দোসর
রক্তিম লস্কর
*******************এক*********
আমাদের
পাড়ায় শঙ্করদার বেশ সুনাম রয়েছে। পাড়ায় কোন জমজমাটি আড্ডা শঙ্করদা ছাড়া
ভাবাই যায় না। সেই কারণে পাড়ার সকলের কাছেই শঙ্করদা বেশ জনপ্রিয়।
আমরা
থাকি কোচবিহারের হাজরাপাড়ায়। আমরা তিন বন্ধু মনোজ, জয়ন্ত ও আমি অজয়
মোটামুটি একই বয়সী। আমরা স্থানীয় এবিএন শীল কলেজে পড়াশোনা করি। আর আমাদের
ফ্রেন্ড, ফিলোজফার ও গাইড হল শঙ্করদা।
এক ছুটির সকালে আমরা অসীমের চায়ের দোকানে আড্ডায় বসেছি। হাতে চায়ের গ্লাসটা নিয়ে সবে এক চুমুক দিয়েছি, হঠাৎ পিছন থেকে শুনি শঙ্করদার গলা,
“কেমন আছিস রে তোরা?”
পিছন ফিরে দেখি শঙ্করদা দাড়িয়ে। আমি বলি, “কোথায় ছিলে এতদিন?”
“একটি অভিযানে গিয়েছিলাম।“
শুনে আমরা অবাক। মনোজ বলে, “গিয়েছিলে তো সেই দার্জিলিংয়ে। সেখানে আবার কি অভিযান করলে?”
“একটা নতুন পাহাড় আবিষ্কার করলাম। পুরো থ্রিলিং ব্যাপার, বুঝলি?”
শঙ্করদার কথা শুনে আমাদের তো প্রায় ভিমড়ি খাওয়ার যোগাড়।
জয়ন্ত বলে, “বল কি শঙ্করদা? কাঞ্চনজঙ্ঘা তো আগেই...”
জয়ন্তের কথা শেষ হয় না। তার আগেই শঙ্করদা বলে ওঠে,
“ধুর বোকার দল! দার্জিলিংয়ে কি কাঞ্চনজঙ্ঘা ছাড়া কি অন্য কোন পাহাড় নেই? এবার অভিযানে গিয়ে হিমালয়ের একটি নতুন পাহাড় খুঁজে বের করেছি।”
মনোজ আর থাকতে না পেরে বলে, “আর গুল মেরো না তো, শঙ্করদা।”
“তোদের নিয়ে হয়েছে এই একটা মুশকিল। ভালো করে ভূগোল পড়বি না, আবার জিকেও প্রায় গোল্লায়। জিবিতে যেদিন আমার নাম দেখবি সেদিন বুঝবি।”
আমি আমতা আমতা করে বলি,“জিবি মানে?”
“আরে বোকা, গিনেস বুক।”
পাড়ার বড়দের সাথে আলোচনাতেও শঙ্করদা সমান স্বচ্ছন্দ। সেদিন ক্রিকেট নিয়ে তর্ক হচ্ছিল সুকল্যাণবাবু ও গোপালবাবুর মধ্যে।
সুকল্যাণবাবু বলছিলেন, “আমার তো মনে হয় গাভাসকারই সেরা। ক্যারিবিয়ান সফরে গিয়ে হেলমেট ছাড়া যা ভাবে পেসারদের খেলে এসেছে।”
গোপালবাবু বলেন, “ধুস। বিশ্বনাথের হাতে যা সব শট ছিল তা গাভাসকারের কাছে কোনদিনই ছিল না।”
ঠিক সেই সময় পাশ দিয়ে যাচ্ছিল শঙ্করদা। ক্রিকেট নিয়ে আলোচনা শুনেই সে দাড়িয়ে পড়ে।
সুকল্যাণবাবু তাকে দেখেই বলেন, “আচ্ছা শঙ্কর, তুমিই বল। গাভাসকার ভালো না বিশ্বনাথ?”
শঙ্করদা বলে, “বিশ্বনাথ ভালো। কিন্তু সানিকাকুর কাছে কিছুই নয়।”
শুনে গোপালবাবুর চোখ প্রায় ছানাবড়া। তিনি বলেন, “তুমি কি আবার গাভাসকারকে চিনতে নাকি?”
