Monday, December 2, 2024


 

জেনোসাইড এবং.....
তাসনিম জারিন









হোটেল থেকে বেরুবার সময় রিয়াদ বারবার জিজ্ঞেস করছিল, " ভেবে দেখো, যাবে তো? " , আমি ততোধিক জোরের সঙ্গে বলি, " নিশ্চয়ই! " । এ যাবৎ রিয়াদের দুটি জেনোসাইড মিউজিয়াম ঘুরে দেখবার অভিজ্ঞতা হয়েছে, পোল্যান্ডের অশউৎজ্ এবং বিরকানেও। সুতরাং, সে এর বিভীষিকা সম্পর্কে ওয়াকিবহাল। যদ্যপি, কে না জানে এসব জায়গা সুখকর ভ্রমণ স্মৃতি তৈরীর জন্য নয়। আর আমি বরাবরই দুর্বল চিত্ত, অল্পেই ভেঙে পড়ি। তাই তার এত উৎকন্ঠা। ক্লুক ( Klook) ট্র্যাভেলস্ থেকে ট্যুর বাস বুক করি, এসি বাস, দুটি স্পটে নিয়ে যাবে, হোটেল থেকে পিক আপ এবং ড্রপ অফ এবং বাসে একটি ডকুমেন্টারি ফিল্ম দেখানো হয়, Pol Pot : Secret Killer , জন প্রতি ১৫.৬ ডলার। 


প্রথমে যাই, Tuol Sleng Genocide Muesem, এটি মূলত কম্বোডিয়ান জেনোসাইডের স্মৃতিতে তৈরী। কম্বোডিয়ার রাজধানী নম পেন ( Phnom Penh ) শহরে অবস্থিত। একটি সেকেন্ডারী স্কুলকে জেলখানা হিসেবে ব্যবহার করা হত কুখ্যাত খামের রুজ বা ডেমোক্রেটিক কাম্পুচিয়া সরকারের আমলে ( ১৯৭৫ - ১৯৭৯)। জেলের নাম, সিকিউরিটি অফিস 21 বা এস-21। এস-21 সারা দেশে একটি বিশাল কারাগার ব্যবস্থার কেন্দ্র হিসাবে কাজ করত যেখানে শাসনব্যবস্থার "রাজনৈতিক শত্রু" হিসেবে বিবেচিত ব্যক্তিদের আটক, জিজ্ঞাসাবাদ, নির্যাতন এবং নিধন করা হতো। দোষের অংশীদার হিসেবে, অনেক সময় পুরো পরিবারকে এই কেন্দ্রে আটক করা হত। ১৯৭৫ থেকে ১৯৭৯ সালের মধ্যে কারাগার থেকে খুব কম সংখ্যক বন্দী মুক্তি পেয়েছিল। যখন নম পেন মুক্তি লাভ করে, তখন এস-২১-এর মাত্র ১২ জন প্রাক্তন বন্দী বেঁচে ছিলেন। তাদের মধ্যে চারজন শিশু ছিল। পোল পোট এই খামের রুজের শাসক এবং হত্যাকাণ্ডের কান্ডারী। পোল পোট কম্বোডিয়ান কমিউনিস্ট বিপ্লবী হিসেবে আত্মপ্রকাশ করলেও শেষে একজন ডিক্টেটরে পরিণত হন। প্রায় বিশ লক্ষ মানুষ হত্যা করা হয় যা তদানীন্তন জনসংখ্যার প্রায় ২৫ শতাংশ। সর্বোপরী, চার বছরের সরকার প্রায় ২৫ শতাংশ মানুষ মেরেছে, দুর্ভাগ্যজনক সময় এবং সময়ের এই খতিয়ান। 








মিউজিয়ামটিতে মূলত পরিকাঠামোগতভাবে পাঁচটি বিল্ডিং রয়েছে, A, B, C, D, E। খেমার রুজের দ্বারা নম পেন বিজয়ের পর এই সম্মিলিত ক্যাম্পাসটি একটি নিরাপত্তা কেন্দ্র হিসেবে ব্যবহৃত হয়েছিল, যেখানে বন্দিদের পদ্ধতিগতভাবে জিজ্ঞাসাবাদ করা হতো। স্কুলের শ্রেণীকক্ষগুলোকে কারাগারের কক্ষ এবং অত্যাচার কক্ষে রূপান্তরিত করা হয়েছিল। পুরো ক্যাম্পাসটি বৈদ্যুতিক কাঁটাতারের বেড়া দিয়ে ঘেরা ছিল। ভবনের পৃথক অংশগুলোর বাইরের পথগুলোতেও কাঁটাতারের বেড়া লাগানো হয়েছিল যাতে হতাশ বন্দিরা আত্মহত্যা করতে না পারে।

