সাঁঝবাতি
সায়ন্তন ঘোষ
:প্রথম অংশ:
অসিতবাবু সন্ধ্যাবেলায় হাট থেকে ফিরে বাইরে উঠোনে মাদুর পেতে বসেছেন সবে। সারাদিন ক্লান্তির পর একটু চোখ বুঁজে জিইয়ে নেওয়ার পালা। বউমা এসে পাশে একটি ঘটিতে জল দিয়ে বললো, "বাবা আমি তুলসী তলায় সাঁঝবাতি জ্বালিয়ে এসে আপনাকে খাবার দিচ্ছি। আপনি ততক্ষণ চোখে জল দিয়ে একটু বিশ্রাম করুন।" বলেই কুয়োরপাড়ে হাত মুখ ধুয়ে ঘরে চলে গেলো। অসিতবাবু বউমাকে সাবধানে কাজ করতে বললেন, কারণ সে গর্ভবতী। চার বছর হলো তার স্ত্রী মারা গেছেন। ছেলে পুলিশের চাকরি করে, সারাদিন ডিউটি করে বাড়ি ফিরতে অনেক দেরি হয়ে যায়। তাই বউমার সুবিধা অসুবিধা দেখার দায়িত্ব শ্বশুরমশাইয়ের ওপরেই বর্তায়। যাই হোক, কুয়োরপাড় থেকে ঘরে গিয়ে পরিষ্কার কাপড় পরে, হাতে পূজার থালা নিয়ে বাইরে বেরিয়ে আসে বউমা। তুলসীতলার সামনে দাঁড়িয়ে মাথায় ঘোমটা দিয়ে প্রণাম করে প্রদীপ, ধূপ দেখালো এবং শাঁখ বাজালো। প্রতিদিনের মতো ওই এক সময়েই একসাথে গাঁয়ের আসে পাশের বাড়ি থেকে বা যতদূর পর্যন্ত শ্রবণশক্তি প্রখর থাকে ততদূর থেকে শঙ্খধ্বনি শোনা গেলো। অসিতবাবু মাথা তুলে হাতজোড় করে প্রণাম করলেন। ঠিক এমন সময়ে গাঁয়ের দৃশ্য পরিবর্তিত হয়। মেঠো পথ দিয়ে রাখাল বালক ফিরে যায় গরুর পাল নিয়ে। পাখিরা তাদের বাড়ি ফিরে আসে। ছোটো ছোটো পুকুর থেকে হাঁসগুলো উঠে আসে। সন্ধ্যা নেমে আসে গ্রামে। সোনালী, রিয়া, ইমরান, বিট্টুরা মাঠ থেকে ঘরে যায়। তাদের এখন বই খুলে 'অ'-এ অজগর আসছে তেড়ে বা এক এক্কে এক, দুই এক্কে দুই পড়ার সময় হয়েছে। সন্ধ্যার মৃদু বাতাসে যেন প্রাণ টা জুড়িয়ে যায় অসিতবাবুর, সারাদিনের ক্লান্তি এক নিমেষেই দূর হয়ে যায়।
সন্ধ্যা নামতেই তাদের বাড়িতে যেনো আলোয় আলোকিত হয়ে উঠলো। হঠাৎ তার ছেলে এসে আনন্দে চিৎকার করে বাবাকে তার প্রমোশনের সংবাদ দেয়। অসিতবাবুর ছেলে অমল পুলিশের এএসআই। সে এখন এসআই হয়ে শহরে পোস্টিং পেয়েছে। এক সপ্তাহের মধ্যে তাকে সেখানে জয়েন করতে হবে। অতএব অমল শহরে গিয়ে একটি ফ্ল্যাট নিয়ে সপরিবারে থাকবে বলে মনস্থির করে। চাকরিসূত্রে যেতেই হবে, আর অমল একা থাকতে চায় না, তাই মন থেকে না চাইলেও ছেলের কথা ভেবে অসিতবাবু গ্রাম ছেড়ে যেতে রাজী হলেন। চার দেওয়ালের দম বন্ধ পরিবেশ, চারিদিকে কোলাহল, শব্দদূষণ, জনসমুদ্রের কথা ভেবে মনে কালো মেঘ জমেছে ঠিকই কিন্তু তবুও তো যেতেই হবে। অবশেষে সেসব অতিক্রম করে তারা তাদের ফ্ল্যাটে পৌঁছলেন।
