাথ উদঘাটন  করেছেন তার ছোটগল্পগুলোতে । শুধু তাই নয়, এই অমানবিক সমাজের বেড়াজাল ভেঙ্গেচুরে বের হয়ে আসার প্রেরণাও তাঁর গল্পে রয়েছে । 'স্ত্রীর পত্র'  গল্পে সমাজে নারীর মুক্তিপথের নানা অন্তরায় তাঁকে গভীরভাবে আলোড়িত করেছিল । পণপ্রথা, সহমরণ, বিধবা বিবাহ ও বহুবিবাহের মতো যে সমস্ত সমস্যা সেকালে পারিবারিক ও সামাজিক জীবনে নারীর অবস্থানকে অমর্যাদাকর ও সংকটাপন্ন করে তুলেছিল পাশ্চাত্যের নারীর অবস্থান, অধিকার ও মর্যাদার আলোয় রবীন্দ্রনাথ তাকে বিচার করেছিলেন । স্বভাবতই নারীমুক্তির প্রসঙ্গ হয়েছিল তার ভাবনার বিষয়ে আর তাই নারীর পক্ষে পূর্ণ সহানুভূতি লক্ষ্য করা যায় রবীন্দ্রনাথের ছোটগল্পগুলোতে । নিষ্ঠুর সমাজ শাসনে নারীর অসহায় অবস্থার ছবি তুলে ধরে তাই তিনি যেন চাবুক মেরে সমাজের চেতনাকে জাগাতে চেয়েছেন । সন্ন্যাসীর স্ত্রী কুসুমের বঞ্চিত জীবনের হাহাকারকে তিনি বাক্সময় করে তুলেছিলেন 'ঘাটের কথা' গল্পে।  জীবিত ও মৃত গল্পের দুর্ভাগা কাদম্বিনীকে মরে প্রমাণ করতে হয়েছে যে সে মরেও মরেনি । 'কঙ্কাল' গল্পে নারীর রূপ সম্পর্কে পুরুষতান্ত্রিক সমাজের স্বরূপ তুলে ধরেছিলেন রবীন্দ্রনাথ । নিম্নস্তরের মেয়েকে জীবনসঙ্গিনী করে বর্ণাশ্রয়ী সমাজের মানবিকতার বিরুদ্ধে মানুষের মহিমাকে বড় করে দেখিয়েছিলেন ।

রবীন্দ্রনাথের অনেকগুলো গল্পে সমাজের নিচুতলার নিপীড়িত,লাঞ্ছিত মানুষের প্রতি ভালবাসার অসুখী প্রকাশ ঘটেছে । যেমন -- চিরস্থায়ী বন্দোবস্তের নিষ্ঠুরতায় একদিকে জমিদারদের জীবন উৎসবমুখর হলেও দরিদ্র মানুষের জীবনে যে বিপর্যয় নেমে এসেছে তার মর্মান্তিক ছবি আঁকা হয়েছে 'শাস্তি'গল্পে । 'মুসলমানি গল্পে' রবীন্দ্রনাথ সাম্প্রদায়িক সম্প্রীতির ওপর জোর দিয়েছিলেন । তাঁর এই গল্পে ধর্মনিরপেক্ষ হৃদয়ধর্মের প্রতি তাঁর আজন্মআকর্ষণ   তীব্র ও স্পষ্ট হয়ে উঠেছে । মানবতাবাদী রবীন্দ্রনাথ নারী সমাজের মর্যাদা ও মহিমার পক্ষেও কলম ধরেছিলেন । পুরুষ শাসিত সমাজে নারীর মুক্তিপথের নানা অন্তরায় তাঁকে গভীরভাবে আলোড়িত করেছিল । জাতিভেদ, বর্ণভেদ, ধর্মহীনতা সব ক্ষেত্রে রবীন্দ্রনাথ সবার উপরে মানুষের মহিমাকেই বড় করে দেখিয়েছেন । তাই 'রবিবার' গল্পের অভিককে দিয়ে তিনি বলিয়েছিলেন, "যে দেশে দিন-রাত্রি ধর্ম নিয়ে খুনাখুনি সে দেশে সর্ব ধর্মকে মেলাবার পুণ্যব্রত আমার মতো নাস্তিকেরই।" ল্যাবরেটরি গল্পের নন্দকিশোর সামাজিক অর্থে ধর্মকে স্বীকার করেন নি । এবং মোহিনীর মতো নিম্নস্তরের মেয়েকে জীবনসঙ্গিনী করে বর্ণশ্রয়ী সমাজের মানবিকতার বিরুদ্ধে মানুষের মহিমাকেই বড় করে দেখিয়েছেন । 


