Monday, December 2, 2024


 


হলুদ চিঠি 

সুদীপা ঘোষ 

 
    "আজ বিকেলের ডাকে তোমার চিঠি পেলাম" ---
          বহু পরিচিত, আমাদের অনেকের প্রিয় একটা গান। সন্ধ্যেবেলা অনিতাপিসি গুনগুন করে গাইছিল গানটা। পুরনো স্মৃতিগুলো ভিড় জমাচ্ছিল মনে আর অনিতাপিসি ভাবছিল, আজকের ছেলেমেয়েদের কাছে এই গান শুধুই একটা ভালো গান। এর আবেগ বা অনুভূতি কোন কিছুই তাদের নিশ্চয়ই স্পর্শ করবে না। এরা যে এখন e-mail , sms, whatsapp , facebook -এর জগতে বিচরণ করছে। মুক্তাক্ষরে লেখা চিঠি, রঙিন খামের গন্ধ, পোস্টকার্ড বা Inland letter,ডাক পিওনের সাইকেলের ক্রিং ক্রিং - আগামী প্রজন্মের কাছে এসব গল্পকথা।
                      অনিতা পিসি বা তার সমসাময়িক মা, মাসি, কাকিমা ,জ্যাঠাইমাদের কাছে চিঠিই ছিল বাইরের জগতের সাথে, আত্মীয়- পরিজনদের সাথে যোগাযোগ রক্ষা করার একমাত্র মাধ্যম। কম্পিউটার, মোবাইল তখন দূর অস্ত। মন খারাপের অলস দুপুরে বিছানায় উপুর হয়ে বুকের নিচে বালিশ রেখে লিখে ফেলো মনের যত সুখ- দুঃখের কথা। তারপর পাঠিয়ে দাও কোন প্রিয়জনের কাছে। সেই মানুষটি যখন এই চিঠি পড়ছে, প্রতিটি ছত্রে যেন অনুভব করছে প্রেরকের অনুভূতি, অক্ষরগুলোও তখন জীবন্ত। কালির দাগে লেখা কথা তো নয়, যেন সে সামনে দাঁড়িয়েই মনের কথা শোনাচ্ছে। আজ সেই একইরকম কথা কোন যান্ত্রিক মাধ্যমে যখন জানাতে চাই ,সেইরকম অনুভূতিই কি স্পর্শ করে তাকে ? মনে তো হয় না। চিঠির শুরুতে 'শ্রদ্ধেয়', 'শ্রীচরণেষু', 'প্রিয় বন্ধু' - শব্দগুলি পত্রপাঠকের মন ছুঁয়ে যেত কতখানি, তা তো বলাই বাহুল্য।
                 আজকের গতিময় জীবনে কারই বা সময় আছে- কাগজ কলম নিয়ে চিঠি লেখো রে; ডাকে পাঠাও রে; অপেক্ষা করে বসে থাকো, কবে সেই চিঠির উত্তর আসবে। যুগের পরিবর্তনের সঙ্গে তাল মিলিয়ে চলতে না পারলে জীবনও যে তার ছন্দ হারিয়ে ফেলে। এগিয়ে চলার নামই তো জীবন। দিন বদলের সাথে প্রযুক্তির উন্নতিকে অস্বীকার করার তো প্রশ্নই ওঠে না।
                তবুও, কখনও কখনও ফেলে আসা দিনই যেন বেশি মধুর, পুরনো পন্থাই যেন বেশি আবেগঘন, হৃদয়স্পর্শী। এই দেখো না, কিছুদিন আগেও তো, নতুন বছরের শুরুতে বা দুর্গাপুজোর দশমী পেরিয়ে গেলেই সব বাড়িতেই একজন- দুজন করে বসে পড়ত কলম হাতে, আত্মীয়-পরিজনদের প্রণাম, স্নেহ- ভালোবাসা, আশীর্বাদ জানাতে। তখনও যে দূরবাসী স্বজনদের সাথে কুশল বিনিময়ের একটাই উপায় ছিল- চিঠি। অবশ্য, টেলিফোনও ছিল মুষ্টিমেয় কিছু বাড়িতে। কিন্তু, হাতে লেখা চিঠি যেন একটা আলাদা সুবাস বয়ে আনত। আর এখন? ছোট্ট একটা sms, ফোনে দু- চারটে কথা বা কয়েক লাইনের একটা email - তাতেই সব দায়িত্ব-কর্তব্য সারা হয়ে যায়। অনেক কথাই থেকে যায় না -বলা। সকাল-সন্ধ্যে ছুটে চলার ক্লান্তিতে আমাদের কথাই আজ হারিয়ে যেতে বসেছে। বেশি কথা বলা বা শোনার সময় নেই কারও। প্রয়োজন সাঙ্গ হলেই হল। আমরা যে এখন বড্ড বেশি যান্ত্রিক।
                      অথচ, একটা সময় ছিল, যখন প্রিয়জনের চিঠির অপেক্ষায় দিন গুনত সবাই। ভরদুপুরে ডাক হরকরার ঘন্টি বা সাইকেলের ক্রিং ক্রিং আওয়াজে বাড়ির মেয়ে-বউরা একছুটে সদর দরজায় বা জানালার পর্দা তুলে উদগ্রীব চোখের প্রশ্ন - আমার নামে কোনো চিঠি আছে গো? উত্তর নেতিবাচক হলে অপেক্ষায় আরও একটি দিন। আর, হাতে যদি পাওয়া যায় প্রত্যাশিত কাগজটি? প্রথমেই দু' হাতে আঘ্রান নেওয়া, তারপর দ্রুত একবার চোখ বুলিয়ে নেওয়া অক্ষরগুলির ওপর। বেশিরভাগ চিঠিই যত্ন করে রেখে দেওয়া হত, সময় পেলেই আবার পড়ার জন্য। কত হাসি, কত কান্না, কত ভালোবাসা, অভিযোগ- অনুযোগ সবই যে লুকানো রয়েছে ঐ একফালি কাগজে।
               দিন যাচ্ছে, সময় এগোচ্ছে। সময়ের সাথে পা মিলিয়ে এগোচ্ছি আমরাও। যুগের হাওয়ায় পাল তুলে ভাসছে সবাই। উন্নতিই যে আমাদের লক্ষ্য। দিন বদলের সাথে প্রযুক্তি যত এগিয়ে যাচ্ছে, আমরাও তত সহজভাবে দূরকে নিকট করে নিতে পারছি ।দূর প্রবাসী আপনজনটি কেমন আছে ,তা জানার জন্য আজ আর দীর্ঘ দুশ্চিন্তায় অপেক্ষা করতে হয় না। দ্রুতগতির ইন্টারনেট পরিষেবায় চোখের পলকেই শুধু কথা নয়, ছবি বা ভিডিওর মাধ্যমেও জেনে নিতে পারি সেই মানুষটির হাল- হকিকত্। তবু, যা কিছু পুরনো, তা তো বারবার ফিরে আসে মনে। তাই, হলুদ চিঠিগুলো তোলা থাকুক্ মনের স্মৃতিকোঠায়। শুধু , কখনও মন খারাপের একলা বিকেলে অপেক্ষা করতে ইচ্ছে হয় ,যদি আসে--
             " রঙিন খামে যত্নে লেখা আমার নাম"।

No comments:

Post a Comment