শঙ্করদা বলে, “আরে আমি তো ওনার ছেলে রোহণের সাথেই বড় হয়েছি। আর সানিকাকু আমাকে খুব ভালোবাসতেন। এমনকি শেষের দিকে আমরা মাঠে না গেলে তিনি তো ব্যাট করতে নামতেই চাইতেন না। তাই দেখে দেশের মাঠে খেলা চললে রাজজেঠু আমাদের জন্যে আলাদা করে টিকিট পাঠাতেন।”
সুকল্যাণবাবু বলেন, “এই রাজজেঠু আবার কে?”
শঙ্করদা বলে, “রাজ সিং দুঙ্গারপুর। তখন বোর্ড প্রেসিডেন্ট ছিলেন।”
শুনে সুকল্যাণবাবু বলেন, “এই শঙ্করটা যে কোথা থেকে কোথায় চলে যায় বোঝাই যায় না।”
*******************দুই******** **********
এহেন শঙ্করদার বিয়ে ঠিক হয়েছে। স্বভাবতই আমাদের হেভি মজা। বিয়ে থেকে আরম্ভ করে বৌভাত অব্দি আমাদের নিমন্ত্রণ। এছাড়া পাড়ার অনেককেই নিমন্ত্রণ করা হয়েছে। তাই নিয়ে পাড়ায় কদিন ধরেই বেশ একটা হৈহৈ ভাব।
শঙ্করদার বিয়ে হয়েছে ফালাকাটায়। কোচবিহার থেকে ফালাকাটা বেশ কাছেই। বাসে যেতে প্রায় ঘণ্টা খানেক সময় লাগে। আর প্রাইভেট গাড়ি হলে আরও কম সময় লাগে।
বিয়ের পরদিন সন্ধ্যায় কুহেলি বউদিকে নিয়ে শঙ্করদা চলে এসেছে কোচবিহারে। একে তো শঙ্করদার বাড়ি ক’দিন ধরেই আত্মীয়স্বজনে ভর্তি। তার উপর নতুন বৌ আসায় বাড়িতে ভিড় করেছে পাড়ার বৌদি ও কাকীমারা।
বিয়ের পরদিন হল কালরাত্রি। শঙ্করদাকে নিয়ে আমরা বসেছি বাইরের ঘরে। আর নতুন বৌ গিয়ে উঠেছে ভিতরের ঘরে। সেখানে তাকে ঘিরে ধরেছে অনন্যা, মহুয়া ও শর্মিষ্ঠাসহ শঙ্করদার সব তুতো বোনেরা। রয়েছে পাড়ার কয়েকজন বৌদিও। নতুন বৌ কি কি শাড়ি ও গয়না পেয়েছে সেই দিকেই সকলের কৌতূহল।
নতুন বিয়ে হলেও কুহেলি বৌদির অত রাখঢাক নেই। সে বিয়েতে কি কি শাড়ি পেয়েছে তা সবাইকে বের করে দেখাতে শুরু করে। শাড়ি দেখানো হয়ে গেলে সে বের করে গয়নার বাক্স। আর তাই নিয়ে ঘরে চলে নানা আলোচনা।
ইতিমধ্যে শঙ্করদার তুতো বোনদের সাথে নতুন বৌদির ভালই ভাব হয়ে গেছে।
একটি নেকলেস দেখে অনন্যা বলে, “বৌদি, এই নেকলেসটার নাম কি গো?”
“আরে এটা মণিপুরি নেকলেস। মণিপুরের রাজকন্যা চিত্রাঙ্গদা তো এই নেকলেস পড়েই অর্জুনকে পটিয়েছিল।”
শুনে অনন্যার চক্ষু চড়কগাছ। সে বলে, “বল কি বৌদি?”
এরপর মহুয়া একটি ঝুমকো দেখিয়ে বলে, “এই ঝুমকোটা বেশ দারুণ দেখতে। এর নাম কি?”