 


হলুদ চিঠি 

সুদীপা ঘোষ 

 
    "আজ বিকেলের ডাকে তোমার চিঠি পেলাম" ---
          বহু পরিচিত, আমাদের অনেকের প্রিয় একটা গান। সন্ধ্যেবেলা অনিতাপিসি গুনগুন করে গাইছিল গানটা। পুরনো স্মৃতিগুলো ভিড় জমাচ্ছিল মনে আর অনিতাপিসি ভাবছিল, আজকের ছেলেমেয়েদের কাছে এই গান শুধুই একটা ভালো গান। এর আবেগ বা অনুভূতি কোন কিছুই তাদের নিশ্চয়ই স্পর্শ করবে না। এরা যে এখন e-mail , sms, whatsapp , facebook -এর জগতে বিচরণ করছে। মুক্তাক্ষরে লেখা চিঠি, রঙিন খামের গন্ধ, পোস্টকার্ড বা Inland letter,ডাক পিওনের সাইকেলের ক্রিং ক্রিং - আগামী প্রজন্মের কাছে এসব গল্পকথা।
                      অনিতা পিসি বা তার সমসাময়িক মা, মাসি, কাকিমা ,জ্যাঠাইমাদের কাছে চিঠিই ছিল বাইরের জগতের সাথে, আত্মীয়- পরিজনদের সাথে যোগাযোগ রক্ষা করার একমাত্র মাধ্যম। কম্পিউটার, মোবাইল তখন দূর অস্ত। মন খারাপের অলস দুপুরে বিছানায় উপুর হয়ে বুকের নিচে বালিশ রেখে লিখে ফেলো মনের যত সুখ- দুঃখের কথা। তারপর পাঠিয়ে দাও কোন প্রিয়জনের কাছে। সেই মানুষটি যখন এই চিঠি পড়ছে, প্রতিটি ছত্রে যেন অনুভব করছে প্রেরকের অনুভূতি, অক্ষরগুলোও তখন জীবন্ত। কালির দাগে লেখা কথা তো নয়, যেন সে সামনে দাঁড়িয়েই মনের কথা শোনাচ্ছে। আজ সেই একইরকম কথা কোন যান্ত্রিক মাধ্যমে যখন জানাতে চাই ,সেইরকম অনুভূতিই কি স্পর্শ করে তাকে ? মনে তো হয় না। চিঠির শুরুতে 'শ্রদ্ধেয়', 'শ্রীচরণেষু', 'প্রিয় বন্ধু' - শব্দগুলি পত্রপাঠকের মন ছুঁয়ে যেত কতখানি, তা তো বলাই বাহুল্য।
                 আজকের গতিময় জীবনে কারই বা সময় আছে- কাগজ কলম নিয়ে চিঠি লেখো রে; ডাকে পাঠাও রে; অপেক্ষা করে বসে থাকো, কবে সেই চিঠির উত্তর আসবে। যুগের পরিবর্তনের সঙ্গে তাল মিলিয়ে চলতে না পারলে জীবনও যে তার ছন্দ হারিয়ে ফেলে। এগিয়ে চলার নামই তো জীবন। দিন বদলের সাথে প্রযুক্তির উন্নতিকে অস্বীকার করার তো প্রশ্নই ওঠে না।
