নব সাজে দুর্গার মর্ত্য ধাম যাত্রা
স্বপন দত্ত
"বাজলো তোমার আলোর বেণু"
----------আশ্বিনের শারদ প্রাতে নীল মেঘের সামিয়ানার
নীচে কাশফুলের দো লানি আর শ্বেত শুভ্র শিউলীর সুগন্ধে আকাশেবাতাসে আগমনীর সুর কিঞ্চিৎ হলেও শ্রুতিগোচর হচ্ছে মর্ত্য ধামে। কিন্তু কৈলাশে এখনো এর বিন্দুমাত্র পৌঁছায়নি রেশ। না,না,এখানে এখনো পৌঁছোয় নি করোনা ভাইরাস। অতএব কৈলাশে নো লক ডাউন, নো কন টেন মেন্ট জোন। কিন্ত এখানে বেঁধেছে মহাগোলমাল। দেবাদিদেব মহেশ্বর তো বরাবরই মর্ত্য ধামে শশুর বাড়ির ব্যাপারে অখুশী। এর উপর গোদের উপর বিষ ফোঁড়া করোনা আতঙ্ক।তাই কোনোমতেই পুত্র কন্যা সমেত দুর্গতিনাশিনী দেবীর পিতৃগৃহে সফর নৈব নৈব চ ।
দেবী দুর্গা নিজেও ঘোর সংকটে। বছরে একবারই চারদিনের জন্য ঘুরতে যাওয়ার
পারমিট। কিন্তু করোনা সংকটে একেবারে পুরোপুরি জেরবার মর্ত্য ধাম।এবারের যুদ্ধ তাই
শুধু মাত্র বৃদ্ধ মহিষাসুরের সঙ্গে না,এর সাথে রয়েছে পরাক্রান্ত করোনা সুর। কোন মুখে স্বামীকে বলবেন যাবার কথা।
পুত্র কন্যারা বহুদিন যাবৎ প্রকাশ করছেন মামার বাড়িতে যাবার ব্যাপারে ঘোরতর
অনীহা। আগের মতো আর নেই যত্ন বা সমাদর সবাই ব্যস্ত থিম না থাম নিয়ে।কোনরকমে দায়
সারা ভাবে তাদের আপ্যায়ন করে সব বাজেট শুধু নাচা গানা আর আলোর রোশনাই এর জন্য।এর উপরএবার করোনা আবহে পড়াশুনালাটে। বন্ধ স্কুল,কলেজ, বিশ্ববিদ্যালয়।ছাত্রছাত্রীগণ ভুলে গেছে তাদের বিদ্যালয় যাবার রাস্তা। অফ লাইনে পড়াশুনা বন্ধ,তাই লেখাপড়া চলছেঅনলাইনে।আরে হতদরিদ্র পরিবারে স্মার্ট ফোন তো বিলাসিতা মাত্র।তাই পড়াশুনা তাদের জন্যসেই তিমিরে।কিন্তু তাতে নেই কোনো চিন্তা।সবাই
পাস। মানে গোপলাও পাস, নেপলাও পাস।এমন অবস্থা চললে সরো কে কে পুঁছবে? অতএব সেজে গুজে প্যান্ডেলে বসে থাকলেও থাকবেনাতার কোনো ক্রেজ। লক্ষ্মীর অবস্থাতো আরোশোচনীয়। নোটবন্দী আর জি,এস,টির জোড়া আক্রমণে পাবলিক তো এক্কেবারে চিত্তির।অর্থনীতি একেবারে তলানিতে । এর উপর করোনা করোনা করে লক ডাউনের খুড়োর কলের ধাক্কায় রোজগার পত্র উঠেছে লাটে।লক ডাউন করে কিন্তু হচ্ছেনা করোনা সুরাহা।শুধু বাড়ছে মানুষের হয়রানি।পুলিশের নির্দেশে কানধরে উঠবস আর বুকডন দেবার শারীরিক কসরৎ।লকডাউন
আর আন লকের ভুলভুলাইয়া থেকে মুক্তি পেতে এখন প্রয়োজন নতুন ক্যালেন্ডারের।
পেটে ভাতে বাঁচতে তাই ভরসা গোডাউনে বহু পুরনো মজুত থাকা আতপ চালের ক্ষুদ।
এই অবস্থায় লক্ষ্মী ঝাঁপি নিয়ে বসলেও পাবেনকি তার কোনো ইজ্জত? তাই সেও
মর্ত্যে যেতে গররাজি, গণেশ বাবাজীর অবস্থা তো এক্কেবারে কেরাসিন। দোকানপাট,ব্যবসা সব বন্ধ।অবস্থা এমন দাঁড়িয়েছে যে তার বাহন ইদুরেরও না খেতে পেয়ে মরবার দশা।পাবলিক খেপে একেবারে খেপ চুড়িয়াস। অতএব গণপতি বাপ্পা
নিজেও
বাতিলের দলে । কেতো অর্থাৎ কার্তিকের সুন্দরী রমণীদের সম্পর্কে আছে একটু
দুর্বলতা। তাই এতদিনেও গেলনা ছুক ছুক করা।আজও তার পছন্দমতো পাত্রী না
মেলায় হয় নি দ্বারপরিগ্রহ করা।তবে সে যাকগে।পুজোর
চারদিন যে একটু মাঞ্জা দিয়ে সাজগোজ করে বডি শো করবে সে গুড়েও বালি। কারণ