“এর নাম সিঁড়িঝুমকো। মুঘল আমলে প্রাসাদে যে পেঁচানো লোহার সিঁড়ি থাকতো, তাই দেখে সম্রাট জাহাঙ্গীর বেগম নূর জাহানের জন্য এই সিঁড়িঝুমকো বানিয়েছিলেন।”
শুনে মহুয়ার চোখ ছানাবড়া। সে ভাবে বৌদি না জানি আরো কি কি গয়না নিয়ে এসেছে।
শর্মিষ্ঠা এতক্ষণ চুপ করে দেখে যাচ্ছিল। তার চোখ যায় একটি সুন্দর জালের মত গয়না দেখে। সে বলে,
“এটা কি বৌদি?”
“এর নাম রতনচূড়। রাজপুত রাজা রতন সিং তার স্ত্রী পদ্মিনীকে এই গয়না বানিয়ে দিয়েছিলেন।”
শর্মিষ্ঠা অবাক হয়ে বলে, “বল কি বউদি?”
“তাহলে আর বলছি কি? এই গয়নার জন্যই আলাউদ্দিন খিলজি মেবাড় আক্রমণ করেছিলেন।”
শুনে শর্মিষ্ঠার মাথা ঘুরে যায়। সে বলে, “কিন্তু ইতিহাস যে বলে...”
শর্মিষ্ঠার কথা পুরো শেষ হয় না। তার আগেই কুহেলি বউদি বলে, “এর জন্যে ইতিহাসটা ভালো করে জানতে হয়। সব তো আর বইয়ের পাতায় লেখা থাকে না।”
শর্মিষ্ঠা এরপর আর কিছু বলতে পারে না।
পাড়ার এক বউদি কিছুক্ষণ ধরে একটা বড় হার দেখছিলেন। তিনি বলেন, “এই হারটির কি নাম গো, নতুন বৌ?”
“এটি হল গিয়ে সীতা হার। এই হারটি পড়েই দেবী সীতা রামচন্দ্রকে বিয়ে করেছিলেন।”
পাড়ার অন্য বউদি ও কাকিমারা এতক্ষণ নতুন বৌয়ের কথা শুনছিলেন ও মিটিমিটি হাসছিলেন। সীতা হারের ব্যাখা শোনার পরে তারা বুঝে গেলেন যে শঙ্করদা নিজের উপযুক্ত এক বৌ জুটিয়ে এনেছে।
*******************তিন******** **********
বিয়ের পরে বেশ কিছুদিন শঙ্করদার কোন খোঁজখবর পাওয়া যায় না। মাঝে শুনেছিলাম শঙ্করদা নাকি কুহেলি বৌদিকে নিয়ে হানিমুনে গিয়েছে। তারপরও প্রায় মাসখানেক কেটে যায়। কিন্তু শঙ্করদার পাত্তা নেই। এদিকে শঙ্করদা ছাড়া আমাদের আড্ডাও ঠিক জমছে না।
অগত্যা একদিন আমরা তিনজন গিয়ে হাজির হই শঙ্করদার বাড়ি। কলিং বেল বাজাতেই দরজা খুলে দেয় কুহেলি বৌদি।
শঙ্করদার কথা জিজ্ঞাসা করাতে বৌদি ভিতরে এসে বসতে বলে। আমরা বাইরের ঘরের সোফায় গিয়ে বসি। শঙ্করদাকে তখনও আশেপাশে দেখা যায় না।
মনোজ বলে, “তোমরা কোথায় বেড়াতে গিয়েছিলে, বৌদি? অনেকদিন তোমাদের দেখতে পাইনি।”
“আমরা মঙ্গলগ্রহে বেড়াতে গিয়েছিলাম।“
বউদির কথা শুনে আমরা একটু থতমত খেয়ে যাই। আমি বলি, “শঙ্করদা আবার কবে থেকে মহাকাশে যাচ্ছে?”
বউদি বলে, “এই কিছুদিন হল। ইদানিং উত্তরবঙ্গে যা গরম পড়ছে, তাতে একটু ওয়েদার চেঞ্জ হল বলতে পারো।”
জয়ন্ত বলে, “তা মঙ্গলগ্রহে কখনও মানুষ গিয়েছে বলে তো শুনিনি?”
