Saturday, October 31, 2020


 

 

 

 

 

 

 

 

 হাসি

 দেবদত্তা লাহিড়ী

                                 
যতক্ষণ সে মোবাইলে ডুবে থাকে-মুখের হাসি তার মেলায় না|প্রোফাইল জুড়ে কচি খুকিরা আর তাদের ছবি ও নেকুপুশুপনা-মেজাজটা বেশ ফুরফুরে করে দেয়|এঞ্জেল প্রিয়া আর দুষ্টু রিয়ার খান পঞ্চাশেক ছবিতে লাইক আর  ভেরী নাইস কমেন্টে ভরিয়ে ,একটা খুশীর নিশ্বাস ফেলে অনিমেষ|,মোবাইল টেবিলে রেখে,মাথার পেছনে হাতদুটি আরাম করে থিতু করে চেয়ারে এলিয়ে বসতেই চোখ যায় তনিমার দিকে|এ্যাঃ|বউএর কটমটে চাহনিটা এক নিমেষে আবেগ আর আমেজ দুটোই নিমেষে "ফুস" করে দিল বছর পঞ্চাশের অনিমেষ এর|চাহনির উত্তর না দিয়ে সিগারেটের প্যাকেটটা পাঞ্জাবীর পকেটে চালান করে আবাসনের ছাতের উদ্দেশ্যে রওনা দেয় সে|এই এক আ্যপ বিচরণ,আরএক ঐ ছাত-এ দুখানি ই তো তার জীবনের মুক্তমঞ্চ|বাকি যা ছিল সবই তো কবেই তনিমা কেচে ঝেড়ে মেলে দিয়েছে|রাগ হলেও কিছু বলতে পারেনা সে| রোজগার বলতে নেই তার কোনদিন তেমন|ফ্ল্যাটটুকুও তনিমার বাবার দাক্ষিণ্যেই|ধুর ধুর |বউ এর কথা মনে হতেই ত্রিশ হতে চলা  নিঃসন্তান বিবাহিত জীবনের তিক্ততা সুখটানের ধোঁয়ায় উড়িয়ে দিতে মনস্হ করে অনিমেষ|
দুপুরে খাবার সময় ও মোবাইল হাতে নিতে একই বিপত্তি|দ্বিপ্রাহরিক ভাতঘুম টা তনিমা কেন যে বন্ধ করে দিল?সব বোঝে অনিমেষ-    ঐ তো তাকে চোখে চোখে রাখতে| আর কি?        সন্ধ্যার অদম্য আকর্ষণ সিরিয়াল গুলো ও তনিমাকে আজকাল আর আটকে রাখতে পারেনা|জীবন অতিষ্ঠ হয়ে ওঠে অনিমেষের|একদিকে এঞ্জেল ,দুষ্টুদের হাতছানি ,অপরদিকে তনিমার কটমটে চোখের কামড়ানি|রাতে বালিশে কাত হয়ে শুয়ে লুকিয়ে ছবিতে স্তুতির বন্যা বইয়ে আর এক কাত হতেই মোবাইল টা হাত থেকে পড়ে যাবার যোগার হয় তার|বউ রক্তচক্ষুতে তাকিয়ে| "পিশাচী" মনে মনে বলে মোবাইল নামিয়ে চোখ বোজে সে|একদিন ঘুম থেকে উঠে রক্তচাপ বেড়ে যায় তার।প্রোফাইলে  চোখ রাখতেই|দুষ্টু ,এঞ্জেল ওরা কেউ নেই|তন্ন তন্ন করে খোঁজে সে|নাহ্|নেই|মনটা বেজার হয়ে যায় ওর। মেয়েগুলো ওকে তালে--|গোটা দিনটা যে কিভাবে কাটে ওর|ধূসর রং টা আসলে কি,সেটা বোধহয় মনখারাপ আর শূণ্যতার সংমিশ্রণেই বোধগম্য হয়|বিকেল গড়িয়ে সন্ধ্যা নামতে নামতে সে মনখারাপ একটা নিকষ কালো প্রতিশোধ স্পৃহায় পর্যবসিত হয়|সার্চ মোডে নাম দুটো ফেলে প্রোফাইল দুটো সে খুঁজতে থাকে|ঘন্টাদুয়েক হানা চালিয়েও ব্যর্থ হয় সে|অবসন্ন পায়ে শোবার ঘরের দিকে এগোতে বন্ধ দরজার ওপার থেকে কানে আসে তনিমার গলা|দূরভাষে|চাপা উল্লাসে কাউকে জানাচ্ছে তার সাফল্য কাহিনী|সব টা শুনে মাথায় রক্ত চড়ে যায় অনিমেষের|সাত তাড়াতাড়ি ব্লক লিস্ট থেকে আনব্লক করে মেয়েদুটোকে রিকোয়েস্ট পাঠায় সে|জবাবে মেসেঞ্জারে দুটো ধমক আসে|সাথে অনিমেষের কমেন্টের স্ক্রিনশট|তারপর ই ওপার সব অন্ধকার|হাহাকার করে ওঠে ওর পুরুষত্ব|মাথা খুঁড়েও সে মনে করতে পারেনা কবে এমন লিখল| ভালো করে পড়ে দেখে এ ভাষা তার নয়|তবে কমেন্ট গেছে তার প্রোফাইল থেকেই|তনিমা!শুধু ব্লক করেই সে ক্ষান্ত থাকেনি|

