Monday, December 2, 2024


 


ত্মদর্শন

 

ঋতুপর্ণা ভট্টাচার্য

 

বাঙালির চিরকালই পায়ের তলায় সর্ষে ছোট থাকতেই স্কুলের দুখানি নিশ্চিত বাৎসরিক ছুটির অবসরে পরিবারের হাত ধরে তার যাযাবরী জীবনের শুরু পরবর্তীকালে সময় ও সুযোগ বিশেষে এই নেশা কারুর কারুর মধ্যে আরও বাড়েকেউ বা হয়তো পরিস্থিতি বা স্রেফ ব্যক্তিগত অনিচ্ছের কারণেই কখনও কখনও খানিকটা গুটিয়ে যায় তবে ব্যাগপত্তর গুছিয়ে হাজার গণ্ডা ব্যবস্থাপনা করে ঘরের চার দেয়ালের বাইরে পাড়ি দিক বা না দিক মনের মধ্যের ভ্রমণপিয়াসী মানুষটা কিন্তু তার অন্তরে বেঁচে থাকে জীবনভর। আমাদের ছোটবেলার গল্পও এর থেকে আলাদা কিছু নয় বাবা মা বা পরিবারের আরও অনেকের সাথে একটুখানি জ্ঞান হওয়ার পর থেকেই আমরা বাড়ির ছোটরাও দেশের মধ্যে এদিক ওদিক ঘুরেছি যথেষ্ট আর সেই অভ্যেস বালিকাবেলা থেকে কৈশোর পেরিয়ে আজ এই বড় বয়েস অবধিও অন্তরের গহীনে বেঁচে রয়েছে সেই একই তীব্রতায় এখনও কোথাও বেড়াতে যাওয়ার কথা উঠলেই মনের মধ্যেটায় সেই ছোট্টবেলার আনচান ধুকপুকে রোমাঞ্চবুকের ভেতরটায় সেই বোঝা না বোঝা একরাশ আনন্দের দুরদুরানি আর সব কাজ বাদ দিয়ে মাথার ভেতরে লক্ষ স্বপ্নের মায়াজাল বোনার পর্ব পুরোদমে শুরু

 

বড়বেলায় এত অবধি যে কটা জায়গায় এযাবৎ ঘুরেছি তার মধ্যে গুণে দেখলে সিংহভাগই কিন্তু দেশের বিভিন্ন তীর্থস্থান এর একটা মূল কারণ হয়তো এই যে, আমরা এখন যে বয়েসটায় তাতে নিজেদের চেয়েও পরিবারের বয়স্ক মানুষদের ইচ্ছেই এই মুহুর্তে আমাদের কাছে প্রধান গুরুত্বপূর্ণ। এইসব জায়গার মধ্যে আবার হরিদ্বার বেনারস অযোধ্যা প্রয়াগ গয়া  পুরীতে যাওয়া হয়েছে একাধিকবার তবে এই সবকটি জায়গাতেই ঘোরার ক্ষেত্রে পুজোপাঠ  তীর্থদর্শন একটা প্রধান বিষয় হলেও সেটুকুই সব নয় আসলে কোনও জায়গা তো শুধুই তার মাটি বালি পাথর ইমারত হাটবাজার সৌধ প্রাসাদ মন্দির মসজিদ নিয়েই গড়ে ওঠে নাগড়ে ওঠে সেখানকার মানুষ  তাদের একান্ত নিজস্ব জীবনধারা কৃষ্টি  সংস্কৃতি নিয়েও কোনও একটা জায়গায় গেলেই তাই আমি সেখানকার মানুষ  তাদের জীবনশৈলী, অর্থাৎ, জায়গাটির অন্তর্নিহিত প্রাণভোমরাটিকেই খুঁজে বেড়াই সবার আগে জায়গাটির বিশেষত্ব কিভাবে সেখানকার মানুষগুলোর জীবনশৈলীকে রন্ধ্রে রন্ধ্রে বদলে দিয়েছে সেইটের সন্ধানই যেকোনও জায়গায় আমার বেড়াতে যাওয়ার প্রধান আকর্ষণসে তীর্থক্ষেত্রই হোক কি অন্য কোনও দর্শনীয় স্থান

 

