রূপচাঁদ পক্ষী : কবি শক্তি চট্টোপাধ্যায়
পার্থ বন্দ্যোপাধ্যায়
"যেখানেই থাকো,এপথে আসতেই হবে
ছাড়ান নেই
সম্বল বলতে সেই দিন কয়েকের গল্প
অল্প অল্পই।
আমি যাই, তোমরা পরে এসো
ঘড়ি ঘন্টা মিলিয়ে শাক সবজি বিলিয়ে
তোমরা এস। "
এক অসাধারণ জীবনবোধের কবি ছিলেন কবি শক্তি চট্টোপাধ্যায়।জীবনানন্দ-পরবর্তী কালের
আধুনিক বাংলা সাহিত্যের জগতে যে কজন কবি বা সাহিত্যিক নিজের স্বতন্ত্র বোধে উজ্জ্বল তিনি তাঁদের অন্যতম এবং বাংলা সাহিত্য সেবায় নিয়োজিত একজন প্রধান ঋত্বিক। আমাদের মনের মানুষ,প্রাণের কবি
শক্তি চট্টোপাধ্যায়২৫ শে নভেম্বর, ১৯৩৩ সাল জন্মগ্রহণ করেন। তিনি ছিলেন একজন বাঙালী কবি, ঔপন্যাসিক, লেখক ও অনুবাদক, যিনি জীবনানন্দ-উত্তর যুগের আধুনিক বাংলা সাহিত্যের একজন প্রধান কবি হিসেবে বিবেচিত। বিংশ শতাব্দীর শেষ ভাগে তিনি বিশেষভাবে পরিচিত এবং আলোচিত ছিলেন। ষাটের দশকে যে চারজন কবিকে হাংরি আন্দোলনের জনক মনে করা হয় তাদের মধ্যে শক্তি চট্টোপাধ্যায় অন্যতম।
১৯৮২ সালে প্রকাশিত তাঁর "যেতে পারি কিন্তু কেন যাবো ?" কাব্যগ্রন্থ ইংরেজি এবং মৈথিলী ভাষায় অনূদিত হয়েছে। ১৯৭৪ সালে তিনি পূর্ণেন্দু পত্রী পরিচালিত 'ছেঁড়া তমসুখ' চলচ্চিত্রে অভিনয় করেন। শক্তি চট্টোপাধ্যায় দক্ষিণ
চব্বিশ পরগণা জেলার জয়নগরে জন্মগ্রহণ করেন। তাঁর মা কমলা দেবী এবং বাবা বামানাথ চট্টোপাধ্যায়, যিনি কলকাতার দ্য কাশিমবাজার স্কুল অব ড্রামায় পড়তেন। চার বছর বয়সে শক্তির বাবা মারা যান এবং পিতামহ তাঁর দেখাশোনা শুরু করেন। ১৯৪৮ সালে শক্তি কলকাতার বাগবাজারে আসেন এবং মহারাজা কাশিম বাজার পলিটেকনিক বিদ্যালয়ে চতুর্থ শ্রেণিতে ভর্তি হন। সেখানে তিনি বিদ্যালয়ের এক শিক্ষকের কাছে মার্কসবাদের পরিচিতি লাভ করেন। ১৯৪৯ সালে তিনি প্রগতি লাইব্রেরি প্রতিষ্ঠা করেন এবং "প্রগতি" নামে একটি হাতে-লেখা পত্রিকা প্রকাশ করতে শুরু করেন, যা খুব শীঘ্রই পরবর্তীতে মুদ্রিত রূপ নেয় এবং পুনরায় নাম বদলে "বহ্নিশিখা" রাখা হয়।১৯৫১ সালে তিনি ম্যাট্রিকুলেশন পরীক্ষায় উত্তীর্ণ হন এবং সিটি কলেজে ভর্তি হন তার এক মামার কাছে, যিনি ছিলেন একজন ব্যবসায়ী এবং তখনকার অভিভাবক, যিনি শক্তির হিসাবরক্ষকের চাকরি পাইয়ে দেওয়ার প্রতিশ্রুতি দেন। ১৯৫৩ সালে তিনি আই কম (বাণিজ্য) পরীক্ষায় উত্তীর্ণ হন। যদিও তিনি বাণিজ্য বিভাগের পড়া ছেড়ে বাংলা সাহিত্যে স্নাতক হওয়ার জন্যে প্রেসিডেন্সি কলেজে ভর্তি হন, কিন্তু পরীক্ষায় বসেন নি।১৯৫৬ সালে শক্তিকে তাঁর মামার বাড়ি ছেড়ে আসতে হয়েছিল এবং তিনি তাঁর মা
