যাঁর সংগীত সাগরের সলিলে আজও অবগাহন করি প্রাক্ জন্মশতবর্ষে তাঁর প্রতি শ্রদ্ধার্ঘ --- - - গৌতমেন্দু নন্দী
হ্যাঁ, তিনি "আলোর পথযাত্রী", আমাদের এক বিষ্ময়, গীতিকার,সুরকার, সংগীতজ্ঞ সলিল চৌধুরী।
গীত রচনা, সুর সংযোজন---সংগীতের প্রতিটি ক্ষেত্রে তিনি এক স্বতন্ত্র প্রতিভা। বাংলা বেসিক গান থেকে বাংলা ও হিন্দি চলচ্চিত্রের কম্পোজিশনে তিনি দাপটে বিচরণ করে গেছেন। হয়তো তুলনা চলেনা, তবু বলছি রবীন্দ্রনাথ, নজরুল ইসলাম, রজনীকান্ত সেন, দ্বিজেন্দ্রলাল রায় -- এঁরা যেমন তাঁদের কথা ও সুরে বাংলা সংগীত জগতে স্বাতন্ত্র্য এনেছিলেন, তেমনি সলিল চৌধুরীও বাংলা সংগীত জগৎকে নিজস্ব ভাবনা ও অভিনবত্বে আলোকিত করেছেন।
সলিল চৌধুরী তাঁর কালজয়ী সংগীত সৃষ্টির মধ্য দিয়ে আমাদের মধ্যে বেঁচে থাকবেন। তাঁর গান আজকেও আমাদের উদ্বুদ্ধ করে, করে অনুপ্রাণিত। কলকাতায় এবং মুম্বাই দুই জায়গাতেই তিনি "ইয়ুথ কয়্যার" তৈরী করেছিলেন। যেখানে গান গাইবার জন্য নামীদামী সংগীত শিল্পীরা আগ্রহী
হয়ে থাকতেন। সলিল চৌধুরীর আমন্ত্রণ একবার পেলেই তাঁরা সেই "কয়্যার"এই আগে সবাই ছুটে যেতেন। তাঁর সুরে বাংলা বেসিক গান থেকে বাংলা ও হিন্দি চলচ্চিত্রে গান গাইতে সমস্ত নামী শিল্পীরা
সেইসময় ব্যস্ত হয়ে পড়তেন। লতা মঙ্গেশকর থেকে হেমন্ত মুখোপাধ্যায় সলিল
চৌধুরীর কম্পোজিশনে কতো কালজয়ী গান গেয়েছেন। বাংলা সংগীত জগতে সেই গানগুলো
চিরকালীন সম্পদ।
লতা মঙ্গেশকরের কন্ঠে সেইসব গান---- "যা রে য়ারে উড়ে পাখি যা রে, " সাত ভাই চম্পা
জাগো রে.." " কেন কিছু কথা বলোনা.." , " ও মোর ময়না গো----এই বেসিক গানগুলো আমাদের বাংলা গানের চিরকালীন সম্পদ। আর হেমন্ত মুখোপাধ্যায়ের কন্ঠে "গাঁয়ের বধূ", "পাল্কির গান" "রানার"---আজও এক ইতিহাস !
