রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের ছোটগল্পে মানবতার প্রভাব
সঞ্জয় সাহা
ঊনবিংশ শতাব্দীর দ্বিতীয়ার্ধে ফ্রান্স,রাশিয়া, ইংল্যান্ড,আমেরিকায় ছোটগল্পের যে শিল্পিত বিকাশ ঘটেছে, তার প্রভাব পড়েছে পৃথিবীর বিভিন্ন দেশে, ভারতবর্ষেও । পাশ্চাত্য রেনেসাঁসের প্রেরণায় উনবিংশ শতাব্দীতে বাংলার সংঘঠিত হয়েছিল সীমাবদ্ধ নবজাগরণ । রেনেসাঁসের ফলে শিল্প- সাহিত্য- ধর্মচর্চা সর্বত্র বিপুল পরিবর্তন পরিলক্ষিত হয় । নতুন নতুন শিল্পআঙ্গিকে পূর্ণ হতে থাকে বাংলা সাহিত্যের অঙ্গন । পঞ্চাশ-ষাটের দশকেই নাটক- প্রহসন- মহাকাব্য - গীতিকবিতা- উপন্যাস রচিত হলেও ছোটগল্পের আবির্ভাব বিলম্বিত হয়েছিল শতাব্দীর শেষ দশক অবধি । উনিশ শতকের নব্বইয়ের দশকেই, বস্তুত প্রকৃত অর্থে বাংলা ছোটগল্পে যাত্রা শুরু এবং বলা বাহুল্য রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরই আধুনিক বাংলা ছোটগল্পের প্রাণ প্রতিষ্ঠাতা, তাঁর হাতেই ঘটে বাংলা ছোটগল্পের উজ্জ্বল মুক্তি । কেবল নতুন রূপকল্প হিসেবেই নয়, বাঙালির বাস্তব জীবনের স্বাদ আর সৌরভ, আশা আর আনন্দ, দুঃখ আর বেদনার শব্দ প্রতিমা হিসেবে গল্পগুচ্ছ আমাদের সাহিত্যের এক উজ্জ্বল সম্পদ। উপনিবেশিক শাসনের এক বিশেষ পর্যায়ে বাংলার পল্লীগ্রাম যে অর্থনৈতিক গুরুত্ব অর্জন করে এবং বুর্জোয়া মানবতাবাদের প্রভাবে বাংলায় দেখা দেয় যে নবতর জীবন বোধ, বস্তুত এই দ্বৈত প্রবণতাই সম্ভব করেছিল ছোটগাল্পিক হিসেবে রবীন্দ্রনাথের উজ্জ্বল আবির্ভাব।
রবীন্দ্রনাথের মানবতাবাদ প্রত্যক্ষবাদ সঞ্জাত,তার কেন্দ্রে রয়েছে মুক্তবুদ্ধির ব্যক্তিমানুষ । তাঁর শ্রেষ্ঠতার আদর্শ ও সৃজনী কল্পনাবৃত্তি । একদিক থেকে তার মানবতাবাদ কান্টের কোপারনিকাস বিপ্লবের সঙ্গে তুলনীয় । তবে নৈতিকতাই তার মুখ্য স্বর। ভারতীয় দর্শনে যে সত্তাকে আত্মা বলা হয়, রবীন্দ্রনাথ তাকে মানুষের শ্রেষ্ঠতার ক্রিয়াশীল বোধের সঙ্গে একাত্ম করে রেখেছেন । তাঁর মতে মানুষের আত্মা তার ক্ষুদ্র স্বার্থকে অতিক্রম করে তাকে বিশ্বজনীন ঐক্যের আদর্শের দিকে নিয়ে যায় । রবীন্দ্রনাথের মতে নৈতিকতা মানুষের ভূমার প্রেক্ষিতে স্থাপিত । নৈতিকতার মূল শ্রেয়োধর্ম, নৈতিকতা কখনোই প্রয়োগবাদ (hedonism) তত্ত্বে আধারিত হতে পারেনা । কারণ প্রেয়োবাদ মানুষের জীবস্বভাবের চাহিদার উপর স্থাপিত, তাতে মানুষের শ্রেষ্ঠতার আদর্শ ও তার আকর্ষণের প্রসঙ্গটি অনুক্ত থাকে । কাজেই প্রেয়োবাদ মানুষের সম্পূর্ণ সত্তার ব্যাখ্যা দেয়না, আর সেই কারণে তা একদেশদর্শিতার