পাঠ প্রতিক্রিয়া
পদ্য
সম্পাদক: রিমি দে
`সত্য ও সততা` নিয়ে রিমি দে সম্পাদিত `পদ্য`- এর উৎসব সংখ্যা ২০২৪ নিজস্ব দ্যুতিতে উজ্জ্বল। বিষ্ণু সামন্তের প্রচ্ছদে ছিমছাম মেদহীন পত্রিকাটি মূলত কবিতা ও কবিতা বিষয়ক। প্রচ্ছদ ছবিতে রঙের ব্যবহারে শিল্পী তাঁর নিজস্ব মুন্সিয়ানার ছাপ রেখেছেন। ব্যাক কাভারে পদ্যের বিভিন্ন সংখ্যার প্রচ্ছদ ছবি রাখবার ভাবনাটিও অভিনব। বিস্মৃতপ্রায় সঞ্জয় ভট্টাচার্য্য, সত্যপ্রসন্ন দত্ত প্রমুখের উল্লেখে একটি শক্তিশালী সম্পাদকীয় লিখেছেন রিমি দে। এই অসত্য ও মিথ্যের সময়ে এইরকম সম্পাদকীয় দুবার ভাবায় বৈকি !
'কিছুটা সময়' পর্বে শুভংকর গুহ, বিজয় দে, প্রবাল কুমার বসু, তৃপ্তি সান্ত্রা, বিপুল দাস প্রমুখ ব্যক্তিত্বদের সঙ্গে কথা যথাক্রমে মানসী কবিরাজ, জয়শীলা গুহ বাগচী,, প্রিয়াঙ্কা চৌধুরী, নবনীতা সান্যাল, তপতি বাগচী। প্রতিটি সাক্ষাৎকারেই অত্যন্ত খোলামেলাভাবে কথা বলছেন এই লেখক-কবিরা। তাঁদের কথা পাঠে আগামী প্রজন্ম যেমন দিশা পাবে, তেমনি তাঁদের পাঠকেরাও প্রিয় লেখকদের সম্পর্কে জানতে পারবে। যেমন শুভংকর গুহ বলছেন, `মহৎ ও কালজয়ী সাহিত্য রচনা কখনোই বেষ্ট সিলিংয়ের তকমা অর্জন করে না। সেই সব রচনা ভাষা ইতিহাসের অংশীদার হয়ে ওঠে। যুগ যুগ ধরে পাঠক সেই সব গ্রন্থ বা রচনা সংগ্রহ পড়ে যান`। আবার বিপুল দাস মনে করেন, `জীবনের সত্যকে অনুসন্ধান করাই তো সাহিত্যের প্রধান লক্ষ্য। এই সত্যকে খুঁজতে গিয়ে লেখককে অবশ্যই ইতিহাস-সচেতন হতে হয়`। এইরকম টুকরো টুকরো কথার মধ্যে দিয়ে এই সৃষ্টিশীল মানুষদের মনন ও বীক্ষা খুঁজে পাই আমরা। সেদিক থেকে দেখতে গেলে `পদ্য`-এর এই সংখ্যাটি অভিনব। উল্টোদিকে এটাও ঠিক যে, প্রশ্নগুলি যথেষ্ট অনুশীলনের ফসল এবং সত্য ও সততা বিষয়ক।
সত্য ও সততা সম্পর্কে তাঁদের নিজস্ব ধারণা মেলে ধরেছেন চৈতালি চট্টোপাধ্যায় থেকে কৌশিক জোয়ারদার সহ অনেকেই `সমীক্ষা` অংশে। ব্যক্তিগতভাবে অনেকের সঙ্গে আমার ধারণা না মিললেও, সমৃদ্ধ হয়েছি এই বিশিষ্টজনেদের মতামত জেনে। সম্ভবত এই অংশটি সম্পাদকের নিজস্ব উদ্ভাবন। ভাল লাগল চেনা বৃত্তের বাইরে তিনি অন্যরকম ভেবেছেন।
মহাত্মার সত্য, অনুভবের সত্য, সত্যজিতের সত্য, মাটির সত্য, সত্যর গল্প, সত্যি কথা, শিল্পের সত্য ইত্যাদি শিরোনামে সৈয়দ কওসর জামাল, চিত্তরঞ্জন হীরা, সুতপা সাহা, মৌকণা, কল্যাণী লাহিড়ী, সোমনাথ ঘোষাল, শবরী শর্মা রায়, সুবীর সরকার, শংকর চক্রবর্তী, বিতান চক্রবর্তী, সব্যসাচী মজুমদার, শ্যামলী সেনগুপ্ত, শ্রেয়সী গঙ্গোপাধ্যায় প্রমুখের