Monday, December 2, 2024


 

বোরখা               

সঞ্জয় পাঠক

 

অনেক দূরের ট্রেন তার চোখ টানে

কেউ তাকে কখনো নিয়ে যায় নি

কু ঝিক ঝিক সরে গেলে

দিগন্ত পরে থাকে সটান

কুয়াশা মাখা ঘাস

দিকচক্রবাল হাতছানি দিয়ে ডাকলেও

বোরখার কাছে সে সব অলিক

 

ওখানে পুকুর ঘাট

তেপান্তরের মাঠ

কামরাঙা গাছের নীচে

হলুদ বিকেল কখন যে ফিকে

দোজবরের সাথে শুক্কুরবার নিকে

স্বামী বুকের কাছে টানে যখন তখন

 

সাবিনা বোরখা প'রে রাস্তা দিয়ে হাঁটে

হাতে ঝোলানো ব্যাগ

টিফিন কৌটোয় ভাত ডাল তরকারি

স্বামীর দোকানে দিয়ে আসে

কেউ তার মুখ যাতে না দেখে

আপাদমস্তক আড়াল

বোরখা যে ইজ্জত!

 

বোরখা প'রে বাজারে হাঁটবে বলে

সাবিনা কখনো সাজে নি

স্নো পাউডার মাখে নি

ভালো কাপড় পড়ে নি

চোখে কাজল দেয় নি

আঁটসাঁটো চুল বাঁধে নি

বোরখার জালের ভিতর তার চোখ দুটি ঢাকা

আহা চোখ দুটি তার কী সুন্দরই না!

একদিন যখন বলেছিলুম

আনত চোখে পায়ের বুড়ো আঙুলে মাটি খুঁড়েছে কেবল

 

পর্দানশীন আয়নায় নিজেকে দেখে রোজ

সেই চোখ কারুর দেখার উপায় নেই

বাজার পেরিয়ে লোকজন পেরিয়ে

তাকে যেতে হয়

মানুষের ভিড় দেখে

বোরখার আড়াল থেকে

 

আমি তবু প্রায়শই

রাস্তায় তাকে রোজ দেখি

চলমান বোরখা

খোলা পায়ের পাতা দেখি

হাতের আঙুল দেখি

কবজি দেখি

কালো বোরখা দেখি

 

ঠোঁটের নীচের তিল দেখি না

বাঁ গালে ব্রণ দেখি না

কপালে এলিয়ে পড়া চুল দেখি না

কালো ভ্রুর মাঝে টিপ দেখি না

নাকফুল দেখি না

বুকের ওঠানামা দেখি না

নাকের ডগায় ঘামের শিশির দেখি না

বোরখার ভিতর থেকে সাবিনা বোঝে

ঠায় দাঁড়িয়ে আছি

একদৃষ্টে তাকিয়ে আছি

 

বোরখার ভিতরেই নাকি তার সম্ভ্রম

সে জানে বাজারে কতকগুলো চোখ তার পিছু নিয়েছে

বামুনের চোখ কায়েতের চোখ

মোল্লার চোখ মৌলবির চোখ

হরিণের চোখ

কাউকে সে চক্ষুবাণে বিদ্ধ করেনি

কারোর গায়ে ঢলে পড়েনি

কোনরকম নাজায়েজ কাজ করেনি

বোরখার ভিতরেই অন্য মানুষ দেখার

এ যেন এক অন্য স্বাধীনতা

 

সে কারোর কালো ভুরু দেখে

টানা নাক কপাল দেখে

গোঁফ দাড়ি দেখে

কাঁধ গলা দেখে

পিঠ বুক দেখে

ঘাড়ে গলায় কোপের দাগ দেখে

কোমরে ঘুনসি দেখে

দেখার এ রকম স্বাধীনতায় সে মুগ্ধ হয়ে যায় কখনো

কাউকে দেখতে ভালো লাগলে

সে দেখবে নাই বা কেন!

 

তার গাছ দেখতে ভালো লাগে

পাখি দেখতে ভালো লাগে

আকাশ দিগন্ত ভালো লাগে

আর দূর থেকে আমাকে

তার কপালে লেগে থাকা খুচরো চুল

বিন্দু বিন্দু ঘাম

জানতে পারে সেই গোপন কথা

 

এক বাজার লোকের সামনে

বোরখা হেঁটে যায়

দোজবরের বিবি হেঁটে যায়

তাকে বোরখা পরিয়ে বাজারে ছেড়ে দিয়েছে

যে মহান মাতব্বরেরা

তাদের দিকে করুণার হাসি হেসেছে কেবল

 

মাতব্বর যেমন ভাবে

রাস্তায় যদি তার নাঙ থাকে

যদি তার সঙ্গে ফস্টিনস্টি করে

পা থেকে মাথা পর্যন্ত

অন্ধকারে চুবিয়ে তাকে পড়িয়ে দিয়েছে জোব্বা

 

বোরখার ভিতর থেকে

সে দেখে কত রঙের জীবন

হাঁ করে দেখতে দেখতে সে ভাবে

অন্যায় হচ্ছে কেউ বলবে না

ফিসফিস কানাকানি হবে না

বাজারে চাউড় কেচ্ছা রটবে না

বাইরে থেকে দরজায় শিকল তুলে

লোক ডেকে ভিড় করবে না

পঞ্চায়েতের বিচার বসবে না

জরিমানা করবে না

বাঁশপেটা করবে না

নাকে খত দেওয়াবে না

মাথা মুড়িয়ে ঘোল ঢালবে না

মুখে কালি দিয়ে গাছে বেঁধে রাখবে না

 

বোরখা প'রে রাস্তা দিয়ে হেঁটে যায় সাবিনা

No comments:

Post a Comment