                তবুও, কখনও কখনও ফেলে আসা দিনই যেন বেশি মধুর, পুরনো পন্থাই যেন বেশি আবেগঘন, হৃদয়স্পর্শী। এই দেখো না, কিছুদিন আগেও তো, নতুন বছরের শুরুতে বা দুর্গাপুজোর দশমী পেরিয়ে গেলেই সব বাড়িতেই একজন- দুজন করে বসে পড়ত কলম হাতে, আত্মীয়-পরিজনদের প্রণাম, স্নেহ- ভালোবাসা, আশীর্বাদ জানাতে। তখনও যে দূরবাসী স্বজনদের সাথে কুশল বিনিময়ের একটাই উপায় ছিল- চিঠি। অবশ্য, টেলিফোনও ছিল মুষ্টিমেয় কিছু বাড়িতে। কিন্তু, হাতে লেখা চিঠি যেন একটা আলাদা সুবাস বয়ে আনত। আর এখন? ছোট্ট একটা sms, ফোনে দু- চারটে কথা বা কয়েক লাইনের একটা email - তাতেই সব দায়িত্ব-কর্তব্য সারা হয়ে যায়। অনেক কথাই থেকে যায় না -বলা। সকাল-সন্ধ্যে ছুটে চলার ক্লান্তিতে আমাদের কথাই আজ হারিয়ে যেতে বসেছে। বেশি কথা বলা বা শোনার সময় নেই কারও। প্রয়োজন সাঙ্গ হলেই হল। আমরা যে এখন বড্ড বেশি যান্ত্রিক।
                      অথচ, একটা সময় ছিল, যখন প্রিয়জনের চিঠির অপেক্ষায় দিন গুনত সবাই। ভরদুপুরে ডাক হরকরার ঘন্টি বা সাইকেলের ক্রিং ক্রিং আওয়াজে বাড়ির মেয়ে-বউরা একছুটে সদর দরজায় বা জানালার পর্দা তুলে উদগ্রীব চোখের প্রশ্ন - আমার নামে কোনো চিঠি আছে গো? উত্তর নেতিবাচক হলে অপেক্ষায় আরও একটি দিন। আর, হাতে যদি পাওয়া যায় প্রত্যাশিত কাগজটি? প্রথমেই দু' হাতে আঘ্রান নেওয়া, তারপর দ্রুত একবার চোখ বুলিয়ে নেওয়া অক্ষরগুলির ওপর। বেশিরভাগ চিঠিই যত্ন করে রেখে দেওয়া হত, সময় পেলেই আবার পড়ার জন্য। কত হাসি, কত কান্না, কত ভালোবাসা, অভিযোগ- অনুযোগ সবই যে লুকানো রয়েছে ঐ একফালি কাগজে।
               দিন যাচ্ছে, সময় এগোচ্ছে। সময়ের সাথে পা মিলিয়ে এগোচ্ছি আমরাও। যুগের হাওয়ায় পাল তুলে ভাসছে সবাই। উন্নতিই যে আমাদের লক্ষ্য। দিন বদলের সাথে প্রযুক্তি যত এগিয়ে যাচ্ছে, আমরাও তত সহজভাবে দূরকে নিকট করে নিতে পারছি ।দূর প্রবাসী আপনজনটি কেমন আছে ,তা জানার জন্য আজ আর দীর্ঘ দুশ্চিন্তায় অপেক্ষা করতে হয় না। দ্রুতগতির ইন্টারনেট পরিষেবায় চোখের পলকেই শুধু কথা নয়, ছবি বা ভিডিওর মাধ্যমেও জেনে নিতে পারি সেই মানুষটির হাল- হকিকত্। তবু, যা কিছু পুরনো, তা তো বারবার ফিরে আসে মনে। তাই, হলুদ চিঠিগুলো তোলা থাকুক্ মনের স্মৃতিকোঠায়। শুধু , কখনও মন খারাপের একলা বিকেলে অপেক্ষা করতে ইচ্ছে হয় ,যদি আসে--
             " রঙিন খামে যত্নে লেখা আমার নাম"।


 