“আমরাই প্রথম ব্যাচ ছিলাম। লোকে বিয়ের পর শিমলা-মানালি, ব্যাঙ্কক-পাটায়া, গোয়া বা সুইজারল্যান্ড যায়। আমরা ভাবলাম একটু নতুন কোথাও যাই। তোমাদের দাদার আবার বেশি ভিড় ভালো লাগেনা।”
মনোজ উত্তেজিত হয়ে বলে, “তা বলে সোজা মঙ্গলগ্রহে! তা কে ব্যবস্থা করে দিল শুনি?”
“কেন টাপুদা।”
শুনে আমি আকাশ থেকে পড়ি। বলি,”এই টাপুদা আবার কে? এই নামে তো পাড়ায়…”
“আরে বাবা ডোনাল্ড ট্রাম্প। তোমাদের জিকের অবস্থা খুব খারাপ। চাকরির পরীক্ষায় যে কি করবে!”
মনোজ আমতা আমতা করে বলে, “ডোনাল্ড ট্রাম্প তোমাদের মহাকাশে পাঠাবে কেন?”
“আমাদের বিয়েতে টাপুদার আসার কথা ছিল। কিন্তু শেষ মুহূর্তে জরুরী কাজে আটকে পড়াতে আর আসতে পারেনি। তাই তো আমাদের হানিমুনে নাসার একটা প্যাকেজ পাঠিয়ে দিল।”
শুনে আমাদের চক্ষু ছানাবড়া। কাহাতক আর গুল সহ্য করা যায়। জয়ন্ত থাকতে না পেরে বলে, “তা লোকে কোথাও বেড়াতে গেলে তো সাথে করে কিছু নিয়ে আসে। তা তোমরা মঙ্গল গ্রহ থেকে কি নিয়ে এসেছো শুনি?”
“এলিয়েন।”
এতক্ষণ পরে শঙ্করদার গলার আওয়াজ পাওয়া যায়। দেখি শঙ্করদা স্নান সেরে পরিপাটি হয়ে ভিতরের ঘর থেকে বের হচ্ছে।
আমি উত্তেজিত হয়ে বলি, “কোথায় তোমার সেই এলিয়েন, শঙ্করদা?”
“তোরা বিশ্বাস করছিস না তো? এলিয়েন...কাম হিয়ার।”
শঙ্করদার ডাক শুনে ঘরের ভিতর থেকে কুই কুই করে বের হয়ে আসে একটি কুকুর ছানা। আর সেটা দেখে আমাদের নেড়ি কুকুরের বাচ্চা ছাড়া আর কিছু মনে হয় না।
এক ছুটির সকালে আমরা অসীমের চায়ের দোকানে আড্ডায় বসেছি। হাতে চায়ের গ্লাসটা নিয়ে সবে এক চুমুক দিয়েছি, হঠাৎ পিছন থেকে শুনি শঙ্করদার গলা,
“কেমন আছিস রে তোরা?”
পিছন ফিরে দেখি শঙ্করদা দাড়িয়ে। আমি বলি, “কোথায় ছিলে এতদিন?”
“একটি অভিযানে গিয়েছিলাম।“
শুনে আমরা অবাক। মনোজ বলে, “গিয়েছিলে তো সেই দার্জিলিংয়ে। সেখানে আবার কি অভিযান করলে?”
“একটা নতুন পাহাড় আবিষ্কার করলাম। পুরো থ্রিলিং ব্যাপার, বুঝলি?”
শঙ্করদার কথা শুনে আমাদের তো প্রায় ভিমড়ি খাওয়ার যোগাড়।
জয়ন্ত বলে, “বল কি শঙ্করদা? কাঞ্চনজঙ্ঘা তো আগেই...”
জয়ন্তের কথা শেষ হয় না। তার আগেই শঙ্করদা বলে ওঠে,
“ধুর বোকার দল! দার্জিলিংয়ে কি কাঞ্চনজঙ্ঘা ছাড়া কি অন্য কোন পাহাড় নেই? এবার অভিযানে গিয়ে হিমালয়ের একটি নতুন পাহাড় খুঁজে বের করেছি।”
মনোজ আর থাকতে না পেরে বলে, “আর গুল মেরো না তো, শঙ্করদা।”
“তোদের নিয়ে হয়েছে এই একটা মুশকিল। ভালো করে ভূগোল পড়বি না, আবার জিকেও প্রায় গোল্লায়। জিবিতে যেদিন আমার নাম দেখবি সেদিন বুঝবি।”
আমি আমতা আমতা করে বলি,“জিবি মানে?”
