পুরোনো সুবাস
অনিতা নাগ
বহুতল এক ফ্ল্যাটের বারো তলা বারান্দায় বসে আছে অনু। যতোদূর চোখ যায় শুধু বাড়ী আর গাড়ী। সূর্যাস্তের রক্তিম আলো ভরা আকাশে দিন ফুরিয়ে সন্ধ্যে নামলে চারদিক ঝলমল করে আলোয়। বহুতলের আলো, সার দেওয়া গাড়ীর আলো। এতো আলোয় মুখ লুকিয়ে ফেলে অভিমানী এক চিলতে আকাশ। ছোটবেলায় অনু ভাবতো যতো উপরে ওঠা যাবে আকাশ ততো কাছে এসে যাবে। তেমনটা যে হবার নয় তা বুঝতে বুঝতেই ছোটবেলা হারিয়ে গেছে। আর এখন তো উঁচু উঁচু ইমারতের আড়ালে ক্রমশঃ আড়াল হচ্ছে আকাশের পরিধি। আজকাল একটা ভয় অনুকে পেয়ে বসেছে, আকাশটা যদি একদিন না দেখতে পায়! ইঁট, কাঠ, পাথরের আড়ালে যদি হারিয়ে যায় পুরো আকাশটা! রোজ সকালে ঘুম ভাঙার পর জানলার পর্দা সরিয়ে একবার দেখে নেয় বহুতলের ফাঁকে বাঁধা পড়া এক চিলতে আকাশটাকে। অভ্যেস হয়ে গেছে। কতোকিছুই তো হারিয়ে যাচ্ছে। শুধু আকাশটা আজো নিজের মতো আছে। ঐ আকাশেই এখনো মন পাখি পাখা মেলে হারিয়ে যেতে পারে। ওই নীল আকাশে সীমানা ছাড়িয়ে বহুতলের ফাঁকে ঐ চিলতে আকাশে মন ভাসিয়ে দেয় অনু। ওইখানটায় নেইকো বাঁধা, নেইকো শাসন। জীবনের স্বাভাবিক সুবাসটুকু ক্রমশঃ যেনো হারিয়ে যাচ্ছে। অনু সাবধানে আগলে রাখে সেই ফেলে আসা দিনগুলোকে।
শরতের পূজো পর্ব মিটতে মিটতে কখন যে শিউলি ঝরানো দিন এসে যায় বোঝা যায় না। হেমন্ত বড্ড নীরবে আসে। বাতাসে ছড়িয়ে দেয় হিমেল পরশ। হেমন্তের সকালে ঘাসের ডগায় শিশির-বিন্দু বড্ড প্রিয় অনুর। ছোটবেলায় হাতের মধ্যে শিশির বিন্দুগুলোকে আগলে রাখতে চাইতো। বুঝতেই পারতো না মুঠো গলে জল হয়ে কখন হারিয়ে যেতে শিশির -বিন্দুগুলো। যেমন হারিয়ে গেছে জীবনের অনেকটা পথ। আজ তো অতীতে সিঁদ কেটে তাদের খুঁজে বেড়ানো। কালি পূজোর দিন চোদ্দ প্রদীপ জ্বালাতে জ্বালাতে আজোও হেমন্তের কথা বড়ো মনে পড়ে। ‘ঘরে ঘরে ডাক পাঠালো দীপালিকায় জ্বালাও আলো’। এই আলো তো আসলে মনের আলো। যে আলোয় মুছে যায় মনের সব মলিনতা। যে আলো ছড়িয়ে পড়ে দিগন্তরে। সেই আলোর রেশটুকু এঁকে দিয়ে অভিমানী হেমন্ত কখন যে নীরবে শীতকে তার জায়গা দিয়ে যায় টের পাওয়া যায় না। হঠাৎই বাতাসে হিমেল পরশে শীতের হাতছানি টের পাওয়া যায়। আজকাল ছোটবেলাটা হুড়মুড়িয়ে এসে উঁকি দেয় সর্বক্ষণ। কেনো যে এমন হয়! মনে পড়ে কতো কথা। সময় বড্ড