Monday, December 2, 2024


 

তথাগত বুদ্ধ

জয়তী ব্যানার্জী 


"হাজার বছর ধরে আমি পথ হাঁটিতেছি পৃথিবীর পথে"---
এমন একটি আশ্চর্য উক্তি দিয়েও তাঁকে মূর্ত করা যায় না। কারণ হাজার বছর ধরে তাঁর দীর্ঘ পথ পরিক্রমার একটি ভগ্নাংশ মাত্র আমরা উপলব্ধি করেছি। পৃথিবীর পথে তিনি হেঁটে চলেছেন আড়াই হাজার বছর ধরে।
গৌতম বুদ্ধ______
আড়াই হাজার বছর ধরে এই পৃথিবীর পথে প্রান্তরে অক্লান্ত হেঁটে চলেছেন এক অপ্রতীম মানসপুত্র।
একটি দর্শন ;একটি ধর্মমত ;একটি ভাবধারার প্রচারক এই অপ্রতীম মানব পুত্রটি। যে দর্শন যে ধর্মমত যে ভাবধারা অনুপ্রাণিত করেছে পৃথিবীর অগণিত মানুষকে। আলো দেখিয়েছে অন্ধকারে ।যা কিনা আড়াই হাজার বছর ধরে দেখিয়ে চলেছে। আজও দেখিয়ে চলবে আর ,আরো বহু বছর আরো বহু হাজার হাজার বছর।
জন্মসূত্রে তর্কের খাতিরে রাজপুত্র তিনি। রাজপদের হাতছানি উপেক্ষা করে নেমে এসেছিলেন পথে, সিদ্ধার্থ থেকে গৌতম-- গৌতম থেকে উপনীত হয়েছিলেন তথাগত বুদ্ধে।
কিন্তু এই যে রূপান্তর সিদ্ধার্থ থেকে বুদ্ধ হয়ে ওঠার এক যে দুস্তর প্রক্রিয়া, এর উৎস কোথায়?
প্রচলিত গল্পকথা অনুসারে--
জরা ব্যাধিমৃত্যুকে স্বচক্ষে দেখার পর জীবনের অর্থ ভাবিত করে সিদ্ধার্থকে ।তারপর এক সন্ন্যাসীকে দেখে তিনি পথ খুঁজে পান ।রাজপথের হাতছানি স্ত্রী পুত্রে ঘেরা সংসারের শান্তিচ্ছায়া ;বৈভব মণ্ডিত জীবনের নিশ্চিন্ত আশ্রয় ছেড়ে সত্যের সন্ধানে যাত্রা করেন।
এই গল্পটা কিন্তু আমরা নির্দ্বিধায় মেনে নিই ।ভেবে দেখার চেষ্টা করি না কতটুকু সত্য আছে এর পেছনে, এর সত্যাসত্য নিয়ে আমরা ভাবি না ।কারণ এই আশ্চর্য মানব পুত্রটিকে আমরা উন্নীত করেছি দেবত্বে, পরিণত করেছি নবম অবতারে। ভক্তি এসে পথ ঢেকেছে যুক্তির।
এক রাজ পরিবারের রাজপুত্র হিসেবে জন্মেছিলেন তিনি। কেমন ছিল সেই রাজ পরিবারের চিত্রটি। বড় হয়ে ওঠার পথে কোন্ মোড় বাঁক নিয়েছিল সেই রাজপুত্রের জীবনে ।এইসব বাঁক মোড় ফেরানোর পথেই তার জীবনে এসেছিলেন স্ত্রী গোপা।রূপ নিয়েছিল তাদের যৌথ জীবনের দশ বছরের পরবর্তী ফসল পুত্র রাহুলকে ঘিরে। গৃহত্যাগের পর থেকে শুরু করে কঠিন সাধনার পথ বেয়ে বুদ্ধতে উপনীত হওয়ার পথে সিদ্ধার্থর জীবন গল্পকথা থেকে আমরা আরো এক নারীর খবর পাই। তপস্যারত সিদ্ধার্থের জন্য পায়েস নিয়ে এসেছিলেন সুজাতা, সেই পায়েস খেয়ে শক্তি ফিরে পেয়েছিলেন সিদ্ধার্থ।

