পুজো আসছে
সূদীপ কুমার বোস
আলিপুরদুয়ার জেলার প্রত্যন্ত এক গ্রামে পূর্ণচন্দ্র বানিয়ার বাড়ি।
বুড়ো বাবা মা, স্ত্রী রমা আর দশ বছরের মেয়ে কাজল ও আট বছরের ছেলে রতনকে
নিয়েই তার সংসার। পেশায় কৃষক কিন্তু পূজার মরশুমে ঢাক বাজায় সে। বিশ্বকর্মা
পুজোর আগে থেকেই বাড়ির বাইরে থাকতে হয়। ঢাক বাজিয়ে শ্যমাপুজোর শেষে বাড়ি
ফিরে আসে। কোনো দিনই পুজোর মরসুমে পরিবারের সাথে কাটাতে পারে না। এবছর
করোনা সংক্রমণের জন্য এখনও পর্যন্ত কোন পুজো কমিটি থেকে ডাক পায়নি।
কাজল আর রতন খুব খুশি। জীবনে এই প্রথম পুজোতে বাবার সাথে থাকতে পারবে।
তাই
তাদের প্রস্তুতি তুঙ্গে। স্কুল বন্ধ বলে তাদের দুজনের হাতে অফুরন্ত সময়।
দুজনে মিলে লুকিয়ে লুকিয়ে ঢেকি শাক, কলমি শাক, শাপলা বিক্রি করে পয়সা
জমাচ্ছে। বাবার মনটা খুব খারাপ তো। এবার ঢাক বাজাতে বাইরে যেতে পারছে না।
তাই বাবার কাছে এবার কোন কিছুর জন্যই বায়না করবে না। স্কুল বন্ধ ছিল জন্য
স্কুল ড্রেস গুলো নতুনই আছে। পুজোতে ওই ড্রেস পরেই ঘুরবে। তাদের একটাই
ইচ্ছে পুজোতে বাবা, মার সঙ্গে একদিন শহরে দুর্গাপুজো দেখতে যাবে। ঠাকুমা আর
দাদুকেও সাথে নেবে। শহরে গিয়ে জমানো পয়সা দিয়ে ফুচকা, এগরোল, আইসক্রিম
খাবে। চিন্তা শুধু একটাই, দাদু আর ঠাকুমা অতদূর হাঁটতে পারবে তো?
পূর্ণচন্দ্রের স্ত্রী রমাও খুব খুশি। বিয়ের পর প্রথম স্বামীর সাথে
পুজো কাটাবে। পুজোর কটা দিন যাতে স্বামীকে একটু ভালমন্দ খাওয়াতে পারে
সেজন্য হাঁস-মুরগির ডিম বিক্রি করে পয়সা জমাচ্ছে। পারলে গাঁয়ের গঙ্গাধর
ফেরিওয়ালার থেকে একটা পায়জামা পাঞ্জাবীও কিনবে। লোকটাতো পুজোতে কোনদিনই
নতুন জামা কাপড় পরতে পারেনি।
পূর্ণচন্দ্রের
বাবা মাও খুব খুশি। কতদিন পর ছেলেটাকে পুজোর সময় কাছে পাবেন। পুজোর সময়
বিদেশ-বিভুঁইয়ে কি খায় কে জানে! তাই বুড়ো-বুড়ি বার্ধক্য ভাতার পয়সা জমিয়ে
রাখছেন। বুড়ি এখন থেকেই নারকেলের নাড়ু, মুড়ির মোয়া, খইয়ের মুড়কি বানানোর
প্রস্তুতি শুরু করে দিয়েছেন। ছেলেটাকে একদিন লুচি-পায়েসও বানিয়ে খাওয়াবেন।
ফেরিওয়ালা এলে একটা পায়জামা পাঞ্জাবী কেনার ইচ্ছেও আছে। কতদিন ছেলেটাকে
নতুন জামা কাপড় কিনে দেননি!
পুজোতে ঢাক
বাজানোর বায়না না হওয়ায় পূর্ণচন্দ্রের মনটা খুবই খারাপ ছিল। পুজোর সময় তো
কখনও বাড়ির কারও জন্য জামা-কাপড় কিনতে পারত না। পুজোয় ঢাক বাজিয়ে ফিরে এসে
শ্যমাপুজোর পর সবাইকে জামা কাপড় কিনে দিত। অকস্মাৎ তার কাছে পুজোর আনন্দ
ফিরে এল! এই প্রথম লটারির টিকিট কেটেছিল। তাতে দশ হাজার টাকা পেয়েছে!
আনন্দে উৎফুল্ল পূর্ণচন্দ্র বাড়ির কাউকে জানায়নি। ষষ্টির দিন বাজারে গিয়ে
রমার জন্য শাড়ি, বাবার জন্য ধুতি, মায়ের জন্য শাড়ি, ছেলে-মেয়ের জন্য
জামা-জুতো কিনে নিয়ে আসবে। বাড়ির সবাই মিলে একদিন ইলিশমাছ আর একদিন মাংস
ভাত খাবে। পুজোতে সবাইকে নিয়ে শহরে পুজো দেখতে যাবে। বাবা-মা এতদূর হাঁটতে
পারবে না তাই বলাইয়ের টোটো বলে রেখেছে। বাড়ির লোকেরা যখন জানতে পারবে তখন
দারুণ খুশি হবে! বিশেষ করে ছেলে মেয়েদুটো। এবার পুজোতে ঘুরতে গিয়ে ছেলে
মেয়ে দুটো যা খেতে চাইবে তাই খাওয়াবে। মনটা আনন্দে ভরিয়ে দেবে তাদের!
পুজো আসছে! পুজো আসছে! পুজো আসছে! ওই তো ভোরবেলায় উঠোনে শিউলির
আলপনা। ওই তো পুকুরে কানাকানি করে শাপলা শালুক। নীল আকাশে অলস মেঘেরা
নিশ্চিন্তে শুয়ে আছে। শুধু ঝাপসা চোখে পূর্ণ চন্দ্র বানিয়া দেখে তার ঢাকটা
ঘরের এককোণে দাঁড়িয়ে আছে বিষন্ন মুখে! একটা মন-খারাপিয়া বাতাস ঝাপটা দিয়ে
যায় তার বুকে! পুজো কি সত্যিই আসছে?
No comments:
Post a Comment