বিল্ডিং A-এর নিচতলায় একটি শ্রেণীকক্ষকে দুটি কক্ষে বিভক্ত করা হয়েছিল, যেখানে খেমার রুজের উচ্চপদস্থ ব্যক্তিদের রাখা হতো যাদের বিশ্বাসঘাতক হিসেবে অভিযুক্ত করা হয়েছিল। অন্যদিকে, ভবন B, C এবং D-র নিচতলায় শ্রেণীকক্ষগুলোকে ০.৮ x ২ মিটার আকারের ছোট কক্ষে বিভক্ত করা হয়েছিল, যা ইট দিয়ে তৈরি ছিল এবং প্রথম তলায় কাঠ দিয়ে। এই ছোট কক্ষগুলো একক বন্দির জন্য ডিজাইন করা হয়েছিল। দ্বিতীয় তলায় বড় কক্ষ ছিল, যেখানে ৪০ থেকে ৫০ জন বন্দি রাখা হতো। এস-২১-এ পৌঁছানোর পর বন্দীদের ছবি তোলা হতো এবং রক্ষীরা তাদের নিজেদের সম্পর্কে এবং তাদের নেটওয়ার্ক সম্পর্কে তথ্য দিতে বাধ্য করত। বন্দীদের তাদের শৈশব থেকে শুরু করে গ্রেফতারের তারিখ পর্যন্ত বিস্তারিত জীবনবৃত্তান্ত দিতে হতো। বন্দীদের পোশাক খুলিয়ে ফেলা হতো এবং তাদের সমস্ত ব্যক্তিগত সম্পত্তি বাজেয়াপ্ত করা হতো। এরপর তাদের কক্ষে নিয়ে যাওয়া হতো। বন্দীরা মেঝেতে চাটাই, মশারী বা কম্বল ছাড়াই শুতো। সবাইকে কঠোর নিয়ম মেনে চলতে হতো; অন্যথায়, তাদের চাবুক মারা বা বৈদ্যুতিক শক দিয়ে শাস্তি দেওয়া হতো। 








খেমার রুজ পতনের পর এবং মুক্তি বাহিনী শহরে প্রবেশ করার সময় এস-২১ সাইটে ১২ জন লোক পালিয়ে বাঁচতে সক্ষম হয়েছিল, যার মধ্যে ৪টি শিশু ছিল। এদের মধ্যে ২০১৬ সালে মাত্র ৪ জন জীবিত ছিল: চুম মেয়, বউ মেং, নরং চানফাল এবং তার ভাই নরং চানলি, যারা সেই সময় শিশু ছিল। আরও দুই শিশুকে জীবিত বলে মনে করা হয়, কিন্তু তাদের নাম জানা যায়নি, কারণ খেমার রুজের পতনের পর তাদের এতিমখানায় নিয়ে যাওয়া হয়েছিল। জীবিত সারভাইভাররা নিয়মিত মিউজিয়ামে আসেন, বই বিক্রি করেন এবং ট্যুরিস্টদের সঙ্গে আলাপ আলোচনায় বেশ সহজ। আমরা চুম মেয় এর দেখা পাই, উনি এখন অশীতিপর বৃদ্ধ , বই কিনি এবং ছবি তুলি। ওনার সঙ্গে ছবি তোলার সময় উনি প্রতিবার নিরলসভঙ্গীতে বইটি চিবুকের কাছে ধরছিলেন এবং ম্মিত হাসছিলেন, আমরা যাকে বলি পোজ দেওয়া। সেই হাসি অকৃত্রিম এবং অমলিন। মিউজিয়ামে এক একটি বিবরণ পড়তে পড়তে আমার চেয়ে রিয়াদকে বেশি অবিন্যস্ত দেখাচ্ছিল, প্রতিটা ঘর ঘুরে দেখার পর সে ছুটে বেঞ্চে গিয়ে বসছিল, একটু সময় নিয়ে পরের ঘরে ঢুকছিল। 