ফেসিয়াল করা মেক্ আপ মুখে ধ্যাবড়া মাস্ক লাগিয়ে ক্যাবলার মতো দাঁড়িয়ে থাকলে কে আর তাকাবে ওদিকে? মহিষাসুর নিজেও মর্ত্যে যেতে একদম নারাজ। এ আবার কোন বিপদ? এই বয়সে করোনা সুরের সঙ্গে যুদ্ধ করতে গিয়ে কি ভর্তি হতে হবে কোভিদ হাসপাতালে। বিনা ওষুধে,বিনা চিকিৎসায়,জেলখানার মতো ছ্যার ছ্যারে খানা খেয়ে বেওয়ারিশ লাশ হোয়ে মরার চেয়ে মা দুগ্গা নিজ হাতে বধকরলে টা হবে বীরের মৃ ত্যু বরণ করা।
অতএব একমাত্র মা দুর্গা ছাড়া সবাই মর্ত্য ধামে যাওয়ার ব্যাপারে বাতিলের দলে।তিনি হয়ে পরলেন একঘরে। একবার মর্ত্যে না গেলে যদি আবার বাপ মা ভাইরা তাকে ভুলে যায় তখন কি হবে।"শ্যাম রাখি না কূল রাখি অবস্থা"- আর কি? ডাকা হলো,ম্যানেজমেন্ট বিশারদ নারদ মুনি কে।তিনি পুত্র কন্যাদের এক এক জনকে এক এক রকম ডোজ কানে কানে দিয়ে করলেন ফিটিং।তবে দেব বৈদ্য তথা স্বাস্থ্যবিশারদদের পরামর্শ নেওয়ার জন্য পাঠাতে বললেন জরুরী কলবুক।
এবার এসে হাজির হলেন অশ্বিনীকুমার ভাতৃদ্বয়। দেব বৈদ্য বলে কথা।বসলো দেবরাজ ইন্দ্রের সভাপতিত্বে দেবসভা।অনেক চিন্তাভাবনা ,উত্তপ্ত বাক্য বিনিময়,আলোচনার পর সিদ্ধান্ত হোল এই যে মা দুর্গার মর্ত্য ধাম সফর সূচী হবে শর্ত সাপেক্ষে। কারণ মায়ের পিত্রালয়ে যাওয়ার যে ট্র্যাডিশন সমানে চলেছে তাতে বিঘ্ন ঘটলে সমূহ বিপদ। ওই চারদিনের হইহুল্লোড়,আনন্দের ফুলঝুড়ি আবার একটা বছরের জন্য যোগায় অনন্ত খোরাক। এর অন্যথা ঘটলে বাঙলার ললনারা বুকফাটা আর্তনাদ করে ত্যাগ করবেন - আসন, বসন, ব্যসন। অনেকে পিছপা হবেনা আত্মাহুতি দিতে। হয় তো হবেনা,করোনা পরিস্থিতির মধ্যে সেভাবে মেকআপ নেওয়া, বাহারের শাড়ি, চুড়িদার, শর্ট বা লং ফ্রক, পালাজোর কেরামতি দেখানো, চপ
কাটলেট,এগ রোল, মাটন রোল, চাউ চাউ,বা বিরিয়ানিতে হবেনা করোনা ভাইরাসের কারণে ডুবে থাকা,তবুও চাই দুর্গাপূজা। প্রয়োজনে মুখে মাস্ক লাগিয়ে ফিয়াসের সঙ্গে যেতে হবে পুজো পরিক্রমায়।তবে সে মাস্কগুলো হতে হবে - বেনারসী,কাঁথা স্টিচ,জারদৌশি, পিওর সিল্ নিদেনপক্ষে রংবেরঙের তাঁতের কাপড় দিয়ে। পুজো না হলে সব ম্যাসাকার। দেব বৈদ্য গণ সতর্ক করে দিয়ে আরো সুপারিশ করলেন যে
ওই চারদিন খাওয়াদাওয়ার ব্যাপারে মানতে হবেকঠোর
নিয়মকানুন।কোনোমতেই খাওয়া যাবেনা কাটা ফল বা বিচি কলা সহযোগে আতপ চাল
করা যাবেনা ভক্ষণ। বলির মাংস তো কখনোই না। বরং খেতে হবে - তুলসী পাতা, নিম পাতা,লবঙ্গ,আর্সেনিক অ্যালবাম ইত্যাদি ইত্যাদি।আর এখান থেকে রওনা হবার সময়
নিতে হবে পিপা ভর্তি স্যানিটাইজার। পরিধাণ করতে হবে - পি,পি,ই, মাস্ক,মাথায় টুপি আর হাতে গ্লাভস। বারবার করতে হবে হস্ত প্রক্ষালন। অঞ্জলি হবে বিনা পুষ্পে । কারণ সর্বত্রই করোনা ভাইরাস। জনতা থেকে সবাইকে থাকতে হবে কমপক্ষে ছয় ফুট দূরত্বে। সোশাল ডিসটেন্স মানতেই হবে। কাউকে খক খক করতে দেখলেই ঘুরিয়ে নিতে হবে অন্যদিকে মুখ। শর্তাবলী মেনে চললে আপত্তি নেই মর্ত্য ধাম গমনে।
তবে আর কি? এবার মিলেছে পিত্রালয়ে গমনের অনুমতি। বেজে উঠলো শঙ্খ,বেজে উঠলো কাঁস র ঘণ্টা, বেজে উঠলো রণ দুন্দুভি । পুত্র কন্যাদের নিয়ে বিপদ নাশিনী দুর্গা শুরু করলেন এক অভিনব
মর্ত্য ধাম যাত্রা।
No comments:
Post a Comment