দ্বারা খন্ডিত । স্বার্থসিদ্ধিতে মানুষের আত্মপরিচয় বাহ্যিক,সীমিত ও বস্তুগত, ভূমা বা আদর্শের অসীমতায় তার প্রকৃত পরিচয় । সেই আদর্শকে জীবনে ও কার্যে উপলভ্যমান করে তোলাই মানুষের সভ্যতার ইতিহাস । মানুষের জীব স্বভাবকে রক্ষা করার যে উদ্যম ও ক্ষমতা আমরা নিয়ত ব্যয় করি, সেই কার্যসম্পন্ন হওয়ার পর যা উদ্বৃত্ত থাকে তার দ্বারাই আমাদের শ্রেষ্ঠতার আদর্শ ও কল্পনাকে দেশ ও কালে রূপদানের আয়োজন করা হয় । এই উদ্বৃত্তের ভূমিতেই মানবত্বের প্রকৃত পরিচয় । মানুষের যথার্থ পরিচয় হল প্রকৃতির আয়োজনকে পেরিয়ে সৃজনশীলতায় । এই উদ্বৃত্তকে রবীন্দ্রনাথ বলেছেন, 'The surplus in men ' বা মানব উদ্বৃত্ত । যাবতীয় মানবগুণের যোগে আমাদের জীবধর্ম, সীমার উপরে অতিরিক্ত এই সত্তাকে রবীন্দ্রনাথ বলেছেন, 'মানবব্রহ্ম' সত্য ধর্মে এই বৃহৎ মানুষকে আমরা আত্মবিষীকৃত করে তুলি । মানবব্রহ্ম হল মানবিক ভূমা। জাগতিক ভূমা আমাদের জ্ঞানের বিষয়, আর মানবিক ভূমা আমাদের সমগ্র দেহমন ও চরিত্রের পরিতৃপ্তি ও পরিপূর্ণতার বিষয়। এই বিষয়গুলোই সুন্দরভাবে ফুটিয়ে তুলেছেন রবীন্দ্রনাথ তাঁর ছোট গল্পগুলোতে।
এই প্রসঙ্গে রবীন্দ্রনাথের "মানুষের ধর্ম " থেকে উদ্ধৃতি দিয়ে বলতে পারি, " আমার বুদ্ধি মানব বুদ্ধি , আমার হৃদয় মানবহৃদয় , আমার কল্পনা মানবকল্পনা । তাকে যতই মার্জনা করি, শোষন করি, তা মানবচিত্ত কখনোই ছাড়তে পারে না । আমরা যাকে বিজ্ঞানী বলি তা মানবুদ্ধিতে প্রমাণিত বিজ্ঞান, আমরা যাকে ব্রহ্মানন্দ বলি তাও মানবের চৈতন্যে প্রকাশিত আনন্দ। এই বুদ্ধিতে, এই আনন্দে যাঁকে উপলব্ধি করি, তিনি ভূমা কিন্তু মানবিক ভূমা । তার বাইরে অন্য কিছু থাকা না থাকা মানুষের পক্ষে সমান । মানুষকে বিলুপ্ত করে যদি মানুষের মুক্তি, তবে মানুষ হলুম কেন ।"
রবীন্দ্রনাথের গল্পের সমাজের মানবতাবাদী ভাবনা গুলো মুক্ত হয়ে ফুটে উঠেছে । তাঁর গল্পে সমাজ জীবনে মানুষের অধিকার, স্বাভাবিক জীবন বিকাশ ও অস্তিত্বের সংকটকে কেন্দ্র করে বাস্তব চিত্র গুলো ফুটে উঠেছে । যেমন- পণ-প্রথার হৃদয়হীনতার ছবি ফুটে উঠেছে দেনা-পাওনা, ঠাকুরদা, পণরক্ষা, হৈমন্তী, অপরাজিতা ইত্যাদি গল্পে ।
'দেনা-পাওনা' গল্পে বিধৃত হয়েছে নির্ধারিত পণ পরিশোধ করতে ব্যর্থ হওয়ায় শ্বশুর বাড়িতে বধুর ওপর নিষ্ঠুর নির্যাতনের ঘটনা ।
'হৈমন্তী' গল্পের পুরুষ গল্পকথকের জবানীতে রবীন্দ্রনাথ প্রণ-প্রথা কবলিত নারীর নিষ্ঠুর অপমাননা জ্বলন্ত ছবি এঁকেছেন । পণ-প্রথা কিভাবে নারীর জীবনকে তিলে তিলে মৃত্যুর দিকে ঠেলে দেয় হৈমন্তী তারই গল্প ।