এমনিতে ধর্ম বিষয়ে আর পাঁচজন সাধারণ সামাজিক মানুষের মতোই আমারও বিশ্বাসযে এই ধর্মবিশ্বাস বস্তুটি অত্যন্ত ব্যক্তিগত এবং শাস্ত্রনির্দিষ্ট খুঁটিনাটি যাবতীয় আচার সংস্কার না জানলেও অন্তরের নির্ভেজাল ভক্তি  সমর্পণেও ঈশ্বরের অসীম শক্তিকে হৃদয়ে অনুভব করা যায় সত্যি বলতে কিএইটুকুনি বিশ্বাসমাত্রকে মেনেই আমি কিন্তু নানা পুণ্যধামে ঘুরে বেড়াই এবং নিজের মতো করে নিজের অন্তরে বহুস্থানে বহুরূপে বিরাজিত মহিমময় ঈশ্বরকে গ্রহণ করিএবং, এইভাবে নানা স্থানে ঘুরে ঘুরে প্রাণের ঠাকুরকে খোঁজার এই বিরামহীন দৌড়ে আমার আবার দুটি আলাদা আলাদা স্থানে দুটি বড়ই বিরল অভিজ্ঞতা হয়েছিল একটি পুরীতে জগন্নাথদেবের ধামেঅন্যটি অযোধ্যার রামলালার মন্দিরে। স্থান কাল পাত্র সম্পূর্ণ আলাদা হলেও অদ্ভুতভাবে সেই দুটি অভিজ্ঞতাই কোথাও গিয়ে যেন অবশেষে মিলে গিয়েছিল একটিমাত্র বিন্দুতেইআর আশ্চর্য হয়ে প্রথমবারের জন্য অনুভব করেছিলাম কোটি রূপে সম্মুখে ছড়িয়ে থাকলেও ঈশ্বর কিন্তু সত্যি সত্যিই শেষপর্যন্ত এক এবং একমাত্রইশতরূপে আরাধনা করলেও  মহাশক্তির উৎস আসলে একটিই, আত্মহারা হয়ে দিকে দিকে ঘুরে ফিরে পরমাত্মাকে খোঁজার সব রাস্তা শেষমেষ সত্যি সত্যিই মিলে যায় একখানেই

 

দী পু দা প্রায় সব বাঙালিরই ভ্রমণ ডায়েরির প্রথম পাতা যেখান থেকে তার বিশ্বদর্শন শুরু আমিও  নিয়মের ব্যতিক্রম নই এবং সেই সহজ সূত্র ধরেই ছোটবেলা থেকে এই বড়বেলা অবধি বছরের নানা সময়ে কারণে অকারণে অগুন্তিবার নীলাচল ভ্রমণে গেছি পুরীতে  তার কাছাকাছি ওড়িশার আরও নানা জায়গায় ঘুরে বেড়ানোর সঙ্গে সঙ্গে এই ভ্রমণপর্বের একটি বিশেষ স্থান চিরকালই জুড়ে থাকত পুরীর মন্দিরে শ্রী শ্রী জগন্নাথদেবের দর্শন  পুজো পুরীতে পুজোর ক্ষেত্রে সেখানকার কুখ্যাত পাণ্ডারাজের উপদ্রব এড়াতে আগেভাগেই পরিচিত পাণ্ডা ঠিক করে যাওয়া বাঞ্ছনীয় এখন, দীর্ঘকাল ধরে একাধিকবার পুরী ঘুরে আসার ফলস্বরূপ ঠিকঠাক একজন পাণ্ডা মহারাজ একটা সময়ের পরে আমাদের জুটেই গিয়েছিল এমনকি পর পর বেশ বার বেশ শান্তিতে তাঁর সহযোগিতায় পুজো দেওয়ার পরে একরকম পারিবারিক ঘনিষ্ঠতাও গড়ে ওঠে তাঁর সঙ্গে ফলে পরবর্তীতে যখন পরিবারের বয়স্ক মানুষদের নিয়ে কোনও কোনবার একাও পুরী যাই আমিমন্দিরে সুষ্ঠুভাবে পুজো দিতে কোনও অসুবিধে হয়নি

 