পুরোনো সুবাস

অনিতা নাগ 


 বহুতল এক ফ্ল্যাটের বারো তলা বারান্দায় বসে আছে অনু। যতোদূর চোখ যায় শুধু বাড়ী আর গাড়ী। সূর্যাস্তের রক্তিম আলো ভরা আকাশে দিন ফুরিয়ে সন্ধ্যে নামলে চারদিক ঝলমল করে আলোয়। বহুতলের আলো, সার দেওয়া গাড়ীর আলো। এতো আলোয় মুখ লুকিয়ে ফেলে অভিমানী এক চিলতে আকাশ। ছোটবেলায় অনু ভাবতো যতো উপরে ওঠা যাবে আকাশ ততো কাছে এসে যাবে। তেমনটা যে হবার নয় তা বুঝতে বুঝতেই ছোটবেলা হারিয়ে গেছে। আর এখন তো উঁচু উঁচু ইমারতের আড়ালে ক্রমশঃ আড়াল হচ্ছে আকাশের পরিধি। আজকাল একটা ভয় অনুকে পেয়ে বসেছে, আকাশটা যদি একদিন না দেখতে পায়! ইঁট, কাঠ, পাথরের আড়ালে যদি হারিয়ে যায় পুরো আকাশটা! রোজ সকালে ঘুম ভাঙার পর জানলার পর্দা সরিয়ে একবার দেখে নেয় বহুতলের ফাঁকে বাঁধা পড়া এক চিলতে আকাশটাকে। অভ্যেস হয়ে গেছে। কতোকিছুই তো হারিয়ে যাচ্ছে। শুধু আকাশটা আজো নিজের মতো আছে। ঐ আকাশেই এখনো মন পাখি পাখা মেলে হারিয়ে যেতে পারে। ওই নীল আকাশে সীমানা ছাড়িয়ে বহুতলের ফাঁকে ঐ চিলতে আকাশে মন ভাসিয়ে দেয় অনু। ওইখানটায় নেইকো বাঁধা, নেইকো শাসন। জীবনের স্বাভাবিক সুবাসটুকু ক্রমশঃ যেনো হারিয়ে যাচ্ছে। অনু সাবধানে আগলে রাখে সেই ফেলে আসা দিনগুলোকে।
শরতের পূজো পর্ব মিটতে মিটতে কখন যে শিউলি ঝরানো দিন এসে যায় বোঝা যায় না। হেমন্ত বড্ড নীরবে আসে। বাতাসে ছড়িয়ে দেয় হিমেল পরশ। হেমন্তের সকালে ঘাসের ডগায় শিশির-বিন্দু বড্ড প্রিয় অনুর। ছোটবেলায় হাতের মধ্যে শিশির বিন্দুগুলোকে আগলে রাখতে চাইতো। বুঝতেই পারতো না মুঠো গলে জল হয়ে কখন হারিয়ে যেতে শিশির -বিন্দুগুলো। যেমন হারিয়ে গেছে জীবনের অনেকটা পথ। আজ তো অতীতে সিঁদ কেটে তাদের খুঁজে বেড়ানো। কালি পূজোর দিন চোদ্দ প্রদীপ জ্বালাতে জ্বালাতে আজোও হেমন্তের কথা বড়ো মনে পড়ে। ‘ঘরে ঘরে ডাক পাঠালো দীপালিকায় জ্বালাও আলো’। এই আলো তো আসলে মনের আলো। যে আলোয় মুছে যায় মনের সব মলিনতা। যে আলো ছড়িয়ে পড়ে দিগন্তরে। সেই আলোর রেশটুকু এঁকে দিয়ে অভিমানী হেমন্ত কখন যে নীরবে শীতকে তার জায়গা দিয়ে যায় টের পাওয়া যায় না। হঠাৎই বাতাসে হিমেল পরশে শীতের হাতছানি টের পাওয়া যায়। আজকাল ছোটবেলাটা হুড়মুড়িয়ে এসে উঁকি দেয় সর্বক্ষণ। কেনো যে এমন হয়! মনে পড়ে কতো