আমরা ভুলতে পারি না "মর্জিনা আবদুল্লা" ,"কবিতা"র মতো আরও বেশকিছু চলচ্চিত্রের গান।সহজ কথা,সহজ সুরে ভারতীয় রাগ-রাগিনীর ওপর সযত্নে সাজানো তাঁর সৃষ্টি যেন এক একটা মণিমুক্তো। প্রাচ্য আর পাশ্চাত্যের এক অসাধারণ মেলবন্ধন তিনি তাঁর সংগীতে ঘটিয়েছেন। সংগীত নিয়ে তাঁর মতো এতো এক্সপারিমেন্ট খুব কম মিউজিশিয়ানই করে গেছেন। তাঁর গণসংগীত রচনা করার হাতেখড়ি গণনাট্য সংঘ গড়ে ওঠার অনেক আগেই হয়েছিল---তিনি নিজে বলেছেন। "আইপিটিএ"তে তিনি আসার অনেক আগেই অনেক গান তৈরি করেছিলেন।
তাঁর কলেজ জীবনে বেআইনি ঘোষিত কমিউনিস্ট পার্টির সঙ্গে তাঁর যোগাযোগ থাকার জন্য তাঁকে সেই সময় ব্রাত্য করে রাখা হয়েছিল। সেইসময় শুধু গান নয়, কলেজে কম্পিটিশনে চুটিয়ে বাঁশী, এসরাজও বাজিয়েছেন। যৌবনে গণনাট্য সংঘের সঙ্গে যোগাযোগের কারণে তিনি শ্রমিক আন্দোলনেও সামিল হয়েছিলেন। গণনাট্যে পাশ্চাত্য সংগীতের মডার্ন টেকনিক আনার অপরাধে তাঁকে একসময় গণনাট্য সংঘ থেকেও ব্রাত্য করে রাখা হয়েছিল।
শিল্প আর শিল্পীর উপর জারি হওয়া "অতি বাম মনোভাব" এর শিকার তিনি হয়েছিলেন এবং সেই
ফতোয়া থেকে তিনি মুক্তি পেতেও মরিয়া হয়ে উঠেছিলেন। তিনি মুম্বাই চলচ্চিত্র জগতের সঙ্গে যুক্ত হলেও সেখানেও তাঁকে "একঘরে" করে রাখার চক্রান্ত শুরু হয়েছিল। এই বাংলার এক বিখ্যাত কবিও তাঁকে বলেছিলেন আমেরিকার দালাল। দুঃখ, হতাশা, অপমান নিয়েই তিনি মুম্বাই পাড়ি দিয়েছিলেন। তবুও"বিশ্বাসঘাতক", "পলাতক" বিশেষনে তাঁকে ভূষিত করা হয়েছিল। এতো সম্মান, খ্যাতি নিয়েও শেষের দিকে খুব স্বাভাবিকভাবেই একাকিত্ব গ্রাস করেছিল তাঁকে।
তাঁর মৃত্যুর প্রায় তিরিশ বছর বাদে আজ তাঁর মূল্যায়ন হচ্ছে। তিনি নিজে কোথায় যেন বলেছিলেন " বেঁচে থাকতে আমাকে কেউ তেমনভাবে চিনতে পারল না, একশো বছর পর বাঙালিরা বুঝতে পারবে...." ঠিক তাই! আজ তাঁর "পথে এবার নামো সাথী, পথেই হবে এ পথ চেনা..." নতুন করে আমাদের পথ দেখাচ্ছে। তাইতো "আর,জি,কর" কান্ডের জন মিছিলে তাঁর এই গানকে মননে,চেতনে প্রতিবাদের বীজমন্ত্র করে পথে হাঁটলো শতসহস্র তরুণ প্রজন্ম।
অনিন্দ্য চট্টোপাধ্যায়ের উদ্ধৃতি দিয়েই বলি, " শুধু এখানেই হয়তো শেষ নয়, আলোর পথযাত্রীরা
আরও পথ হাঁটবেন,গান গাইবেন। "আর কবে,আর কবে,আর কবে"-র কোরাসে গলা মেলাবে সব বিক্ষুব্ধ মন...."----সলিল চৌধুরীর স্বরলিপির খাতা থেকেই যেন উঠে আসা সেই কথা ও সুর! যা উদ্বুদ্ধ ও উৎসাহিত করবে পরের পর প্রজন্মকে। সেখানেই সার্থক সলিল চৌধুরী ও তাঁর সৃষ্টি।
(* স্কেচ- লেখক)
No comments:
Post a Comment