আজকাল তনিমা বেশ খুশী খুশী থাকে|ওর খুশী হওয়াটা বুকে হাতুড়ী দিয়ে দমাদ্দম মারতে থাকে অনিমেষের|রাতে শোবার আগে তনিমা দুটি করে প্রেশার কন্ট্রোলের ওষুধ খায়|সকালে আরো দুটি|এর যাতে অন্যথা না হয় তার জন্যে সে গুনেগেঁথে সাত দিনের ওষুধ পাতা ছাড়িয়ে রেখে দেয় একটা সাদা বাক্সে |গুনতি মাফিক ওষুধ শেষ হলে আবার পুরে রাখে আগামী সাত দিনের|কড়া লক্ষ্য শরীরের প্রতি তার|অথচ দিন দুয়েক হল শরীর টা তেমন ভালো ঠেকছেনা তার|ডাক্তার দেখাবার কথাটা মনে আসে|কিন্তু শরীর খারাপ ছাপিয়ে যায় স্বামীকে শায়েস্তা করার আনন্দে|কিচেনে দাঁড়িয়ে আটা মাখছিল সে|সকালের জলখাবারের ব্যবস্হা|হঠাৎ অনিমেষ কে ডাইনিং টেবলের চেয়ারে বসে থাকতে দেখে অবাক হয়ে যায় সে|সে তো এত সকালে ওঠবার পাত্র নয়|

একটা অস্বস্তি নিয়ে তনিমার দিকে তাকিয়ে ছিল অনিমেষ|আজ তিনদিন হল তনিমার কৌটোর ওষুধ সে বদলে দিয়েছে,কিন্তু তেমন কিছু ঘটাতো দূর তনিমাকে খুশী ই দেখাচ্ছে| ভাবনার সুতো হঠাৎ ই ছিঁড়ে যায় তার|তনিমা ঘামছে|প্রবলভাবে|
মিনিট ত্রিশেকের মধ্যে সমস্ত ব্যপার টা কমপ্লিট হয়ে যায়|মাথা ঘুরে পড়ে যাবার সময় রান্নার গ্যাসের স্ল্যাবে মাথাটা বিশ্রীভাবে ঠুকে গিয়েছিল তনিমার|স্ট্রোক না হোক ,রক্তপাতেই...|নিশ্চিন্তে ঘরে ঢুকেওষুধ গুলো পুনরায় পাল্টে ,চাদর জড়িয়ে ঘুমিয়ে পড়ে সে|ঘুম ভাঙেনি বলাতে কেউ অবিশ্বাস করেনি|ঘুমের ওষুধ খায় সে শোবার আগে|ডাক্তারি প্রমাণপত্র ও রয়েছে|তাছাড়াও গোবেচারা দেখতে,সাতে পাঁচে না থাকা নিরীহ মানুষ অনিমেষ|এমনকি ঝগড়া করলেও তনিমার গলাই শোনা যেত|কারো কোন সন্দেহ ই এলনা মনে|জেঠিমা অপঘাতেই মরল,বেচারা অনিমেষ একা হয়ে গেল|সকলে সমবেদনা জানাল তাকে|শুধু অনিমেষ একা নক্ষ্য করল -চুল্লীতে দেহ ঢোকাবার আগে,তার মোবাইলে টুং  করে একট নোটিফিকেশন ঢুকতেই কার একটা হাত লেগে তনিমার মাথাটা তার দিকে ঝুঁকে পড়েছিল|চোখটাও আধখোলা হয়েছিল কি?মনে মনে অট্টহাসি হাসে সে -"এবার তাকাও দেখি কটমট করে| ?"শ্রাদ্ধশান্তি সব চুকতে সকলকে দরজার ওপারে প্রায় পগার পার করে এবার প্রাণভরে শান্তির নিঃশ্বাস নেয় সে|শোবার ঘরে ঢুকে বালিশ টা আয়েস করে মাথার তলায় দিয়ে চলতে থাকে তার একক অভিসার|মুখের হাসি আজ আবার ফিরে এসেছে তার|ঘন্টা দুয়েক বাদে দুষ্টু মিষ্টি দের ছবিতে মন ভরে আসে তার|এবার ঘুমোতে হবে|অভ্যাসমত পাশ ফিরে শুতেই হৃদযন্ত্র প্রবল আতঙ্কে বন্ধ হয়ে আসে |ঐ তো তনিমা|পাশের বালিশে|কটমটে চোখ ,সাথে মুখে একটা বিভৎস হাসি|পরদিন পরিচারিকার হাঁকডাকে অনেক বেলায় দরজা ভেঙে যখন আবাসনের বাসিন্দারা অনিমেষ এর দেহ উদ্ধার করে ,তখন ড্রইং রুমে শ্রাদ্ধবাসরের রজনীগন্ধার মালা ঝোলান ছবিতে তনিমা মিটিমিটি হাসছে|




No comments:

Post a Comment