Monday, December 2, 2024



কাঠের পুতুল
সূর্য্যদীপ্তা সরকার 

পুতুলবাড়ির দরজায় গিয়ে কড়া নাড়লাম।এটিকে একটি মেসবাড়ি বলা চলে,অনেক লোকের বাস এই বাড়িতে।বাড়ির মালিকের কড়া চাউনি ভেদ করে কোনো কোলাহল এখানে দাপিয়ে বেড়াতে পারেনা।
     দরজা খুলে গেল,স্বয়ং মালিক আমার সামনে দাঁড়িয়ে।বজ্রগম্ভীর গলাটাকে আরও এক পর্দা নীচে নামিয়ে আমাকে কিছু বলার সুযোগ না দিয়ে নিজেই বলে চললেন–"কী চাই মশাই? থাকতে এসেছেন তো? আগে সমস্ত নিয়মকানুন শুনে নিন,তারপর...শুনুন,আমার এখানে কিন্তু...."
বাড়ির 'একুশে আইন' শোনাতে যাচ্ছিলেন,তার আগেই আমি তড়িঘড়ি বলে উঠলাম–"না না,ভুল করছেন। আমি প্রথাগত বিশ্বাস,জার্নালিস্ট।আপনার বাড়ির তো ভারি নামডাক,একে ঘিরে মানুষের কৌতুহলও কম নয়,তাই আপনার অনুমতি থাকলে বাড়ির লোকজনের একটা ইন্টারভিউ নিতাম..."
–"আচ্ছা আচ্ছা।তথাগত শুনেছি,ইনি আবার প্রথাগত,তা ভালো,প্রথায় বিশ্বাস ভালো।নিন,আসুন।তবে হ্যাঁ,বাড়ির সবাই কাজকর্ম করে এসে ক্লান্ত থাকে,বেশি আজেবাজে প্রশ্ন করে বিরক্ত করবেন না।"
আমি তৎক্ষণাৎ বললাম–"হ্যাঁ হ্যাঁ,নিশ্চয়ই।"