সেটা সম্ভবত ২০১৮ সালের গোড়ার দিক, হঠাৎই ঠিক হল পুরী যাওয়া হবে সঙ্গী কেবল আমার মা  বাবা দিন চার পাঁচেকের ব্যাপার বরাবরের মতো সমুদ্রের কাছে ভারত সেবাশ্রমেই থাকা  একটা ভাল দিন দেখে পুজো দেওয়াব্যস এটুকুই প্ল্যানপুরীর মাটিতে পা দিয়ে সর্বাগ্রে সমুদ্রের জল ভক্তিসহ মস্তকে নিয়ে মন্দিরে গিয়ে জগন্নাথদেবের দর্শনের পরেই সমুদ্রস্নানে নামা যায় আমরাও প্রতিবার তাইই করেছি এবারেও সেই চিরাচরিত প্রথা মেনে পুরীতে আমাদের প্রথম দিনে ভোর ভোর উঠে সূর্যোদয়ের মঙ্গল মুহুর্তে আদিগন্ত বিস্তৃত সমুদ্রদেবের অনন্ত সফেন জলরাশির এক আঁজলা মাথায় নিয়ে নগ্নপদে সকলে মিলে মন্দিরের উদ্দেশ্যে রওনা দিলাম মন্দিরে সেই কাকভোরেই যথেষ্ট ভিড় সকলেই শ্রী শ্রী জগন্নাথদেবের দর্শন করে দিনের শুভারম্ভ করতে ব্যাকুল লাইনে দাঁড়িয়ে কুপন কেটে পুজোর ডালা নিয়ে মন্দির কক্ষে প্রবেশ করে পায়ে পায়ে কোনমতে একসময় ঠাকুরের সামনে গিয়ে উপস্থিত হলাম, এবং অতঃপরলক্ষ কাঁসর ঘন্টা শঙ্খধ্বনি আর উদাত্ত কণ্ঠের অপূর্ব শুদ্ধ মন্ত্রোচ্চারোণের সম্মিলিত তুমুল গর্জনে ঠিক মধ্যিখানে দর্শন হল তাঁর সাথেকিছু অভিজ্ঞতা জীবনে এমন হয় ভাষায়  শব্দে যার ব্যাখ্যা হয় নাএক এবং একমাত্র অনুভবেই যার পূর্ণ প্রকাশ মন্দির কক্ষে তখন গিজগিজে ভিড়সকলেই বারংবার দর্শনার্থে অধীরআর সেই অসম্ভব দুঃসহ এক ঠেলাঠেলি  ধাক্কাধাক্কির মাঝেও তাঁর সাথে চোখাচোখি হতেই কিভাবে যেন এক পলকে সময় গেল থমকেচতুর্দিকের উত্তাল জীবনসমুদ্রের আকাশছোঁয়া ঢেউ আর কানফাটানো আওয়াজ নিমেষে গেল মিলিয়ে! এই ইহলোক থেকে সম্পূর্ণ বিচ্ছিন্ন জনমনুষ্যহীন শূন্য এক অচেনা দ্বীপের ঠিক মধ্যখানে যেন আমি তখন একেবারে একাকী দাঁড়িয়ে, আর সম্মুখে কেবল তিনিএখন আর কোনও আড়াল নেইকোনও কিচ্ছুটি তাঁর কাছ থেকে লুকোনোর উপায় নেইসর্বগ্রাসী মহাদ্রষ্টা বিশাল গোলাকার ওই দুটি মহাচক্ষুর সামনে দণ্ডায়মান নিরাভরণ অসহায় একাকী আমি! আমার সমস্ত সত্তাসমস্ত অন্তঃকরণ ফুঁড়ে যে দৃষ্টির মহা ব্যাপ্তিআমার সব জ্ঞানে অজ্ঞানে করা পাপের নির্দয় বিচারে সম্পূর্ণ নির্মোহ নির্বিকার যেআর মহা আশ্চর্য এই যে সেই চরম অসহায় টালমাটাল মুহুর্তেও কেন যেন আমার দুকূল উপচে তখন শুধু ঝরে চলেছে অবিরল আনন্দাশ্রুই! সব চাওয়াপাওয়ার হিসেব তখন শিকেয়অন্তরে তখন শুধুই এক অলৌকিক ব্যাখ্যাতীত ঐশ্বরিক পরম আনন্দের অনুভূতিপুজোপাঠের পুঙ্খানিপুঙ্খ নিয়মনীতি আচার বিচারে সম্পূর্ণ অপটু এই আমার যে কোনদিন এভাবে অন্তরে ঈশ্বরদর্শন হবে তা সে যাবৎ কল্পনাতেও আসেনিজগন্নাথদেবের অবিশ্বাস্য দৈবী কৃপায় কোনদিন আত্মদর্শন হবে এভাবে, ছিল সব স্বপ্নের অতীত! আর সেই এক দর্শনেই এরপর থেকে কিভাবে যেন মুহুর্তে একেবারে ভেতর থেকে আমূলে বদলে গেলাম আমিযাবতীয় প্রচলিত আচার সংস্কারের ওপরে উঠে ঈশ্বরে বিশ্বাসকে নতুন করেএকেবারে নিজের মতোন করে নিজের অন্তরে সেদিন থেকে খুঁজে পেলাম দারুণ আকস্মিকভাবে, আজও যা আমার সময়ে অসময়ের জীবনযুদ্ধে সমস্ত ত্মশক্তির একমাত্র উৎস

