কতো আকাশ
গৌতম বিশ্বাস
বিকেলের দিকে আকাশটা বড়ো নিচে নেমে আসে ডাক্তারবাবু । আর পেটে তলায় তলায় চাপ ধরে ।
তবে যে চালাচ্ছিস রিক্সা ?
সে আপনি , তাই । নইলে কতক্ষণ চলে যেতাম বাড়ি ।
হুম , বুঝেছি । একবার আসিস ।
ডাক্তার অবশ্য কোয়ার্টার অবদি যায়না । মাঝে দিপ্তীদির চায়ের ঠেকে নেমে যায় । রসুল গিয়ে বাড়ি পৌঁছে দেয় ডাক্তারি পোশাক । ওর বৌদি যা দেবার দেয় । ব্রিজ ব্রতময়ের অনেকদিনের নেশা ।
আজ কিছু দেরি হ’ল। পুজোর চাঁদা চাইতে এসেছিলো ছেলে ছোকরা সব । ডাক্তার কিনা । দাবী তাই ল্যাজেগোবরে করে দেবারই কথা । সেইসব চাপান উতোর , দু’এক কথাবার্তায়, দেরী হয়ে গেলো ।
সে এক। কিন্তু রসুল যা বলল , সে ভাবনার কথা । আকাশ নিচে নেমে আসে । কাব্য নয় । কাব্য করার কথা নয় রসুলের । তার মানে , তার মানে কি দমচাপা লাগে ? দমচাপা লাগলে কি আকাশ নিচে নেমে আসে , ঘিরে ধরে , পেটের তলায় তলায় !
না , আজ আর খেলা হবেনা । ব্যাপারটা ভাবাচ্ছে বড়ো । আকাশ নেমে এলে পেটের তলায় তলায় চাপ ধরে । এতদিন থেকেও এদেশের ভাষা শিখলোনা ডাক্তার । পেটের তলায় নয় , তলায় তলায় ।
অদ্ভুত । ভাবনাটা ভেবলে দিচ্ছে । কথা সহজ নয় । ডাক্তারি শাস্ত্রে পেটের তলায় তলায় ব’লে কিছু কি লেখা আছে ? কই , দেখেনি তো !
আকাশ নেমে আসে , তারইবা মানে কী ? বিকেলের দিকে নামে ।
বড়ো বিব্রত বোধ হচ্ছে ।
আজ ছ’মাসের ওপর ব্রতময় এই কানাঘটি গ্রামের হাসপাতালে এসেছে । সেই শুরু থেকেই রসুলের রিকশা। আধঘন্টাটাক পথের বাড়ি ফেরা । নানা গল্পই হয় । বেশিভাগই রসুলের পরিবারের নানা অসুখ , আরো নানা গ্রামীন ব্যাপার স্যাপার । কিন্তু তার নিজের কোনও অসুখ ছিলো কখনও বলেনিতো !
চায়ের দাম মিটিয়ে উঠে পড়ল ব্রতময় । দশ মিনিটের পথ । হেঁটেই ফেরে বরাবর ।
চান সেরে মেঘনাকে বলতে সে তো হেসেই কুটিকুটি । বলে , তুমিও যেমন , তোমার পেশেন্টও তেমনি । রাজযোটক । ডাক্তার পদ্য লেখে , মাথায় আকাশ ভেঙে আসে রিকশাওলার ।
ব্যাপারটা অত সহজ নয় , বুঝলে । সব অমন দুচ্ছাই করে ফেলে দিলে হবেনা ।
তুমি নিশ্চিত , ও এমনটাই বলেছে ?
তবে আর বলছি কী ? সেই জন্যেই তো খটকা গো ।
তবে আর কী । যে বলেছে তাকেই জিজ্ঞেস করো ।
রাতে আজ ঘুম হবেনা । বিকেলের দিকে আকাশটা বড়ো নিচে নেমে আসে ডাক্তারবাবু , আর পেটে তলার তলায় চাপ ধরে ।
উঠে পড়লো ব্রতময় । হালকা চাদর গায়ে বেড়িয়ে এলো পথে । রাত কতো হবে ,সাড়ে তিনটে কি পৌনে চারটে । আপাতত দিপ্তীদির চায়ের দোকান ।
আকাশে রঙ লাগতে এখনো কিছু দেরি ।
২
বিকেলের দিকে আকাশ কি সত্যিই নেমে আসে রে রসুল ?
আসেতো ।
আর পেটের তলায় তলায় ব্যথা করে ?
ব্যথা তো বলিনি , চাপ ধরে বলেছি ।
একটু ভেঙে বলবি তো নাকি । নইলে চিকিৎসা কি ছাই হবে ? তলায় , না তলায় তলায় ?