 তাহলে সিদ্ধার্থ গৌতম হলেন যিনি সেই আধ্যাত্মিক সাধনা ও জীবন নিয়ে নিজস্ব জ্ঞান উপলব্ধির পর তিনি বুদ্ধ নামটি গ্রহণ করেন। তার জন্ম ৫৬৩ খ্রিস্টপূর্বাব্দ এবং পরিনির্বাণ ৪৮৩ খ্রিস্টপূর্বাব্দ । তাঁর বুদ্ধত্ব লাভই হল বোধিলাভ। দুঃখ ও দুঃখের কারণ সম্বন্ধে জানতে সিদ্ধার্থ তাঁর যাত্রা অব্যাহত রেখেছিলেন। প্রথমে বিভিন্ন সন্ন্যাসী তারপর উদ্দগ্ ---এদের কাছে ঘুরে সন্তুষ্ট না হতে পেরে উরুবিল্ল নামক স্থানে গমন করেন ।সেখানে প্রথমে একটি উত্তর-পূর্বমুখী শিলাখণ্ডের উপর বোধীসত্ত্ব জানু পেতে বসে আপন মনেই বলেছিলেন যে----
"যদি আমাকে বুধ্ধ্বত্ব লাভ করতে হয় তাহলে বুদ্ধের একটি প্রতিচ্ছায়া আমার সম্মুখে দৃশ্যমান হোক "--এই কথা উচ্চারিত হওয়ার সাথে সাথে শিলাখণ্ডের গায়ে ৩ ফুট উঁচু একটি বুদ্ধের প্রতিচ্ছায়া প্রতিফলিত হলো।
বোধিলাভ এর পরই তাঁর দর্শন ও বাণী প্রচার শুরু হয়, প্রায় আড়াইশো বছর পরে । তাঁর বাণী প্রচারের প্রথম দায়িত্ব নিয়েছিলেন সম্রাট অশোক ।চন্ডাশোক থেকে ধর্মাশোকে পরিণত হয়েছিল। একমাত্র বুদ্ধের বাণীর দাঁড়াই এটা সম্ভব। তাই বুদ্ধচরিত আলোচনা করতে গেলে অশোককে বাদ দিয়ে আমরা তা করতে পারি না।
বুদ্ধদেবের জীবন চর্চা ও দর্শন আদি বৌদ্ধ দর্শনের মূল ভিত্তি। আমাদের দেশে বুদ্ধের চিন্তাধারা হাজার বছর ধরে বিবর্তিত হয়েছে ।বুদ্ধদেবের তপস্যালব্ধ জ্ঞান বা উপদেশ বৌদ্ধধর্ম ও বৌদ্ধ দর্শনের মর্ম বাণী। মুখে মুখে তিনি তাঁর বাণী প্রচার করতেন ।তিরোধান এর পর তাঁর শিষ্যরা তাঁর উপদেশগুলোকে পালি ভাষায় গ্রন্থের আকারে সংরক্ষিত করেন ।এই গ্রন্থ গুলিকেই বলা হয় পিটক।
বুদ্ধের আর্য সত্যকে বিশ্লেষণ করে তিনটি দার্শনিক তত্ত্ব পাওয়া যায়। কোন বস্তুই স্বয়ংসম্পূর্ণ বা স্বয়ম্ভু নয় বৌদ্ধ দর্শন অনুযায়ী বোধ্জগত এবং মানসিক জগতে যে ঘটনাগুলি ঘটে, তার মূলে যে কার্যকারণ বিদ্যমান তাকেই দর্শনে প্রত্বীত্ত বলা হয়েছে। জগতে বিনা কারণে কোন কিছু ঘটে না অর্থাৎ "অস্মিন সতি ইদম্ ভবতি "-----আবার এই তত্ত্বের ওপর ভিত্তি করেই বলা যায় সকল বস্তুই সতত পরিবর্তনশীল। কোনো বস্তু স্থায়ী বা সনাতন নয়। সবই সর্বপ্রথম অনিত্য বা অস্থায়ী---- যার উৎপত্তি আছে আবার বিনাশও আছে। সমগ্র জগতের পরিবর্তনের ধাপ সর্বক্ষণ চলমান ।প্রতিটি ক্ষণেই নতুনের আবির্ভাব পুরাতনের বিনাশ অর্থাৎ "সর্ব অনিত্তম্"----- তবে বৌদ্ধ মতে জগত আত্মা 