রবীন্দ্রনাথের মানবতাবাদী দৃষ্টিভঙ্গি গড়ে ওঠার পশ্চাতে তাঁর পারিবারিক প্রভাব ছিল অপরিসীম । মানবজাতির প্রতি গভীর প্রেম ও মানব জীবনের প্রতি এক ইতিবাচক দৃষ্টিভঙ্গির পিছনে তাঁর পারিবারিক উদারনৈতিক ঐতিহ্য অনেকখানি সাহায্য করেছে । তিনি উপলব্ধি করেছিলেন, মানুষ যদি ব্যক্তিগত ক্ষুদ্র ও সংকীর্ণ স্বার্থের জগতে নিজেকে মগ্ন রাখে তাহলে বিহত্তর মানবসত্তা অবহেলিত হয়, বিশ্বজনীন মনুষ্যত্বের উপলব্ধি করতে পারে না ।
কন্যাপণ ও অর্থলোলুপতার বশবর্তী একশ্রেণীর মানুষের অমানবিক রূঢ়তার ছবি পাওয়া যায় 'অপরাজিতা' গল্পে । মানুষের মনুষ্যত্বের লাঞ্ছনার বেদনাকে মূর্ত করা হয়েছে 'রামকানাইয়ের নির্বুদ্ধিতার' গল্পে । এই গল্পে সত্যনিষ্ঠ ধর্মেভীরু মানুষের মনুষ্যত্বের লাঞ্ছিত ও উপেক্ষিত হওয়ার অসহায় বেদনাকে রামকানাই চরিত্রের মাধ্যমে প্রকাশ করা হয়েছে ।
মানবতন্ত্রী রবীন্দ্রনাথ জীবনের শেষ নিঃশ্বাস থাকা পর্যন্ত মনুষ্যত্বের জয়ে আস্থা রেখেছিলেন । তাঁর যাবতীয় চিন্তা ভাবনার কেন্দ্রে ছিল মানুষ । রবীন্দ্রনাথের গভীর উপলব্ধিতে ধরা পড়েছিল যে, মানুষ নিছক এক ইন্দ্রিয়সর্বস্ব প্রাণী নয়, তার মধ্যে রয়েছে অসীম ক্ষমতা, অনন্ত সম্ভাবনা ও ঐশ্বর্যের বিপুল ভান্ডার ।
সামাজিক বিবেচনাহীনতার বিরুদ্ধে তীব্র প্রতিক্রিয়ার পরিচয় রয়েছে রবীন্দ্রনাথের 'বিচারক' গল্পে । যে পুরুষ নারীত্বের রহিমাকে ধুলায় লুটিয়ে দিয়েছে তাকে বিচারকের আসনে বসিয়ে বিবেকহীন সমাজের বিরুদ্ধে ও মানবিকতার পক্ষে রবীন্দ্রনাথ প্রতিবাদমুখর হয়েছেন এই গল্পে ।
রবীন্দ্রনাথের দৃষ্টিতে মানুষের একদিকে আছে তার ব্যক্তিসত্তা বা জৈবিকসত্তা বা অহং এবং অন্যদিকে আছে তার মানবসত্তা বা পরমসত্তা বা বিশ্বজনীন সত্তা । মানুষের পরিচয় পেতে হলে তাই তার ব্যক্তি সত্তাকে জানলেই যথেষ্ট হবে না, সেই বিরাট বিশ্বসত্তা কে জানতে হবে । কেন-না রবীন্দ্রনাথের ভাষায় -- একদিকে মানুষের অবস্থান যেমন তার ব্যক্তিগত জীবন জীব সীমানায়,তেমনি অপরদিকে তার অবস্থান ওই সীমানা অতিক্রম করে বিরাটে।
মানবতাবাদী রবীন্দ্রনাথ তাঁর কয়েকটি গল্পে জাতীয় চেতনা ও সাম্রাজ্যবাদ বিরোধী চেতনাকে প্রকাশ ঘটিয়েছিলেন । তবে এ কথা স্মরণীয় যে, তিনি বিশ্বাস করতেন জীবন সমস্ত রাজনৈতিক আলোড়নের ঊর্ধ্বে । সেই জীবনের পূর্ণমূল্য দিয়েই মানুষের সামাজিক কল্যাণ করা সম্ভব । তাঁর 'মেঘ ও রৌদ্র' গল্পে ইংরেজদের আমলাতন্ত্রের নিষ্ঠুর বর্বরতাকে চূড়ান্ত ধিক্কার জানানো হয়েছে । ইংরেজ শাসক, মালিক, ম্যানেজার ও বিচারকের জুলুম, আইনের প্রতি সম্পূর্ণ অবজ্ঞা,শাসিত জাতির প্রতি জুলুম ও দম্ভ ইত্যাদি বাস্তব ছবি ফুটে উঠেছে ।