 

এই একই অভিজ্ঞতা অনেকদিন পর আবারও ভারী অদ্ভুতভাবে প্রত্যক্ষরূপে অনুভব করলাম অযোধ্যায় গিয়ে  বছরের গোড়ার দিকে অযোধ্যায় রামমন্দিরের উদ্বোধন হওয়ার পর থেকেই আমাদের মধ্যে অযোধ্যা ভ্রমণের আগ্রহ বেড়ে ওঠে দারুণভাবে সেই মতো এবারের পুজোর ছুটিতে অযোধ্যার রামলালা দর্শন ছিল আমাদের পুজোয় বেড়ানোর লিস্টের একেবারে প্রথমেই রামলালা যেহেতু আদতে হিন্দুধর্ম স্বীকৃত ঠিক কোনও দেবতা ননবরং এ জগৎসংসারের পালনকর্তা ভগবান বিষ্ণুর অবতাররূপে মান্যতাই প্রথামতো শ্রীরামজন্মভূমিতে চার বেলা কেবল তাঁর আরতিই হয়ে থাকেকোনও পুজো হয় না ভক্তদের এই আরতি দর্শনের কুপন আগের দিন মন্দিরের মূল গেটের সামনেই কাউন্টার থেকে বিনামূল্যে আধার কার্ড দেখিয়ে সংগ্রহ করতে হয় এবং সেই মতো পরদিন ভোর চারটের মঙ্গল আরতিভোর সাড়ে ছটার শৃঙ্গার আরতিদ্বিপ্রহরের ভোজন আরতি ও রাত্রির শয়ন আরতি দর্শনের অনুমতি পাওয়া যায় আমরা এবারে ভোর সাড়ে ছটার শৃঙ্গার আরতির কুপন নিয়েছিলাম এবং মন্দির কর্তৃপক্ষের নির্দেশমতো পরদিন ভোর ঠিক সাড়ে পাঁচটায় গিয়ে রিপোর্ট করেছিলাম মন্দিরের গেটে এই গেট থেকে ব্যারিকেড নির্ধারিত লাইন ধরে এঁকেবেঁকে অনেকটা হেঁটে তবে মূল রামমন্দির প্রাঙ্গনে পৌঁছানো যায় এই প্রাঙ্গনের অন্দরেও এখন মূল মন্দিরকে ঘিরে আরও বেশ কয়েকটি ছোট ছোট মন্দির নির্মাণের কাজ চলছে আসলে অযোধ্যায় জানুয়ারির ২২শে কেবলমাত্র মূল মন্দিরের ভেতরে রামলালার মূর্তির আনুষ্ঠানিক উদ্বোধনটুকুই কোনমতে হয়েছেনইলে অযোধ্যায় অযোধ্যাধাম স্টেশনশহরের ভেতরের বিস্তীর্ণ অংশএমনকি শ্রীরামজন্মভূমি ও মূল মন্দিরের ভেতরে ও বাইরের  বিশাল অংশ জুড়ে এখনও রাতদিন পুরোদমে চলছে নির্মাণ কাজ। হেঁটে মূল মন্দির চত্বরে পৌঁছে রামলালা দর্শনে ওঠার আগে পায়ের জুতো সিঁড়ির পাশে নির্দিষ্ট স্থানে খুলে রেখে অনেক কটি সিঁড়ি বেয়ে তবে মন্দিরের গর্ভগৃহে প্রবেশ করতে হয় নিকষ কালো অপরূপ রামলালার বিগ্রহটি গর্ভগৃহের ঠিক মধ্যিখানে এমনভাবে প্রতিষ্ঠিত যে গর্ভগৃহের প্রাঙ্গনে পা দেওয়ামাত্র বহুদূর থেকেই একদম সোজাসুজি তাঁর চোখে চোখ পড়েএমনই অবিশ্বাস্য এ মন্দিরের নির্মাণএবংএই অলৌকিক দৃষ্টিবন্ধনমাত্রেই এবারেও দেখি সেই এক অত্যাশ্চার্য অনুভূতিসেই এক শরীরজোড়া অবোধ্য এক আনন্দ শিহরণ এত করুণাময় দুখানি