সৃষ্টিগুলি নিজস্ব আলোতে ভাস্বর। প্রত্যেকেই নিজের সুনাম বজায় রেখেছেন। তবে `সত্য ও সত্যতা: পারাপারের খেয়ে ও কিছু পূর্বমুহূর্ত` ব্যক্তিগত পছন্দে খুব ভাল লেগেছে। `ভাদু রূপেতে আলা/ গলেতে মালা/ জরি বসানো ভাদুর গামছা` অত্যন্ত তথ্যমূলক এবং জানবার আগ্রহ বাড়িয়ে তোলে। `সত্য ও সততা` লেখাটিতে লেখকের ব্যক্তিগত অভিজ্ঞতায় যাঁর কথা বলেছেন, সেরকম প্রণম্য মানুষদের আজ বড্ড অভাব। কোনও তত্ব কথা নেই, শব্দের মায়াজাল নেই, একই বিষয় ও গদ্যের একঘেয়েমি নেই এই লেখাটিতে। নিটোল একটি ছোট্ট লেখা।
'সত্য নিয়ে কথাবার্তা' অংশে স্বপন রায় ও উমাপদ কর যে ফুল ফুটিয়েছেন তা বুঝতে গেলে রীতিমতো পড়াশোনা দরকার। আসলে পাঠককেও তো লেখাপড়া জানতে হয়। পাঠের অভ্যাস করতে হয়। যে মিথষ্ক্রিয়ামূলক বীক্ষণের সাক্ষ্য তাঁরা রেখেছেন তা সত্যিই অসামান্য। এইরকম আলোচনা আরও হওয়া দরকার। তাহলে আমার মতো সাধারণ পাঠকরা উপকৃত হবেন। কেননা বোধের একটি নির্দিষ্ট স্তরে না পৌঁছলে এরকম সুচিন্তিত কথাবার্তার ধরতাই সম্ভব নয়।
অনুবাদ কবিতা সহ পরিচিত অপরিচিত, নামী অনামী বহু কবির কবিতা রয়েছে এই সংখ্যায়। আলাদা করে কারও নাম উল্লেখ করছি না। অধিকাংশ কবিতাই প্রত্যাশা পূরণ করে। তবে সম্পাদককে অনেক সময় সাহিত্যের স্বার্থে সত্যের মুখোমুখি হতে হয়। কঠোর হাতে অনেক লেখাকে প্রকাশের বাইরে রাখতে হয়। সেখানে ব্যক্তিগত সম্পর্ক দেখলে চলে না। কিছু কবিতার ক্ষেত্রে আমার মনে হয়েছে, সম্পাদককে অনুরোধের বা সুপারিশের ঢেঁকি গিলতে হয়েছে ।
একশো বারো পাতার শীর্ষকে কবিতা ৩ এবং ১৪৭ পাতার শীর্ষকেও কবিতা ৩ ছাপা হয়েছে। সম্পাদকের নজর এড়িয়ে গেছে এটি। সূচিতে অবশ্য ১৪৭ পাতায় কবিতা ৪ উল্লেখ আছে। একশো আটত্রিশ পাতার কবি মহুয়া ও ১৫০ পাতার মহুয়া নামের কবি কি আলাদা? সেক্ষেত্রে আলাদা ব্যাপার। তবে যদি একই ব্যক্তি হন, তাহলে দুটি কবিতা আলাদা আলাদা করে রাখার অর্থ বুঝলাম না।
মুদ্রণ ভাল। কাগজও ঝকঝকে। ছাপার কিছু ভুল আছে। সামান্যই। সম্পাদকীয়তে যতিচিহ্নের পরে নতুন লাইন শুরু হওয়ার মুখে স্পেস না থাকাও বাঞ্ছনীয় ছিল না।তবে সুবিশাল কাজ করতে গেলে এরকম দু`একটা হয়ে থাকে। সেটা বড় ব্যাপার নয়।
আসলে লিটিল ম্যাগাজিনের জন্য দরদ ও একনিষ্ঠতা থেকে `পদ্য` সম্পাদিত ও প্রকাশিত হয়। এই দুটি বিষয় থাকলে পত্রিকা ভাল হতে বাধ্য। রিমি দে সেই ব্যাপারটি নিয়মিত করে যাচ্ছেন। এখানেই সম্পাদক হিসেবে তাঁর সার্থকতা। সাফল্য? সেটা অবশ্য কী আজও বুঝিনি।
আলোচনা: শৌভিক রায়
No comments:
Post a Comment