“আরে বোকা, গিনেস বুক।”
পাড়ার বড়দের সাথে আলোচনাতেও শঙ্করদা সমান স্বচ্ছন্দ। সেদিন ক্রিকেট নিয়ে তর্ক হচ্ছিল সুকল্যাণবাবু ও গোপালবাবুর মধ্যে।
সুকল্যাণবাবু বলছিলেন, “আমার তো মনে হয় গাভাসকারই সেরা। ক্যারিবিয়ান সফরে গিয়ে হেলমেট ছাড়া যা ভাবে পেসারদের খেলে এসেছে।”
গোপালবাবু বলেন, “ধুস। বিশ্বনাথের হাতে যা সব শট ছিল তা গাভাসকারের কাছে কোনদিনই ছিল না।”
ঠিক সেই সময় পাশ দিয়ে যাচ্ছিল শঙ্করদা। ক্রিকেট নিয়ে আলোচনা শুনেই সে দাড়িয়ে পড়ে।
সুকল্যাণবাবু তাকে দেখেই বলেন, “আচ্ছা শঙ্কর, তুমিই বল। গাভাসকার ভালো না বিশ্বনাথ?”
শঙ্করদা বলে, “বিশ্বনাথ ভালো। কিন্তু সানিকাকুর কাছে কিছুই নয়।”
শুনে গোপালবাবুর চোখ প্রায় ছানাবড়া। তিনি বলেন, “তুমি কি আবার গাভাসকারকে চিনতে নাকি?”
শঙ্করদা বলে, “আরে আমি তো ওনার ছেলে রোহণের সাথেই বড় হয়েছি। আর সানিকাকু আমাকে খুব ভালোবাসতেন। এমনকি শেষের দিকে আমরা মাঠে না গেলে তিনি তো ব্যাট করতে নামতেই চাইতেন না। তাই দেখে দেশের মাঠে খেলা চললে রাজজেঠু আমাদের জন্যে আলাদা করে টিকিট পাঠাতেন।”
সুকল্যাণবাবু বলেন, “এই রাজজেঠু আবার কে?”
শঙ্করদা বলে, “রাজ সিং দুঙ্গারপুর। তখন বোর্ড প্রেসিডেন্ট ছিলেন।”
শুনে সুকল্যাণবাবু বলেন, “এই শঙ্করটা যে কোথা থেকে কোথায় চলে যায় বোঝাই যায় না।”
*******************দুই********
এহেন শঙ্করদার বিয়ে ঠিক হয়েছে। স্বভাবতই আমাদের হেভি মজা। বিয়ে থেকে আরম্ভ করে বৌভাত অব্দি আমাদের নিমন্ত্রণ। এছাড়া পাড়ার অনেককেই নিমন্ত্রণ করা হয়েছে। তাই নিয়ে পাড়ায় কদিন ধরেই বেশ একটা হৈহৈ ভাব।
শঙ্করদার বিয়ে হয়েছে ফালাকাটায়। কোচবিহার থেকে ফালাকাটা বেশ কাছেই। বাসে যেতে প্রায় ঘণ্টা খানেক সময় লাগে। আর প্রাইভেট গাড়ি হলে আরও কম সময় লাগে।
বিয়ের পরদিন সন্ধ্যায় কুহেলি বউদিকে নিয়ে শঙ্করদা চলে এসেছে কোচবিহারে। একে তো শঙ্করদার বাড়ি ক’দিন ধরেই আত্মীয়স্বজনে ভর্তি। তার উপর নতুন বৌ আসায় বাড়িতে ভিড় করেছে পাড়ার বৌদি ও কাকীমারা।
বিয়ের পরদিন হল কালরাত্রি। শঙ্করদাকে নিয়ে আমরা বসেছি বাইরের ঘরে। আর নতুন বৌ গিয়ে উঠেছে ভিতরের ঘরে। সেখানে তাকে ঘিরে ধরেছে অনন্যা, মহুয়া ও শর্মিষ্ঠাসহ শঙ্করদার সব তুতো বোনেরা। রয়েছে পাড়ার কয়েকজন বৌদিও। নতুন বৌ কি কি শাড়ি ও গয়না পেয়েছে সেই দিকেই সকলের কৌতূহল।
নতুন বিয়ে হলেও কুহেলি বৌদির অত রাখঢাক নেই। সে বিয়েতে কি কি শাড়ি পেয়েছে তা সবাইকে বের করে দেখাতে শুরু করে। শাড়ি দেখানো হয়ে গেলে সে বের করে গয়নার বাক্স। আর তাই নিয়ে ঘরে চলে নানা আলোচনা।
ইতিমধ্যে শঙ্করদার তুতো বোনদের সাথে নতুন বৌদির ভালই ভাব হয়ে গেছে।
একটি নেকলেস দেখে অনন্যা বলে, “বৌদি, এই নেকলেসটার নাম কি গো?”
