Monday, December 2, 2024


 


যাক অবসাদ বিষাদ কালো 

পূর্বা দাস 

    

      হেমন্তের আঁচলে বড়ো রহস্য। হঠাৎ হঠাৎ কাকভোরের আবছায়া আলোআঁধারিতে কোনো বৈষ্ণব দলের প্রভাতী নগর কীর্তনের সুর কানে বাজে আজও। পুবের আকাশে জেগে থাকে শুকতারা। ঘুমন্ত শহরের অন্তর্জাল ছিঁড়ে এখনও উত্তরবঙ্গের ভোরগুলো ভেসে যায় মধুমাখা হরিনামের সুবাসে। ইতিউতি পড়ে থাকা প্যান্ডেলের বাঁশ, চায়ের দোকানের আঁচ দেওয়া উনুনের গন্ধ, উৎসবের স্মৃতি আঁকড়ে পড়ে থাকা টুনি বাল্বের চিকচিক আলো- এসব নিয়েই একটু একটু করে পাঁপড়ি মেলে হেমন্তের সকাল পোখরাজ রঙের আলোয়। ধীরে ধীরে আমার দক্ষিণের জানলা ভরে ওঠে স্নিগ্ধ রোদ্দুরে। শীত শীত হাওয়ায় ফ্যানের রেগুলেটরে লাগাম দিয়ে আলতো উষ্ণতায় আড়াল খোঁজে গুটিসুটি মন। ফাঁকা বারান্দাতে কোথা থেকে যে থোকা থোকা চন্দ্রমল্লিকার গন্ধ ভেসে আসে জানিনা। সেও এক রহস্য। আকাশ প্রদীপ জ্বলজ্বল করে যখন গাঢ় কুয়াশামাখা আঁধারে, পৃথিবীর মাটিতে বয়ে যায় সৃষ্টির গন্ধ। জানলার ওপারে বিকেল নামলে চিকচিক করে আকাশের ধার। পড়ন্ত বেলায় নদীর জলে একটু একটু করে মিশে যেতে থাকে দিনের শেষ লাল রঙ। সে জলে পা ডুবিয়ে অনন্তকাল যেন কাটিয়ে দিতে পারি ধ্রুবতারার খোঁজে। কে যেন ফিসফিসিয়ে বলে- ও বাউল মন, তুই হারাস না, সবুর কর। খসখসে কালো পাথরের ধার ঘেঁষে অমনি ঝুপ করে নামে সন্ধ্যা। নদীর জলপাই রঙা পাড় ধরে বাঁধা থাকে কালো কাঠের নৌকা, তিরতিরে হাওয়ায় দুলতে থাকে এমন করে যেন প্রাণ আছে ওদের, বোঝে সব, শুনতে পায় জলের কথা।

        কিছু কিছু সকাল বড়ো অপ্রত্যাশিত প্রাপ্তি নিয়ে আসে। বহুদিনের অযত্নে পড়ে থাকা আমার পুরোনো টবের মাটিতে হয়তো রয়ে গিয়েছিল কিছু ঘাসফুলের বীজ। কি যেন গালভরা একটা নাম আছে ওদের। কুয়াশার ঘোরে ঘুমঘুম চোখ কচলে দেখি গোটা তিনেক রঙীন ফুল আলো করে আছে ঐ শুকনো খটখটে মরা টবে। কি অদ্ভুত! কোথায় কোথায় জীবন লুকিয়ে থাকে, আমরা খেয়ালও করি না। বুঝে ওঠার আগেই কেউ পাড়ি জমায় না-ফেরার দেশে। নিঃশব্দে নিঃশেষ হয়ে যায় কারোর যত্নের অপেক্ষায়। শেষবারের মতো অ্যাম্বুলেন্সের শব্দে কানে তালা পড়ে। তারপর? 

         তারপর আর কি? সেই পরিচিত চেনা অভ্যাস, অভিযোগ আর অভিনয়। অ্যাসিডের মতো কিছু মানুষ প্রতিনিয়ত ক্ষয় করে চলে হৃদয়। আরো দগদগে হয় ক্ষত। লিটমাসে ধরা দেয় না বহুরূপীদের আসল রঙ। তবু ঈশ্বর দয়াময়‌। সূর্যের অপসারী রশ্মিরা ছুঁয়ে যায় অভিসারী হৃদয়ের সে সব ক্ষত। শিরায় শিরায় ছড়ায় উষ্ণতা। কিছু উষ্ণতা শুধু যে সঙ্গ দেয় তা নয়, কিছুটা আগলেও রাখে। শীতের রাতের লেপের মতন লেপটে থাকা অনুভূতিগুলো চিরন্তন রয়ে যায় বুকের কোথাও একটা। আঁধার নামে না আর মাদার গাছের তলায়, পিচঢালা রাস্তায় নিয়ন আলোয় গুঁড়ো গুঁড়ো বৃষ্টিতে অবসর কাটায় আমার শহর। দ্রুতবেগে নেমে আসা সন্ধ্যের অভিসন্ধি বোঝা কঠিন। তবু অপরাহ্নের হলদে আগুনে ঝলসে যায় মন। সে এক অদ্ভুত রঙ! ছন্নছাড়া বিবাগী হবার হাতছানি। গুটিপোকার প্রথম আলো দেখার মতন করে মুক্ত হয় মনের সব অনুভূতিরা। ইচ্ছে করে রিক্সোয় বসে আকাশ দেখতে দেখতে পাড়ি দিই অন্য উপত্যকায়। সে আর হয় কই? সবেতেই অযত্ন। ফুরসৎ নেই মনের কথা শোনার। নিজের উপর নিজেরই কত্তো অভিযোগ! আজ না হয় থাক সেসব কথা। না পাওয়া গুলো না হয় উড়ে যাক কোনো দীপাবলীর আকাশে, পুড়ে যাক ফানুস হয়ে।