কোন কিছুর চরম সত্যতা নেই সকল বস্তুই অসাঢ় অর্থাৎ "সর্যম অনাত্মাম্"---একটির পর একটি মানসিক প্রক্রিয়ার অবিরাম প্রবাহকেই বুদ্ধদেব আত্মা বা সোল্ বলেন।
তবে একথা সকলের স্বীকার্য যে "বৈদিক সংস্কৃতির ভয়ানক হিংসার বাতাবরণে অহিংসায় আরাধিতা বৌদ্ধ ধর্ম তৎকালীন মানব জীবনে প্রবাহমান দুঃখের কোন চূড়ান্ত সামাজিক সমাধান দিতে না পারলেও গৌতম বুদ্ধ দুঃখ নিবৃত্তির যে ভাববাদী ধর্মমত প্রচার করেন তা ক্রমে ক্রমে লোকপ্রিয় হয়ে ওঠে এবং তা কেবল ভারতে সীমিত না থেকে তাঁর অনুসারী ভিখ্খুদের মাধ্যমে ভারতের বাইরে অন্যান্য দেশেও ছড়িয়ে পড়ে।"
মহামতি বুদ্ধকে নিয়ে লেখা "বুদ্ধদেব "নামক গ্রন্থটিতে বিশ্ব কবি লেখেন,
"ভারতবর্ষে বুদ্ধদেব মানবকে বড় করিয়াছিলেন তিনি জাতি মানেননি :যাগযজ্ঞের অবলম্বন হইতে মানুষকে মুক্তি দিয়েছিলেন ;দেবতাকে মানুষের লক্ষ্য হইতে অপসৃত করিয়াছিলেন; মানুষ যে হীন দেবাশীষ জড়পদার্থ নহে তাহা তিনি প্রথম ঘোষণা করিয়াছিলেন"
তার ভিক্ষু সংঘ কে লক্ষ্য করে বলেছিলেন-----
"ওহে ভিক্ষুগণ বহুজনের হিতের ও বহুজনের সুখের জন্য দেবতা ও মানুষের কল্যাণের জন্য তোমরা দিকে দিকে বিচরণ কর ;তোমরা স্বধর্ম প্রচার কর; যার আদিতে কল্যাণ; মধ্যে কল্যাণ ;অন্তে কল্যাণ; যার অর্থ -যুক্ত ব্যঞ্জনযুক্ত পরিপূর্ণ ও পরিশুদ্ধ ;সেই ব্রহ্মচর্য প্রচার করো।
বৌদ্ধ ধর্মে তাই দেখা যায় মানুষেরই রাজকীয় আধিপত্য। মানুষই এখানে দেবতার স্থানে অধিষ্ঠিত ।এখানেই যেন বৌদ্ধ দর্শন ও বেদান্তের মেলবন্ধন ঘটেছে। যে বেদান্ত আমাদের শিখিয়েছে____
আমাদের পূজ্য ভগবান রুপী নারায়ণ নয়, নররূপী নারায়ণ---
আজকের হিংসায় উন্মত্ত পৃথ্বীতে মানুষে মানুষে; সম্প্রদায়ে সম্প্রদায়ের ;জাতিতে জাতিতে এবং রাষ্ট্রের রাষ্ট্রের ক্রমবর্ধমান হিংসা-বিদ্বেষ যুদ্ধবিগ্রহ লোভ-লালসা এবং বৈরিতার আবহে হানাহানির মধ্যে মরুদ্যান হয়ে জেগে থাকেন____ সেই পরম করুণাময় মহামতি বুদ্ধ -- আর তার গভীর দর্শন----
তাইতো এই পূণ্য দিনে সকলের ওপর বর্ষিত হোক-
বরিষধারা মাঝে
শান্তিরবারি
শুষ্ক হৃদয়ে লয়ে আছে দাঁড়ায়ে,
ঊর্ধ্ব মুখে নরনারী
বরিষ ধারা মাঝে শান্তির বারি।।

No comments:

Post a Comment