Monday, December 2, 2024


 

ঘন্টাকর্ণ 

জনা বন্দ্যোপাধ্যায়


 স্নিগ্ধ বরফঘেরা পাহাড়ী এলাকা খিরসুতে ঘন্টাকর্ণের মন্দির লক্ষিত হয় l বদ্রীনাথ মন্দিরের প্রবেশপথের ডানপার্শ্বেও দ্বাররক্ষীরূপে ঘন্টাকর্ণের মূর্তিটি সকল দর্শনার্থীর দৃষ্টি আকর্ষণ করে l "ঘন্টাকর্ণ"কে নিয়ে বিভিন্ন পৌরাণিক কাহিনীগুলো অনেকেরই অজানা l মহাভারতের "হরিবংশম"এর বৈশ্য পর্বের একাদশ অধ্যায়ে "ঘন্টকর্ণ" এক পিশাচরূপে বর্ণিত,কৃষ্ণের কৈলাস যাত্রার পথে ঘন্টাকর্ণের সঙ্গে তাঁর সাক্ষাৎ হয়,ঘন্টাকর্ণ কৃষ্ণের প্রকৃত পরিচয় জানতেননা,ঘন্টাকর্ণ কৃষ্ণের কাছে নিজেকে কুবেরের অনুচর ও শিবের ভক্ত বলে পরিচয় দেন ,শিবভক্ত ঘন্টাকর্ণ নিজের দুই কানে দুটি ঘন্টা পরতেন,যাতে বিষ্ণুর নাম তাঁর কানে প্রবেশ না করে l

    ঘন্টাকর্ণ শিবকে তাঁর ভক্তি দ্বারা তুষ্ট করে মোক্ষ প্রার্থনা করেছিলেন, শিব বলেছিলেন বিষ্ণুই একমাত্র মোক্ষদান করতে পারেন l এরপর ঘন্টাকর্ণ বিষ্ণুর উপাসনা আরম্ভ করেন, কৃষ্ণ নিজের স্বরূপ প্রকাশ করেন,ঘন্টাকর্ণ বিষ্ণুর দর্শন লাভ করেন এবং নৃত্যে রত হন,কৃষ্ণের প্রভাবে ঘন্টাকর্ণর পিশাচ শরীরের দৈবশরীরে উত্তরণ ঘটে l

      নীলাচল পর্বতে অবস্থিত কোন কোন মন্দির ভৈরব  ঘন্টাকর্ণর নাম ও কাহিনীর সঙ্গে যুক্ত l নেপালের কাঠমান্ডু ভ্যালির একটি বিশেষ সম্প্রদায় তিনদিনের একটি উৎসব পালন করে যা "গাথেমঙ্গল "নামে খ্যাত,সেখানে এটাই বিশ্বাস করা হয় যে,ঘন্টাকর্ণ একজন  দানব এবং এই উৎসবে দানবের মৃত্যু সূচিত হয়,,অশুভ শক্তির নাশই এই উৎসবের মুখ্য তাৎপর্য্য l

      তবে হরি রাম যোশীর মতো কিছু বিদগ্ধ পন্ডিতের মতে "ঘন্টাকর্ণ" হলেন কুমার কার্তিক,দেবতারা কার্তিককে যেসকল উপহার প্রদান করেছিলেন,সেগুলোর মধ্যে কার্তিক দুটি  ঘণ্টা পছন্দ করে কর্ণে পরেছিলেন বলে তাঁর নাম হয়েছিল "ঘন্টাকর্ণ" l এভাবে নেপালের  সাধারণ মানুষের কাছে ঘন্টাকর্ণ দানব ও বিদগ্ধ পন্ডিতদের কাছে "স্কন্দ" রূপে পরিচিত l

    শৈব পুরাণ অনুযায়ী শিবের চৌষট্টিটি ভৈরবরূপের অন্যতম একটি হল "ঘন্টাকর্ণ" l

     কোনার্কের সূর্য মন্দিরের দুদিকেই দুটি ঘন্টাকর্ণ ভৈরবের মূর্তি স্থাপিত আছে,যাঁরা ছোট্ট নৌকায় নৃত্যরত l এর তাৎপর্য্য-ওই নৌকাটি হল জগৎরূপ নৌকা,ইহলোক থেকে পরলোকের যাত্রাপথে মাঝিরূপে "ঘন্টাকর্ণ "খোদিত হয়েছে l উত্তর থেকে দক্ষিণ সমগ্র ভারতে এরকম বিবিধ তাৎপর্য্যব্যঞ্জক পৌরাণিক কাহিনী "ঘন্টাকর্ণ"-র নামের সঙ্গে যুক্ত l

           পরবর্তীকালে গ্রামবাংলায় ঘণ্টাকর্ণ ঘেঁটু ঠাকুর নামে খ্যাত হন। তিনি সূর্য ও ধর্মঠাকুরের লৌকিক রূপ। কারণ সূর্য ও ধর্মঠাকুর দুজনেই কুষ্ঠ ও নানারকম চর্মরোগ থেকে মুক্তি দেন। চর্মদেবতা ঘেঁটুর নাম ও আচরণ অদ্ভুত। ব্যবহৃত হওয়া আধভাঙা হাঁড়ি উল্টো করে রাখা হয়। এটি আসন হিসাবে ব্যবহৃত হয়। এর ওপর পাঁচদলা গোবর দিয়ে করা হয় ঘেঁটু দেবতার মুখ। চোখ তৈরী করা হয় দুটি কড়ি দিয়ে। কপালে সিঁদুরের তিলক আঁকা হয়। পাঁচ পাক সাদা সুতো দিয়ে ঘেঁটু ঠাকুরদের বন্ধনের ব্যবস্থা করা হয়। হাঁড়ির ওপর ঘেঁটু ফুল রেখে পুজো করা হয়। ফাল্গুন মাসের শেষ দিন এই পুজো হয়।

           এছাড়া অন্য একটি মত অনুসারে একাদশ শতাব্দীতে বাঁকুড়া পুরুলিয়ার বিস্তীর্ণ অংশ জুড়ে বিশেষ করে দ্বারকেশ্বর নদীর তীরে গড়ে ওঠা সমস্ত মন্দির মূলত: জৈন মন্দির। সে সময় জৈন ধর্ম বিস্তার লাভ করায় শৈব বিরোধিতা শুরু হয়। বিষ্ণুপুর ষন্ডেশ্বর মন্দির, পুরুলিয়ার দেউলঘাটার প্রাচীন মন্দিরে জৈন স্থাপত্য লক্ষিত হয়। ঘন্টাকর্ণ শৈব উপাসক ছিলেন। তিনি শিব নিন্দা শুনবেন না বলে কানে ঘণ্টা ঝুলিয়ে গ্রাম থেকে গ্রামান্তরে ভিক্ষা করতেন। ধারণা করা হয় শৈব ধর্মের পাশাপাশি জৈন ধর্ম গড়ে ওঠায় জৈন ধর্মের ভিক্ষা আচারের সাদৃশ্য লক্ষিত হয়। ঘেঁটু হলেন ভিখিরি ঘন্টাকর্ণর লৌকিক রূপ। ফাল্গুন মাসের বিকেল বেলা বাংলার গ্রামে শহরে বাচ্চারা ছোট্ট ঝুড়িতে ঘেঁটু নিয়ে ভিক্ষা করতে বেরোয়।

No comments:

Post a Comment