গভীর মানবতাবাদী উদ্দীপিত রবীন্দ্রনাথ বুঝিয়েছেন -- মানুষকেও দেবতার কত বেশি প্রয়োজন । বস্তু রবীন্দ্রনাথ তাঁর মানবতাবাদের মধ্যে এক অফুরন্ত শক্তিকে অনুভব করেছেন । সত্যের আনন্দ রূপকে বাস্তবের মানবদেহপটে মূর্তি লাভ করতে দেখেছেন । সেই অনুভূতি তিনি প্রকাশ করেছেন তাঁর নানা কাব্য, সাহিত্যে ও ছোট গল্পগুলোতে । তিনি তার ছোট গল্পগুলোতে বুঝিয়েছেন, মনের মধ্যে মানবতার প্রদীপ জ্বেলে মানবযাত্রী যুগযুগান্তর ধরে এগিয়ে চলছে সত্যের খোঁজে । তার জন্যে ধন-মান - প্রান ও ক্ষুদ্রতাকে বলি দিয়েছে বারংবার । তাই রবীন্দ্র - অনুভূত মানবতাবাদকে মর্ত- অমর্তের মেলবন্ধন বলা চলে ।
রবীন্দ্রনাথের প্রতিটি গল্পে আমরা এই মানবতাকে বা মানবধর্মকে খুঁজে পাই । মানুষের ব্যথা ও বেদনার অনেক কারণ, এই দুঃখবেদনা শুধুমাত্র সরকারি দাক্ষিণ্যে বা আইন প্রণয়ন করে দূরকরা সম্ভব নয় । এর জন্য ভালো মানুষের দরকার । মানবসেবার কাজে সবাইকে নিযুক্ত হতে হবে । আইন করে মানবধর্ম রক্ষা করা যায় না, তার জন্য হৃদয়ের প্রসার দরকার । 'স্ত্রীর পত্র' গল্পে রবীন্দ্রনাথ নারী মুক্তির প্রসঙ্গ টেনেছেন ব্যক্তিত্বসচেতন নারী মৃণালের জবানীতে আত্মবিশ্লেষণের মাধ্যমে । মৃণাল সংসারে অন্যায় অবিচার, হৃদয়হীনতা ও বৈষম্য সইতে না পেরে অবশেষে বিদ্রোহ করেছে । তার বিদ্রোহী নারী হৃদয় হৃদয়হীন সংসারের শৃংখল থেকে বের হয়ে লাভ করেছে মুক্তির স্বাদ । 'বদনাম' গল্পের সৌদামিনীও এমনিভাবে বিদ্রোহী হয়েছে । সুতরাং দেখা যাচ্ছে কাব্য ও প্রবন্ধে রবীন্দ্রনাথ যেমন মানবতার বাণীকে বাক্সময় করে তুলেছিলেন তেমনি তাঁর ছোটগল্পেও বিচিত হয়েছে তার বহুবর্ণিল ছবি ।
গল্পে নারীর রূপ সম্পর্কে পুরুষতান্ত্রিক সমাজের দৃষ্টিভঙ্গি ও স্বরূপ তুলে ধরে রবীন্দ্রনাথ দেখেছেন যে, তা নারীর মানবিক জীবন চেতনার পথে প্রতিবন্ধকতা স্বরূপ । 'খাতা' গল্পের বালিকা বধূ উমা লেখাপড়ায় আগ্রহ দেখাতে গিয়ে বিরম্বিত হয়েছে তথাকথিত শিক্ষিত স্বামীর কাছে । 'পয়লা নম্বর' গল্পে বুদ্ধিজীবী পুরুষের নিষ্ঠুর নিস্পৃহতা ও কর্তৃত্বপরায়ণ ক্ষমতা বলয়ের বলয়ে পড়া নারীর অবমাননার স্বরূপ ও তার অন্তর্বেদনার রূপটি ফুটে উঠেছে । এক কথায় সামন্তবাদী সমাজব্যবস্থায় নারীর প্রতি অন্যায়-অবিচার ও নারীর অধিকারহীনতার স্বরূপ রবীন্দ্রনাথ উদঘাটন করেছেন তার ছোটগল্পগুলোতে । শুধু তাই নয়, এই অমানবিক সমাজের বেড়াজাল ভেঙ্গেচুরে বের হয়ে আসার প্রেরণাও তাঁর গল্পে রয়েছে । 