বাস ৩টে ৪০ এ ছাড়বে পরের গন্তব্যের জন্য, বাস ছাড়লো। ডকুমেন্টারি শুরু হল। বলাই বাহুল্য, ডকুমেন্টারিটি পোল পোটের রাজনৈতিক জীবনকেন্দ্রিক। পরের গন্তব্য Choeung Ek Genocidal Center যা Killing Field নামে পরিচিত। মূল ফনম্ পেন শহর থেকে ১৭ কিলোমিটার দক্ষিণে ডাংকাও অঞ্চলে অবস্থিত। কাজেই ট্রাফিকের কারণে ৪০-৪৫ মিনিট সময় লাগে, মেকং নদীর ওপর ক্রুজেও এখানে পৌঁছনো যায়, গাড়িতে তো বটেই। বাসে করে মেকং এর ধার বরাবর চললাম। কম্বোডিয়ার ওপর দিয়ে লোয়ার মেকং বইছে, আপার মেকং চায়নার ওপর দিয়ে। পৌঁছে টিকিট কেটে ঢোকা হল। একটি ফলের বাগানকে খামের শাসনকালে গণহত্যার জন্য ব্যবহৃত হতো। এই শাসনের পতনের পর এখানে ভুক্তভোগীদের দেহাবশেষ উত্তোলন করা হয়েছিল, যাদের সাধারণত গুলি অপচয় এড়াতে কুঠার দিয়ে হত্যা করা হতো এবং পরে গণকবরে সমাহিত করা হতো। স্মৃতিসৌধ হিসেবে এর মাঝ বরাবর একটি বৌদ্ধস্তূপ রয়েছে। এই স্তূপে অ্যাক্রিলিক গ্লাসের ভেতর ৫,০০০-এরও বেশি মানুষের খুলি রাখা হয়েছে। স্তূপ ছাড়াও সেখানে গর্ত রয়েছে, যেখান থেকে দেহাবশেষ উত্তোলন করা হয়েছে। মানব অস্থি এখনও এই স্থানে ছড়িয়ে-ছিটিয়ে রয়েছে। ট্রাক স্টপ, এক্সিকিউশনার অফিস, রাসায়নিক রাখার জায়গা, অন্যান্য কিলিং টুল স্টোর করবার জায়গা, হত্যার যাবতীয় পদ্ধতির স্থান চিহ্নিত করা রয়েছে। লিখতেও অস্বস্তি বোধ হয়। চার বছরের সরকার দেশকে মৃত্যু উপত্যকা য় পরিণত করে। কমিউনিজম নিয়ে কোনো অধ্যয়ন খামের রুজকে বোঝা ছাড়া সম্পূর্ণ হওয়া উচিত নয়। 







ভারাক্রান্ত হয়ে বেরোই, বাস ছাড়বে সাড়ে পাঁচটায়। শহরতলী এলাকা, ঢিল ছোড়া দূরত্বে একটি স্কুল। কচিকাঁচারা বেরিয়ে আসছে, স্কুলের সামনে মুখরোচকের দোকানপাট, যে যার মতো খাবার কিনছে। বিদেশীদের দেখে উৎসাহভরে হাসছে। একটু অবাকই হলাম, স্কুলের জন্য এইটা কি ঠিক অবস্থান, বাচ্চাদের ওপর প্রভাব ফেলতে পারে। তারপরেই মনে হল, তৃতীয় বিশ্বের অনুন্নত দেশ হিসেবে এদের এতো বিকল্প কোথায়। নাকি এইটা স্রেফ উদাসীনতা। কারণ ফনম্ পেনে বৈভব চোখ ধাঁধানো, বড় শপিং মল, রেস্তোরাঁ, ক্যাসিনো কী নেই। রিয়াদ আমায় বললো " Maybe as a society they are hedonistic. " আমার ও তাই মনে হয়েছে। আবার অযথা সমালোচক হবারও কিছু নেই এ ও মনে হচ্ছে। এইসব ভাবতে ভাবতে গাড়ির দিকে এগোলাম। একটি কবিতা আবছায় মাথায় খেলা করছিল, লাইন স্পষ্ট মনে পড়ে না, তবে খানিকটা এইরকম, প্রত্যেকের নিজের সময়কালকে সবচেয়ে দূর্বিসহ, রাজনৈতিকভাবে অস্থিরতম মনে হয়, আসলে সময় এমনভাবেই প্রবাহমান, পরিবর্তনই ধ্রুব।




No comments:

Post a Comment