“আরে এটা মণিপুরি নেকলেস। মণিপুরের রাজকন্যা চিত্রাঙ্গদা তো এই নেকলেস পড়েই অর্জুনকে পটিয়েছিল।”
শুনে অনন্যার চক্ষু চড়কগাছ। সে বলে, “বল কি বৌদি?”
এরপর মহুয়া একটি ঝুমকো দেখিয়ে বলে, “এই ঝুমকোটা বেশ দারুণ দেখতে। এর নাম কি?”
“এর নাম সিঁড়িঝুমকো। মুঘল আমলে প্রাসাদে যে পেঁচানো লোহার সিঁড়ি থাকতো, তাই দেখে সম্রাট জাহাঙ্গীর বেগম নূর জাহানের জন্য এই সিঁড়িঝুমকো বানিয়েছিলেন।”
শুনে মহুয়ার চোখ ছানাবড়া। সে ভাবে বৌদি না জানি আরো কি কি গয়না নিয়ে এসেছে।
শর্মিষ্ঠা এতক্ষণ চুপ করে দেখে যাচ্ছিল। তার চোখ যায় একটি সুন্দর জালের মত গয়না দেখে। সে বলে,
“এটা কি বৌদি?”
“এর নাম রতনচূড়। রাজপুত রাজা রতন সিং তার স্ত্রী পদ্মিনীকে এই গয়না বানিয়ে দিয়েছিলেন।”
শর্মিষ্ঠা অবাক হয়ে বলে, “বল কি বউদি?”
“তাহলে আর বলছি কি? এই গয়নার জন্যই আলাউদ্দিন খিলজি মেবাড় আক্রমণ করেছিলেন।”
শুনে শর্মিষ্ঠার মাথা ঘুরে যায়। সে বলে, “কিন্তু ইতিহাস যে বলে...”
শর্মিষ্ঠার কথা পুরো শেষ হয় না। তার আগেই কুহেলি বউদি বলে, “এর জন্যে ইতিহাসটা ভালো করে জানতে হয়। সব তো আর বইয়ের পাতায় লেখা থাকে না।”
শর্মিষ্ঠা এরপর আর কিছু বলতে পারে না।
পাড়ার এক বউদি কিছুক্ষণ ধরে একটা বড় হার দেখছিলেন। তিনি বলেন, “এই হারটির কি নাম গো, নতুন বৌ?”