       বৈঠকখানায় বাড়ির সব সদস্যরা হাজির।নরম সোফায় জুৎ করে বসে আলাপ করছি–
আপনারা কত বছর থেকে এখানে রয়েছেন? 
এক বয়স্ক ভদ্রলোক মাথার টাকে হাত বোলাতে বোলাতে বললেন–" আমার তো প্রায় গোটা জীবনটা এই বাড়িতেই কাটলো।সেই পঁচিশ বছর বয়সে পুলিশের চাকরি নিয়ে শহরে এসেছিলাম,সেই থেকে আমি এখানকার পার্মামেন্ট বাসিন্দাই বলতে পারেন।"
আমি বললাম–"ওরেব্বাবা! তা,ভালো লাগে এখানে এতদিন ধরে....?"
–"সে তো ভেবে দেখিনি বাবা।পুলিশের চাকরিটা টিকিয়ে রাখার জন্য এটা আমার দরকার ছিলো।এখন অবশ্য রিটায়ার করেছি কিন্তু স্বভাব সহজে ছাড়েনা কিনা!"
         ঘরের এক কোণ থেকে এক যুবক হঠাৎ জোরগলায় প্রায় চেঁচিয়েই উঠলো– "ধুর!স্বভাবের কথা তুলবেন না দাস মশাই। পুলিশের চাকরি করতে করতে আপনি নাহয় একপ্রকার চাকরই হয়ে গিয়েছেন...কিন্তু আমি! আমার স্বভাবের সাথে মোটেই আপনাদের মতো লোকের স্বভাব মেলেনা। তাও থাকতে হচ্ছে তো এই বাড়িতে! কী আর করবো! অদৃষ্ট!"
যুবকের পাশে দাঁড়ানো নিরীহগোছের ভদ্রলোকটি ফিসফিস করে যুবকের কানের কাছে বললো–" আঃ! চুপ চুপ! মালিক শুনতে পেলে কেলেঙ্কারি হবে।"
আমি কেমন একটা জটিলতার গন্ধ পেয়ে বলে উঠলাম–"তা,আপনার এখানে থাকতে ভালো না লাগলেও থাকেন কেন?আর ভালো লাগে নাই বা কেন?"
যুবকটি প্রায় কপাল চাপড়ে বলে–" কপাল,সবই আমার কপাল! আমি রাজনীতি করতাম মশাই।না না,ধান্দাবাজি পলিটিক্স নয়,সাচ্চা মনে নীতির পথেই রাজনীতিটা করতাম।সরকারের যে কোনো দুর্নীতি হোক বা সমাজের যে কোনো দুরাচার–সবকিছুর বিরুদ্ধেই কত বিক্ষোভে,মিছিলে সামিল হয়েছি,প্রতিবাদের শ্লোগান তুলে গলা ফাটিয়েছি,এই যে দাস মশাইদের মতো ক্ষমতাদাস পুলিশের লাঠির বাড়ির দাগ আজও আমার শরীরে খুঁজলে পাওয়া যাবে।কিন্তু তারপর...."
–"তারপর কী?"
–"বাবা অসুস্থ হলো,পরিবার থেকে চাকরির চাপ আসতে থাকলো প্রতিনিয়ত।একটা এন.জি.ও চালাতাম–সেসব বন্ধ হলো। এদিকে চাকরির বাজার তো জানেনই কেমন! শেষপর্যন্ত আমার বাবার বন্ধু,আমাদের ওয়ার্ড কাউন্সিলর,যার হাজার হাজার পাপের বিরুদ্ধে একসময় লড়াইয়ে নেমেছি,তারই সুপারিশে এই শহরে একটা অফিসে চাকরি পেলাম। তারপরেই ঢুকে পড়তে হলো এই বাড়িতে।জানেন মশাই? এই বাড়ির প্রত্যেকটা লোক এক একটা জড়ভরত। কারোর স্বভাবই এইরকম আর কারোর ভাগ্য...সবাই এখানে চুপ।মালিকের ভয়ে একটা সত্যি কথাও উঁচু গলায় বলার উপায় নেই এখানে..."
অবাক হয়ে বললাম–"তাহলে আপনি বেরিয়ে যাচ্ছেন না কেন? এই শহরে তো আরও কত বাড়ি আছে!"
–"উপায় নেই মশাই। এই বাড়িতে যে একবার ঢোকে,তার আর বেরোনোর ক্ষমতা নেই।"
–"এসব কী আবোলতাবোল বকছেন?আপনারা কাজে বেরোন না?"
–"ঠিকই বলছি।এই বাড়ির নাম পুতুলবাড়ি কেন জানেন? এই বাড়ির সবাই এক একটি কাঠের পুতুল।কাজের কথা বলছেন? মালিকের আঙুলে বাঁধা রশির টানে নাচাই তো আমাদের কাজ।আমরা তো নিজেদের ইচ্ছেমতো কথাটুকুও বলতে পারিনা।"
–"সে কী কথা! এই যে আপনি দিব্যি নিজের কথা বলছেন,ইচ্ছেমতোই বলছেন..."
–"বলছি না।আসলে আপনিও আমাদের মতো পুতুল বলেই আমাদের মনের ভাব বুঝতে পারছেন।"
–"অসম্ভব! আমি সুস্থ-স্বাভাবিক এক মানুষ,জ্বলজ্যান্ত এক মানুষ।"
–"তাই নাকি? তাহলে বলুন দেখি,এই যে আমার কাছে এত্তকিছু শুনলেন,পুরোটা লিখতে পারবেন আপনার কাগজে?"
–"দেখুন,আমি কাগজের অফিসের সামান্য এক কর্মচারী।আমার কথায় তো হবেনা।মূলত এই পুতুলবাড়ির গৌরবটুকু জানার জন্যই আমাকে পাঠানো হয়েছিল,অন্ধকারটুকু তো অফিস চায়নি।তাছাড়াও এই বাড়ির দিকে সরকারের সুনজর আছে,এইসব পাঁক নিয়ে ঘাটাঘাটি করলে আমাদের কাগজের অফিস লাটে তুলে দেবে না সরকার?"
–"অর্থাৎ,আপনি আপনার অফিসের দাস,আপনার সেই অফিস আবার ক্ষমতার দাস।আপনি তো মশাই দাসানুদাস...আপনি পুতুল না হয়ে যাবেন কোথা!"
আমি এবার অসহায়ের মতো চিৎকার করলাম–"না,আমি মানুষ।"
ঘরশুদ্ধ সকলে হাঃ হাঃ করে হেসে উঠলো,কেমন যেন কেঠো হাসি।আমি ভয় পেয়ে বেরিয়ে আসতে চাইলাম দরজা খুলে...পারলাম না।এতক্ষণে খেয়াল করলাম,আমার হাত-পা কেমন অসাড় হয়ে এসেছে।
ঘরভর্তি লোক যেন সমস্বরে বলে চললো–"পারবেন না মশাই,মালিকের ইচ্ছে ছাড়া আপনি একতিলও নড়তে পারবেন না।মালিক আপনাকে যেভাবে নাচাবে,এখন থেকে সেভাবেই নাচবেন।"
আমার সারা শরীর সত্যিই কাঠ হয়ে গেছে,কাঠের আবরণের ভিতর থেকে সব শুনছি,দেখছি কিন্তু নড়তে পারছি না,বলতে পারছি না।একেই এই বন্ধ ঘরে বন্ধ কাঠের আবরণের ভিতরে দম আটকে আসছে,গলার স্বর রুদ্ধ হয়ে গেছে চিরকালের মতো...তার সঙ্গে ওই কেঠো হাসি,স্বভাব কিংবা ভাগ্যের পরিহাসে কোনো এক ক্ষমতাধর পুতুলনাচের মালিকের দাস হয়ে যাওয়া কাঠের পুতুলগুলির নির্লজ্জ হাসি...

No comments:

Post a Comment