:দ্বিতীয় অংশ:
(ছয় বছর পরে)
অসিতবাবু দুপুরের খাবার খেয়ে চারতলার ব্যালকনিতে বসে আছেন। নিচে তাকিয়ে দেখলেন তার নাতি স্কুল থেকে ফিরে এসেছে। এসেই দাদুর কোলে ঝাঁপিয়ে পড়লো। এই কয়েক বছরে অনেক কিছু বদলে গেছে। শহরে এসে অমলের ছেলে হলো, এখন সে বড় ইংলিশ মিডিয়াম স্কুলে পড়ে। তার বউমা এখন শহুরে মেয়েদের মতই জিন্স ধরেছে। নাতির ইংলিশ মিডিয়াম স্কুলের সাথে পাল্লা দিতেই নাকি তার এই পরিবর্তন। সেই অমল এখন অনেকটাই পরিবর্তিত। এই তো সেদিন শরীরটা খারাপ লাগছিল। দূর থেকেই বললো বয়স হলে এমন হয়। মনে মনে কষ্ট হলো, এতটা দূরে চলে গেছি? হয়তো শহুরে জীবন এমনই হয়। তবে মানসিক শান্তি মেলে যখন একমাত্র নাতি এসে বুকে জড়িয়ে দাদু বলে ডাকে, যেন পুরোনো দিনের স্মৃতি ফিরে আসে, বুকে ছড়িয়ে যায় গ্রামের হিমশীতল হাওয়া। আজ তুলসীতলা দেখে মনে হয় ছোটো হতে হতে লুপ্তপ্রায়। সেখানে সন্ধ্যায় সাঁঝবাতি আর জ্বলেনা। তার বদলে ইলেকট্রিকের প্রদীপ জ্বলে সারারাত ধরে। রাখাল আর গরু নিয়ে রাস্তায় বের হয় না। পাশের ফ্ল্যাটে অ-এ অজগর এর পরিবর্তে A for Apple শোনা যায়। সেদিন পাশের ঘরের ছোটো শিশুকে অ-এ অজগর চেনাতে গিয়ে তার মায়ের কাছে শুনতে হলো 'বোকা বুড়ো'। ওসব নাকি এখানে চলেনা, ওসব এখন backdated হয়ে গেছে। আসলে অসিতবাবু এখন বাতিল হওয়া বুড়োর দলে। হয়তো এটাই, শহুরে জীবন।
একদিন সন্ধ্যায় কৃত্রিম প্রদীপ জ্বালাতে এসে তার নাতি বলছিলো, "দাদু, তুমি সকালে মা কে বলেছিলে না আজকে সন্ধ্যায় প্রদীপ জ্বালাতে। মা খুব রাগ করেছিলো। আমি জ্বালিয়ে দিচ্ছি, তুমি আমায় বলো what is সাঁঝবাতি?" অবাক হয়ে তাকিয়ে ছিলেন। হয়তো এটাই পরিবর্তন, এটাই পার্থক্য, শহর আর গ্রামের। মনে মনে ভাবলেন, অনেকটা পিছিয়ে রয়েছি, কারণ বর্তমান প্রজন্মকে সাঁঝবাতি চেনাতে পারিনি। দাদু তার নাতিকে আকাশের দিকে দেখিয়ে বললেন, সাঁঝবাতিরা এখন অনেক দূরে চলে গেছে। ওই যে মিটমিট করছে, ওটাই সাঁঝবাতি।
No comments:
Post a Comment