কথা। সময় বড্ড তাড়াতাড়ি ছুটে চলেছে বল্গাহীন ঘোড়ার মতো। অনুদের মতো যারা পুরোনো দিনের মানুষ তারা সেটা বেশী টের পায়। শীত মানেই মনে পড়ে রঙিন সোয়েটার, কমলালেবু, পাটালি গুড়, মায়ের হাতে রঙিন উল কাঁটা, রান্নাঘরে থলে ভর্তি রকমারী তরকারি, ছাদ বাগানে রঙিন ফুলের মেলা, পাড়ায় সকলে মিলে চড়ুইাতি। স্কুল থেকে ফিরেই ছাদে চলে যেতো অনু। কমলালেবু খেতে খেতে রোদে দেওয়া লেপে গড়াগড়ি খাওয়া, কি যে মজা হতো! তখনকার লেপগুলো খুব ভারী হতো। লাল লেপে সাদা ওয়াড় দেওয়া থাকতো। রোদের ওমে গরম হতো মা, ঠাকুমা’র হাতে বানানো কাঁথা। সেই কাঁথায় কতো যে গল্প বোনা থাকতো! এখন তো বাহারী কম্বল আর জয়পুরি রজাই এর যুগ। মুঠোফোনের একটা ক্লীকে বাড়ীতে এসে যায়। পছন্দ হলে রাখো, নাহলে ফেরত দাও। রান্নাঘরে পিঁড়ে পেতে খেতে বসতো সকলে। শেষ পাতে দুধ-ভাত। সাথে পাটালিগুড়। আহা! যেমন স্বাদ, তেমন গন্ধ। এখন আধুনিকতার ছোঁয়া লেগেছে গেরস্তের রান্নাঘরে। সাবধানী রান্না-বান্না। সারাবছরই পাটালী পাওয়া যায়। কাঁচের বয়ামে পাটালীগুড় ফ্রিজে রেখে দেয় অনু। কিন্তু সেই গুড়ে আগেকার সেই গন্ধ পায় না। চুরি করে কতো যে গুড় খেতো। এখন ভাবলে হাসি পায় অনুর। ছোট্টো ফ্ল্যাটের বারান্দায় পিটুনিয়া, ডালিয়া, চন্দ্রমল্লিকারা কুঁড়ি থেকে যখন ফুটে ওঠে, তখন বাবার কথা বড্ড মনে পড়ে অনুর। বাবার খুব ফুলের নেশা ছিলো। পাড়ার মধ্যে সেরা ডালিয়া ফুটতো বাবার হাতে। এমন কতো গল্প গাঁথা নিয়ে হারিয়ে যাওয়া দিনগুলো সামনে এসে দাঁড়ায়। ফ্ল্যাট বাড়ীর ছোট পরিসরে দুটো মানুষ নিজের মতো করে ভালো থাকার চেষ্টা করে। জীবিকার তাগিদে ছেলে মেয়েরা প্রবাসে। দু'জনের সাবধানী দিনলিপিতে সবকিছুই হিসেব করে সাজানো। আবেগটাও তো মাপের। সেই সাজানো দিনলিপিতে অনু আজো আগলে রাখে মণিমাণিক্যকে ভরা হারিয়ে যাওয়া দিনগুলোকে পরম আদরে আর সোহাগে। যতোদিন স্মৃতি আছে, ততোদিন। তারপরে হয়তো শীতের রাতের কুয়াশা-মাখানো আবছায়ার মতো স্মৃতিরা হারিয়ে যাবে। গুগলে সার্চ করে আগামী প্রজন্ম খোঁজ করবে হারিয়ে যাওয়া দিনগুলোর গল্প কথা। ততোদিন রঙিন উল, পাটালির সুবাস, ডালিয়া, চন্দ্রমল্লিকা, পিটুনিয়ার রঙ, শিশিরের মাথায় শিশিরবিন্দু আর কুয়াশা জড়ানো হেমন্ত আর শীতের আয়েশী দিনগুলোকে আগলে রাখে অনু।