“এটি হল গিয়ে সীতা হার। এই হারটি পড়েই দেবী সীতা রামচন্দ্রকে বিয়ে করেছিলেন।”
পাড়ার অন্য বউদি ও কাকিমারা এতক্ষণ নতুন বৌয়ের কথা শুনছিলেন ও মিটিমিটি হাসছিলেন। সীতা হারের ব্যাখা শোনার পরে তারা বুঝে গেলেন যে শঙ্করদা নিজের উপযুক্ত এক বৌ জুটিয়ে এনেছে।
*******************তিন********
বিয়ের পরে বেশ কিছুদিন শঙ্করদার কোন খোঁজখবর পাওয়া যায় না। মাঝে শুনেছিলাম শঙ্করদা নাকি কুহেলি বৌদিকে নিয়ে হানিমুনে গিয়েছে। তারপরও প্রায় মাসখানেক কেটে যায়। কিন্তু শঙ্করদার পাত্তা নেই। এদিকে শঙ্করদা ছাড়া আমাদের আড্ডাও ঠিক জমছে না।
অগত্যা একদিন আমরা তিনজন গিয়ে হাজির হই শঙ্করদার বাড়ি। কলিং বেল বাজাতেই দরজা খুলে দেয় কুহেলি বৌদি।
শঙ্করদার কথা জিজ্ঞাসা করাতে বৌদি ভিতরে এসে বসতে বলে। আমরা বাইরের ঘরের সোফায় গিয়ে বসি। শঙ্করদাকে তখনও আশেপাশে দেখা যায় না।
মনোজ বলে, “তোমরা কোথায় বেড়াতে গিয়েছিলে, বৌদি? অনেকদিন তোমাদের দেখতে পাইনি।”
“আমরা মঙ্গলগ্রহে বেড়াতে গিয়েছিলাম।“
বউদির কথা শুনে আমরা একটু থতমত খেয়ে যাই। আমি বলি, “শঙ্করদা আবার কবে থেকে মহাকাশে যাচ্ছে?”
বউদি বলে, “এই কিছুদিন হল। ইদানিং উত্তরবঙ্গে যা গরম পড়ছে, তাতে একটু ওয়েদার চেঞ্জ হল বলতে পারো।”
জয়ন্ত বলে, “তা মঙ্গলগ্রহে কখনও মানুষ গিয়েছে বলে তো শুনিনি?”
“আমরাই প্রথম ব্যাচ ছিলাম। লোকে বিয়ের পর শিমলা-মানালি, ব্যাঙ্কক-পাটায়া, গোয়া বা সুইজারল্যান্ড যায়। আমরা ভাবলাম একটু নতুন কোথাও যাই। তোমাদের দাদার আবার বেশি ভিড় ভালো লাগেনা।”
মনোজ উত্তেজিত হয়ে বলে, “তা বলে সোজা মঙ্গলগ্রহে! তা কে ব্যবস্থা করে দিল শুনি?”
“কেন টাপুদা।”
শুনে আমি আকাশ থেকে পড়ি। বলি,”এই টাপুদা আবার কে? এই নামে তো পাড়ায়…”
“আরে বাবা ডোনাল্ড ট্রাম্প। তোমাদের জিকের অবস্থা খুব খারাপ। চাকরির পরীক্ষায় যে কি করবে!”
মনোজ আমতা আমতা করে বলে, “ডোনাল্ড ট্রাম্প তোমাদের মহাকাশে পাঠাবে কেন?”
“আমাদের বিয়েতে টাপুদার আসার কথা ছিল। কিন্তু শেষ মুহূর্তে জরুরী কাজে আটকে পড়াতে আর আসতে পারেনি। তাই তো আমাদের হানিমুনে নাসার একটা প্যাকেজ পাঠিয়ে দিল।”
শুনে আমাদের চক্ষু ছানাবড়া। কাহাতক আর গুল সহ্য করা যায়। জয়ন্ত থাকতে না পেরে বলে, “তা লোকে কোথাও বেড়াতে গেলে তো সাথে করে কিছু নিয়ে আসে। তা তোমরা মঙ্গল গ্রহ থেকে কি নিয়ে এসেছো শুনি?”
“এলিয়েন।”
এতক্ষণ পরে শঙ্করদার গলার আওয়াজ পাওয়া যায়। দেখি শঙ্করদা স্নান সেরে পরিপাটি হয়ে ভিতরের ঘর থেকে বের হচ্ছে।
আমি উত্তেজিত হয়ে বলি, “কোথায় তোমার সেই এলিয়েন, শঙ্করদা?”
“তোরা বিশ্বাস করছিস না তো? এলিয়েন...কাম হিয়ার।”
শঙ্করদার ডাক শুনে ঘরের ভিতর থেকে কুই কুই করে বের হয়ে আসে একটি কুকুর ছানা। আর সেটা দেখে আমাদের নেড়ি কুকুরের বাচ্চা ছাড়া আর কিছু মনে হয় না।
No comments:
Post a Comment