তাড়াতাড়ি ছুটে চলেছে বল্গাহীন ঘোড়ার মতো। অনুদের মতো যারা পুরোনো দিনের মানুষ তারা সেটা বেশী টের পায়। শীত মানেই মনে পড়ে রঙিন সোয়েটার, কমলালেবু, পাটালি গুড়, মায়ের হাতে রঙিন উল কাঁটা, রান্নাঘরে থলে ভর্তি রকমারী তরকারি, ছাদ বাগানে রঙিন ফুলের মেলা, পাড়ায় সকলে মিলে চড়ুইাতি। স্কুল থেকে ফিরেই ছাদে চলে যেতো অনু। কমলালেবু খেতে খেতে রোদে দেওয়া লেপে গড়াগড়ি খাওয়া, কি যে মজা হতো! তখনকার লেপগুলো খুব ভারী হতো। লাল লেপে সাদা ওয়াড় দেওয়া থাকতো। রোদের ওমে গরম হতো মা, ঠাকুমা’র হাতে বানানো কাঁথা। সেই কাঁথায় কতো যে গল্প বোনা থাকতো! এখন তো বাহারী কম্বল আর জয়পুরি রজাই এর যুগ। মুঠোফোনের একটা ক্লীকে বাড়ীতে এসে যায়। পছন্দ হলে রাখো, নাহলে ফেরত দাও। রান্নাঘরে পিঁড়ে পেতে খেতে বসতো সকলে। শেষ পাতে দুধ-ভাত। সাথে পাটালিগুড়। আহা! যেমন স্বাদ, তেমন গন্ধ। এখন আধুনিকতার ছোঁয়া লেগেছে গেরস্তের রান্নাঘরে। সাবধানী রান্না-বান্না। সারাবছরই পাটালী পাওয়া যায়। কাঁচের বয়ামে পাটালীগুড় ফ্রিজে রেখে দেয় অনু। কিন্তু সেই গুড়ে আগেকার সেই গন্ধ পায় না। চুরি করে কতো যে গুড় খেতো। এখন ভাবলে হাসি পায় অনুর। ছোট্টো ফ্ল্যাটের বারান্দায় পিটুনিয়া, ডালিয়া, চন্দ্রমল্লিকারা কুঁড়ি থেকে যখন ফুটে ওঠে, তখন বাবার কথা বড্ড মনে পড়ে অনুর। বাবার খুব ফুলের নেশা ছিলো। পাড়ার মধ্যে সেরা ডালিয়া ফুটতো বাবার হাতে। এমন কতো গল্প গাঁথা নিয়ে হারিয়ে যাওয়া দিনগুলো সামনে এসে দাঁড়ায়। ফ্ল্যাট বাড়ীর ছোট পরিসরে দুটো মানুষ নিজের মতো করে ভালো থাকার চেষ্টা করে। জীবিকার তাগিদে ছেলে মেয়েরা প্রবাসে। দু'জনের সাবধানী দিনলিপিতে সবকিছুই হিসেব করে সাজানো। আবেগটাও তো মাপের। সেই সাজানো দিনলিপিতে অনু আজো আগলে রাখে মণিমাণিক্যকে ভরা হারিয়ে যাওয়া দিনগুলোকে পরম আদরে আর সোহাগে। যতোদিন স্মৃতি আছে, ততোদিন। তারপরে হয়তো শীতের রাতের কুয়াশা-মাখানো আবছায়ার মতো স্মৃতিরা হারিয়ে যাবে। গুগলে সার্চ করে আগামী প্রজন্ম খোঁজ করবে হারিয়ে যাওয়া দিনগুলোর গল্প কথা। ততোদিন রঙিন উল, পাটালির সুবাস, ডালিয়া, চন্দ্রমল্লিকা, পিটুনিয়ার রঙ, শিশিরের মাথায় শিশিরবিন্দু আর কুয়াশা জড়ানো হেমন্ত আর শীতের আয়েশী দিনগুলোকে আগলে রাখে অনু।
No comments:
Post a Comment