ও ভাইয়ের সঙ্গে উল্টোডাঙ্গায় একটি বস্তিতে চলে যান। সে সময়ে তিনি সম্পূর্ণরূপে তাঁর ভাইয়ের স্বল্প আয়ের ওপর নির্ভরশীল ছিলেন। দারিদ্রের কারণে শক্তি স্নাতক পাঠ অর্ধসমাপ্ত রেখে প্রেসিডেন্সি কলেজ ত্যাগ করেন এবং সাহিত্যকে জীবিকা করার উদ্দেশ্যে উপন্যাস লেখা আরম্ভ করেন। শক্তি চট্টোপাধ্যায় বিভিন্ন পেশায় নিয়োজিত থাকলেও কোনো পেশায় দীর্ঘস্থায়ী ছিলেন না। একসময় তিনি দোকানের সহকারী হিসেবে "সাক্সবি ফার্মা" লিমিটেডে কাজ করেছেন। এবং পরে ভবানীপুর টিউটোরিয়াল হোমে (হ্যারিসন রোড শাখায়) শিক্ষকতা করেন। ব্যবসা করার চেষ্টাও করেছিলেন এবং ব্যর্থ হওয়ার পর একটি মোটর কোম্পানিতে জুনিয়র এক্সিকিউটিভ হিসেবে যোগ দেন। তিনি ১৯৭০ থেকে ১৯৯৪ সাল পর্যন্ত কলকাতার আনন্দবাজার পত্রিকায় কাজ করেছেন।
শক্তি চট্টোপাধ্যায় মীনাক্ষী চট্টোপাধ্যায়কে বিয়ে করেছিলেন, যিনি একজন লেখিকা। ১৯৬৫ সালে আড্ডার মধ্য দিয়ে তাদের প্রথম সাক্ষাত ঘটে। তাদের মেয়ে তিতি চট্টোপাধ্যায়।
মার্চ ১৯৫৬ সালে, শক্তির কবিতা "যম" বুদ্ধদেব বসু প্রকাশিত কবিতা সাহিত্য পত্রিকায় প্রকাশিত হয়। এরপর তিনি কৃত্তিবাস এবং অন্যান্য পত্রিকার জন্য লিখতে শুরু করেন।
বুদ্ধদেব বসুও তাঁকে নব প্রতিষ্ঠিত যাদবপুর বিশ্ববিদ্যালয়ে তুলনামূলক সাহিত্য কোর্সে যোগ দিতে আমন্ত্রণ জানান। শক্তি কোর্সে যোগদান করলেও সম্পূর্ণ করেন নি। প্রথম উপন্যাস লেখেন কুয়োতলা। কিন্তু কলেজ - জীবনের বন্ধু সমীর রায়চৌধুরীর সঙ্গে তার বনাঞ্চল - কুটির চাইবাসায় আড়াই বছর থাকার সময়ে শক্তি চট্টোপাধ্যায় একজন সফল লিরিকাল কবিতে পরিণত হন। একই দিনে বেশ কয়েকটি কবিতা লিখে ফেলার অভ্যাস গড়ে ফেলেন তিনি। শক্তি নিজের কবিতাকে বলতেন পদ্য। ভারবি প্রকাশনায় কাজ করার সূত্রে তাঁর শ্রেষ্ঠ কবিতার সিরিজ বের হয়। পঞ্চাশের দশকে কবিদের মুখপত্র কৃত্তিবাস পত্রিকার অন্যতম কবি হিসেবে প্রতিষ্ঠিত হন। তাঁর প্রথম কাব্যগ্রন্থ 'হে প্রেম,