চোখঅথচ কি নিদারুণ অন্তর্ভেদীআশেপাশের গোটা বিশ্বব্রহ্মাণ্ড যেন মুহুর্তে বিলীন হয়ে যায় সেই অদ্ভুত চোখদুটির দিকে পূর্ণ হৃদয় মেলে চাইলেনিজের অস্তিত্বের ওপর সমস্ত নিয়ন্ত্রণ হারিয়ে যায় মুহুর্তেজগৎ সংসারের সব দুঃখ কষ্ট শোকের ওপরে উঠে নিজের সঙ্গেই নিজের চোখাচোখি হয়ে যায় দৈনন্দিনের সব ভণিতাসব ভণ্ডামিসব অসততার জাল ছিঁড়েএক ঝলকে লক্ষ আলোকবর্ষের বেগে মনশ্চক্ষের সামনে দিয়ে ছুট্টে বেড়িয়ে যায় নিজের আলো ছায়া অন্ধকারে মেশানো এযাবৎকালের দীর্ঘ অতীত জীবন আর সেইসাথেই ঝলসে ওঠে তার প্রেক্ষিতে নিজের আসল অবস্থানটিপ্রকৃত ভক্তের কাছে এ রামরাজ্যে তাই যথার্থই কেবল সত্যেরই বিরাজএ রামদর্শনে অন্তরের সব ক্ষুদ্রতা তুচ্ছতা মালিন্য অতিক্রম করে শুধু সত্যেরই প্রতিষ্ঠাঅদ্ভুতভাবে যে উপলব্ধিটি আমার অনুভূত হয়েছিল বহু বছর আগের শ্রী শ্রী জগন্নাথ দর্শনেওযে উপলব্ধিটিই শেষমেষ কোনও এক আশ্চর্য অলৌকিক যোগে যেন একই সূত্রে বেঁধে ফেলেছে এই দুটি আপাত পৃথক পুণ্যধাম আর তার মানুষগুলোকেও তাই পুরী হোক কি অযোধ্যাএই চির অক্ষয় চিরন্তন জীবনামৃতের সন্ধান পেয়েছে বলেই হয়তো প্রতি সন্ধ্যায় সারাদিনের হাড়ভাঙা খাটুনির পরেও তন্ময় হয়ে পুরীর মন্দিরের এক কোণে বসে কথকতা শোনে এক নগণ্য দিনমজুরকাজ থেকে ফাঁক পেলেই স্বেচ্ছায় শ্রীরামজন্মভূমির পবিত্র রামপথ ঝাঁট দিতে আসে অযোধ্যার সাধারণ এক নামগোত্রহীন মোটবাহক কি ভোর থেকে রাত অবধি রামলালা দর্শনে আগত বৃদ্ধ চলৎশক্তিহীন ভক্তের জন্য নিঃশুল্ক হুইলচেয়ার সেবা দেয় শহরের বিত্তশালী কোনও পরিবারের একমাত্র পুত্রআসলে শেষ অবধি বাহ্যিকভাবে দেখলে লক্ষ আচার বিচার আর নিয়মের বেড়াজালে যতই বাঁধা পড়ুক না আমাদের সনাতনী ধর্মসংস্কারঈশ্বরে বিশ্বাস যে আসলে এই সব কিছুর অনেক ঊর্ধ্বেঈশ্বরে বিশ্বাস যে শেষপর্যন্ত একেবারেই ব্যক্তিগত ও আত্মিক এক উপলব্ধিনিঃশর্ত আত্ম অণ্বেষণ  আত্মদর্শনেই যার পরম পূর্ণতা এই দুই পুণ্যধামের প্রতিটি বিন্দুতে যেন ছড়িয়ে আছে তার অকাট্য প্রমাণ সেই মোক্ষলাভের আশাতেই তো বার বার এই দুই তীর্থে ফিরে ফিরে আসাবার বার আমাদের দৈনন্দিনের ঘোলাটে গোলকধাঁধায় পথভ্রষ্ট নিজেকেই খুঁজে খুঁজে ফেরা সব ছাড়িয়ে এইই আসলে আমার প্রকৃত তীর্থদর্শন এইই আমার পরম পুণ্যলাভ

No comments:

Post a Comment