বলছি তো তলায় তলায় । ছাড়ুন ডাক্তারবাবু , বাদ দিন । ও কিছু নয় ।
তা বললে হচ্ছেনা রসুল । রাতে ঘুম হয়নি আমার । ভোরে দিপ্তীদির চায়ের দোকানে বসেছিলাম জানিস ? ঘুম এলোনা সারারাত ।
আজ আর নতুন কবিতা নেই , ডাক্তারবাবু ?
এই এই ডান দিকে যা , ডাইনে ফের রসুল ।
ফিরতেই বুড়োধন বট । কবেকার কে জানে । দু’শো তিনশো , নাকি আরো কত বছরের জন্ম । পাকুড় আসলে । কী মহিমা । সে যে দেখেছে , সে জানে ।
সেইখানে রিকশা থামতে বসলো গিয়ে দুজনা ।
নে , এবার বল ।
বিরাট বটের চাঁদোয়া নামিয়ে এনেছে আকাশ । ব্রতময় রসুলের এতটা পাশে ঘেঁসে বসলো , ওর ঘামের গন্ধ পাচ্ছে ।
কি রে , বল । এইতো আকাশ নেমে এসেছে । তোর পেটের তলায় তলায় চাপ লাগছে কিনা বল ।
রাজাকার জানেন , ডাক্তারবাবু ?
হু , জানি বৈকি , মুক্তিযুদ্ধের বিট্রেয়ার ।
মুক্তিযুদ্ধ জানেন ?
জানি মানে , দেখিনি তো আর , শুনেছি । তা তুই হঠাত মুক্তিযুদ্ধ নিয়ে পড়লি যে বড়ো ? তুই জানিস নাকি মুক্তিযুদ্ধের কথা ।
শেষ অব্দি জানিনা । পালিয়ে এসে ছিলাম । আসলে
কী বলছিস রসুল , তুই মুক্তিযুদ্ধ দেখেছিলিস !
শুধু তাই নয় ডাক্তারবাবু , আমার বাবা ছিলো একজন রাজাকার ।
বলিস কী !
ঠিকই বলছি ডাক্তারবাবু , বাবাকে টেনে নিয়ে কোথায় ফেলে দিয়েছে জানিনা । পারলে আমিও করতাম । আমার জন্মদাতা , পিতা একজন রাজাকার ছিলেন । যদি জানতাম , আমিই খুন করতাম ওঁকে । আল্লাহ আমায় সে সুযোগ দিলেন না ।
তারপর ?
আমার বন্ধু সমর খবর এনেছিলো । বাবার হত্যায় হয়তো সেও শামিল ছিলো । কিন্তু সে ছিলো আমাদের ইস্কুলের সেরা ছেলে । আর আমার জিগরি দোস্ত । জানিনা বেঁচে আছে কিনা ।
হ্যাঁ , কী বললো সে ?
বললো , জলি , আমার ডাকনাম ছিলো ওটাই , বললো , ভাগ জলি , চাচাবাবু নেই , শেষ , এবার তোকে ধরবে ওরা । ভাগ , ভেগে যা ইন্ডিয়া । তো এলাম । সাঁতরে নদি পার হয়ে না খেয়ে না দেয়ে এলাম । ভিক্ষে করে চললো কিছুদিন । কতই বা বয়স তখন , চোদ্দ , পনেরো , কে জানে ।
তারপর ? এছাড়া আর কিছু আসছেনা জিভে ।
ফিকে হয়ে আসছিলো সব । কম সময় তো নয় । শরীর ভেঙে আসছিলো । ভাবলাম , একবার দেশটা না দেখেই মরে যাবো ?
গেলি ?
না । সে আর হ’ল কই । ওপাড়ার এক বাড়ির বাবুকে নিয়ে গেছিলাম সেদিন রিকশায় । দেখি ছবি হচ্ছে ।
টিভি ? হ্যা , দাশগুপ্ত বাবুর আছে । ছবি হচ্ছে তো কী ?
না , ছবিতে পদ্মা ছিলো । আমি দেখেছিলাম । জল খাবার ছুতোয় , এই একটু শরীর খারাপ এসব করে বেশ অনেকক্ষণ দেখেছিলাম ।
বেশ করেছিস দেখেছিস । কিন্তু তাতে কী হল ?
দেখছিলাম আমার দেশ । আহ আমি কি চাইনি , বলো ডাক্তারবাবু , শুধু বাবার কারণে ।
হুহু করে কেঁদে উঠলো রসুল ।
শুধু বাবার কারণে আমি আমার একান্ত নিজের আকাশ হারালাম ডাক্তারবাবু ।
বুঝেছিরে । চল । বলে ঘারে হাত দিয়ে রসুলকে নিয়ে চললো ব্রতময় ।
৩
রিকশা চালাচ্ছে ডাক্তার । রসুল হোই হোই, লাগলো লাগলো , করে চলেছে ।
এখন আর বিকেল নেই । চাঁদ উঠেছে অনেক ওপরে আকাশে । একটা আকাশ ।
No comments:
Post a Comment