       আকাশের সব রঙ ফুরিয়ে যাবার আগেই সাজানো গোছানো ব্রীজের উপরে জ্বলে ওঠে নীল হলুদ কুন্ডলী পাকানো আলো। হাজার টাকার ঝাড়বাতির মতো জ্বলজ্বল করে কৃত্রিম সভ্যতা আর ব্রীজের নীচে ঘুটঘুটে আলকাতরার মতো আঁধার ক্রমশঃ ভরাট হতে থাকে সমাজের যত গোপন মধ্যযুগীয় আবর্জনায়। নদী ভার হয়ে আসে। ফুঁপিয়ে ফুঁপিয়ে আসে স্রোত। তার বুকের এক তাল কাদামাটিতে কোনো মৃৎশিল্পীর তুলির টানে জন্ম নেয় মহাশক্তি। সেও নির্বাক, নিশ্চল। মরচে ধরা টিনের কুঁড়েঘরে টিমটিম করে জ্বলে তেলের প্রদীপ, আবাহন চলে ইতুলক্ষ্মীর। অঘ্রাণের নতুন ধানের সুবাসে মিশে থাকে কতো রক্ত, ঘামের গন্ধ। খুব জানতে ইচ্ছে করে, ওরা কি এখনও দুপুরে হাঁড়িতে একমুঠো চাল বেশি নেয়? সাক্ষাৎ অন্নপূর্ণা বুঝি ওরাই। বুকের পাঁজর নিঙড়ে সবটুকু জীবনীশক্তি উজার করে কেউ ব্রত রাখে অঘ্রাণের ষষ্ঠীর। কই? মা ষষ্ঠী তো আসেন না। ক্ষুধার্ত মানুষের আর্তনাদ ঢাকা পড়ে যায় কার্নিভালের রোশনাইয়ে। তবু এরপরও চুপ করে থাকা অবিরাম। টালমাটাল স্নায়ুতে কমে আসে সহ্যশক্তির ধার। রাত যত গভীর হয়, বাড়তে থাকে বাতাসের শিরশিরানি ডাক। আকাশ থেকে ঝরে পড়ে অ্যাসিডের বর্ষণ। ক্ষতবিক্ষত শরীর অগণিত সেলাই নিয়ে ধুঁকে ধুঁকে চলে, ছুঁতে চায় জোনাকিদের আলিঙ্গন। কি আশ্চর্য এক মায়ার নাম জীবন! সেলাইয়ের পর সেলাই, ফোঁড়ের পর ফোঁড় তুলে তুলে বুনে চলে নকশিকাঁথার গল্প। ক্রমশঃ সে গল্পে জুড়তে থাকে আরো পাতা আর সংক্রমণ ছড়ায় পর্ণমোচীর নগ্ন ডালে। সময় ফুরিয়ে এলে ঝরা পাতাদের রাস্তা ছেড়ে দিয়ে বেঘোরে হারিয়ে যায় এ শ্রান্ত হেমন্ত, কোনো অন্ধগলিতে খুঁজে ফেরে নিজের অসহায় অস্তিত্ব। নিশীথ শিশির মেখে রবীন্দ্রনাথের গানে উজার করে দেয় অসংখ্য অব্যক্ত কথার ঝাঁপি। বিষাদ অবসাদ সবটুকু দ্রবীভূত হয় কালের প্রবাহে।        

        গেরুয়া বসনে আসে বাউল, চলেও যায় দেশ থেকে দেশান্তরে, তার গানের কথার রেশ কাটে না বহুক্ষণ। ‘তারা বলে গেল “ক্ষমা করো সবে, বলে গেল ভালোবাসো”, অন্তর হতে বিদ্বেষ বিষ নাশো’। একতারার সুরের কি অমোঘ সম্মোহন! কি শুনতে কি শুনি। বেনামী ফুলের গালিচা পাতা জঙ্গলে একলা ঘাসফড়িং দিগন্তজোড়া লালচে রঙ মেখে অপেক্ষা করে নতুন ভোরের। দিনের শেষে আকাশের সবটুকু রঙ শুষে নিয়ে ফিরতে থাকে পরিযায়ী পাখিরা। অস্তায়মান সূর্যের সমান্তরালে রেখে যায় অমৃতের খোঁজ আর ফিরতি পথে বলে যায় “রাজার ঘরে যে ধন আছে টুনির ঘরেও সে ধন আছে”। সত্যিই?

No comments:

Post a Comment