'স্ত্রীর পত্র' গল্পে সমাজে নারীর মুক্তিপথের নানা অন্তরায় তাঁকে গভীরভাবে আলোড়িত করেছিল । পণপ্রথা, সহমরণ, বিধবা বিবাহ ও বহুবিবাহের মতো যে সমস্ত সমস্যা সেকালে পারিবারিক ও সামাজিক জীবনে নারীর অবস্থানকে অমর্যাদাকর ও সংকটাপন্ন করে তুলেছিল পাশ্চাত্যের নারীর অবস্থান, অধিকার ও মর্যাদার আলোয় রবীন্দ্রনাথ তাকে বিচার করেছিলেন । স্বভাবতই নারীমুক্তির প্রসঙ্গ হয়েছিল তার ভাবনার বিষয়ে আর তাই নারীর পক্ষে পূর্ণ সহানুভূতি লক্ষ্য করা যায় রবীন্দ্রনাথের ছোটগল্পগুলোতে । নিষ্ঠুর সমাজ শাসনে নারীর অসহায় অবস্থার ছবি তুলে ধরে তাই তিনি যেন চাবুক মেরে সমাজের চেতনাকে জাগাতে চেয়েছেন । সন্ন্যাসীর স্ত্রী কুসুমের বঞ্চিত জীবনের হাহাকারকে তিনি বাক্সময় করে তুলেছিলেন 'ঘাটের কথা' গল্পে। জীবিত ও মৃত গল্পের দুর্ভাগা কাদম্বিনীকে মরে প্রমাণ করতে হয়েছে যে সে মরেও মরেনি । 'কঙ্কাল' গল্পে নারীর রূপ সম্পর্কে পুরুষতান্ত্রিক সমাজের স্বরূপ তুলে ধরেছিলেন রবীন্দ্রনাথ । নিম্নস্তরের মেয়েকে জীবনসঙ্গিনী করে বর্ণাশ্রয়ী সমাজের মানবিকতার বিরুদ্ধে মানুষের মহিমাকে বড় করে দেখিয়েছিলেন ।
রবীন্দ্রনাথের অনেকগুলো গল্পে সমাজের নিচুতলার নিপীড়িত,লাঞ্ছিত মানুষের প্রতি ভালবাসার অসুখী প্রকাশ ঘটেছে । যেমন -- চিরস্থায়ী বন্দোবস্তের নিষ্ঠুরতায় একদিকে জমিদারদের জীবন উৎসবমুখর হলেও দরিদ্র মানুষের জীবনে যে বিপর্যয় নেমে এসেছে তার মর্মান্তিক ছবি আঁকা হয়েছে 'শাস্তি'গল্পে । 'মুসলমানি গল্পে' রবীন্দ্রনাথ সাম্প্রদায়িক সম্প্রীতির ওপর জোর দিয়েছিলেন । তাঁর এই গল্পে ধর্মনিরপেক্ষ হৃদয়ধর্মের প্রতি তাঁর আজন্মআকর্ষণ তীব্র ও স্পষ্ট হয়ে উঠেছে । মানবতাবাদী রবীন্দ্রনাথ নারী সমাজের মর্যাদা ও মহিমার পক্ষেও কলম ধরেছিলেন । পুরুষ শাসিত সমাজে নারীর মুক্তিপথের নানা অন্তরায় তাঁকে গভীরভাবে আলোড়িত করেছিল । জাতিভেদ, বর্ণভেদ, ধর্মহীনতা সব ক্ষেত্রে রবীন্দ্রনাথ সবার উপরে মানুষের মহিমাকেই বড় করে দেখিয়েছেন । তাই 'রবিবার' গল্পের অভিককে দিয়ে তিনি বলিয়েছিলেন, "যে দেশে দিন-রাত্রি ধর্ম নিয়ে খুনাখুনি সে দেশে সর্ব ধর্মকে মেলাবার পুণ্যব্রত আমার মতো নাস্তিকেরই।" ল্যাবরেটরি গল্পের নন্দকিশোর সামাজিক অর্থে ধর্মকে স্বীকার করেন নি । এবং মোহিনীর মতো নিম্নস্তরের মেয়েকে জীবনসঙ্গিনী করে বর্ণশ্রয়ী সমাজের মানবিকতার বিরুদ্ধে মানুষের মহিমাকেই বড় করে দেখিয়েছেন ।
No comments:
Post a Comment