হে নৈঃশব্দ' ১৯৬১ সালে প্রকাশিত হয় দেবকুমার বসুর চেষ্টায়। ১৯৬১ সালের নভেম্বরে ইশতেহার প্রকাশের মাধ্যমে যে চারজন কবিকে হাংরি আন্দোলনের জনক মনে করা হয় তাদের মধ্যে শক্তি চট্টোপাধ্যায় অন্যতম। অন্য তিনজন হলেন সমীর রায়চৌধুরী, দেবী রায় এবং মলয় রায়চৌধুরী। শেষের তিনজনের সঙ্গে সাহিত্যিক মতান্তরের জন্য ১৯৬৩ সালে তিনি হাংরি আন্দোলন ত্যাগ করে কৃত্তিবাস গোষ্ঠীতে যোগ দেন। তিনি প্রায় ৫০টি হাংরি বুলেটিন প্রকাশ করেছিলেন। পরবর্তীকালে কৃত্তিবাসের কবি সুনীল গঙ্গোপাধ্যায় ও শক্তি চট্টোপাধ্যায়ের নাম সাহিত্যিক মহলে একত্রে উচ্চারিত হতো। যদিও সুনীল গঙ্গোপাধ্যায় হাংরি আন্দোলনের ঘোর বিরোধী ছিলেন এবং কৃত্তিবাস পত্রিকায় ১৯৬৬ সালে সেই মনোভাব প্রকাশ করে সম্পাদকীয় লিখেছিলেন। তাঁর উল্লেখযোগ্য কাজগুলো হ'ল
"অবনী বাড়ি আছো" - কবিতা, কাব্যগ্রন্থ: ধর্মে আছো জিরাফেও আছো (১৯৬৫) ১৯৭৫ তিনি আনন্দ পুরস্কার লাভ করেন। ১৯৮২ সালে, তাঁর যেতে পারি কিন্তু কেন যাবো ? (১৯৮৩) কাব্যগ্রন্থের জন্য তিনি সাহিত্য অ্যাকাদেমি পুরস্কার লাভ করেন। এছাড়া তিনি একাধিক পুরস্কার পেয়েছেন।
শক্তি চট্টোপাধ্যায়ের কাব্যগ্রন্থ
এ প্রেম হে নৈঃশব্দ্য (১৯৬২),ধর্মে আছো জিরাফেও আছো (১৯৬৭),সোনার মাছি খুন করেছি (১৯৬৮),অন্ধকার নক্ষত্রবীথি তুমি অন্ধকার (১৯৬৮),হেমন্তের অরণ্যে আমি পোস্টম্যান (১৯৬৯),চতুর্দশপদী কবিতাবলী (১৯৭০),পাড়ের কাঁথা মাটির বাড়ি (১৯৭১),প্রভু নষ্ট হয়ে যাই (১৯৭২),সুখে আছি (১৯৭৪),ঈশ্বর থাকেন জলে (১৯৭৫),অস্ত্রের গৌরবহীন একা (১৯৭৫),জ্বলন্ত রুমাল (১৯৭৫),ছিন্নবিচ্ছিন্ন (১৯৭৫),সুন্দর এখানে একা নয়,(১৯৭৬),কবিতায় তুলো ওড়ে (১৯৭৬),ভাত নেই পাথর রয়েছে (১৯৭৯),আঙ্গুরী তোর হিরণ্য জল (১৯৮০),প্রচ্ছন্ন স্বদেশ (১৯৮১),যেতে পারি কিন্তু কেন যাবো (১৯৮৩),কক্সবাজারে সন্ধ্যা (১৯৮৫)
ও চির - প্রণম্য অগ্নি (১৯৮৫),মিষ্টি কথায়, বিষ্টিতে নয় (১৯৮৫),সন্ধ্যার সে শান্ত উপহার (১৯৮৬),এই তো মর্মর মূর্তি (১৯৮৭),বিষের মধ্যে সমস্ত শোক (১৯৮৮),আমাকে জাগাও (১৯৮৯)
ছবি আঁকে ছিঁড়ে ফ্যালে (১৯৯১),জঙ্গলে বিষাদ আছে (১৯৯৪),বড়োর ছড়া (১৯৯৪),সেরা ছড়া (১৯৯৪),টরে টক্কা (১৯৯৬),কিছু মায়া রয়ে গেল (১৯৯৭),সকলে প্রত্যেকে একা (১৯৯৯),পদ্যসমগ্র - ১ম থেকে ৭ম খণ্ড।
রুপচাঁদ পক্ষী ছাড়াও স্ফুলিঙ্গ সমাদ্দার ছদ্মনামে তিনি অনেক প্রবন্ধ, নিবন্ধ লিখে গিয়েছেন। ২৩ শে মার্চ ১৯৯৫ সালে আমাদের প্রাণের কবি চলে যান না ফেরার দেশে। কবি শক্তি চট্টোপাধ্যায়ের নাম সর্বকালে বাংলা সাহিত্যের ইতিহাসে উজ্জ্বল হয়ে থাকবে।
****************************** *
(ঋণ স্বীকার : সনৎকুমার বটব্যাল, সম্পাদক পৃত্থী সাহিত্য পত্রিকা, উইকিপিডিয়া ও সমসাময়িক পত্র পত্রিকা)
No comments:
Post a Comment