বাঁচতে দিন
বিজন মজুমদার
লকডাউনের
আগের কথা ।ভোরের ডাউন রানাঘাট লোকাল ধরে রোজ এক সবজিওয়ালী মাসিমা চাকদহ
থেকে ইছাপুরে আসতেন আনন্দমঠ বাজারে সবজি বিক্রি করতে ।এই ভাবেই রুটিন মেপে
দিনযাপন চলছিল তার ।সবজি বিক্রি হয়ে যাবার পর বেলা বারোটা নাগাদ তিনি আপ
শান্তিপুর লোকাল ধরে বাড়ি ফিরতেন ।রোদ ঝড় জল বৃষ্টি যাই হোক না কেন, তার এই
প্রাত্যহিক জীবনের ছন্দে কোনদিন ব্যাঘাত ঘটেনি ।
হ্যাঁ, তার জীবনের ছন্দ কেটে গেল সেদিন, যেদিন থেকে সারা দেশে
আকস্মিক ভাবে লকডাউন ঘোষণা হয়ে গেল, সমস্ত ট্রেন চলাচল বন্ধ হয়ে গেল ।লক্ষ
লক্ষ মানুষের জীবন ও জীবিকা বিপন্ন হয়ে পড়ল !ট্রেনই হল সাধারণ মানুষের
একমাত্র সহজলভ্য যানবাহন, যা বন্ধ করে দেওয়া মানে জীবনের লাইফ লাইন বন্ধ
করে দেওয়া ।মানুষ ভেবে ছিল লকডাউন আর কতদিন থাকবে, সবকিছু আবার স্বাভাবিক
হয়ে যাবে ।কিন্তু মানুষের অপেক্ষার আর শেষ হল না ।করোনার গতি যত দ্রুত
বেড়েছে, লকডাউনের সময়সীমা তার সাথে পাল্লা দিয়ে বেড়েছে! ট্রেন চলাচল আজও
শুরু হল না ।
লকডাউন ঘোষিত হবার পর দেশজুড়ে চলতে থাকল চরম অব্যবস্থা! পরিযায়ী
শ্রমিকেরা আর কতদিন সহায় সম্বলহীন ভাবে পড়ে থাকবেন ভিন রাজ্যে? পেটের
তাড়নায় তারাও পায়ে হেটে বাড়ির উদ্দেশ্যে যাত্রা শুরু করল রেললাইন অনুসরণ
করে ।এতো তিন চার কিলোমিটার পথের ব্যাপার নয়, হাজার হাজার মাইল পথের
ব্যাপার ।শ্রমিকদের বিশ্বাস, রেললাইন ধরে এগোলে একদিন ঠিক বাড়ির দরজায়
পৌছানো যাবে !কিন্তু এত মাইল পথ চলা কি চাট্টিখানি কথা? পথে যেতে যেতে পায়ে
ফোসকা পড়ে গেল, ক্ষুধার জ্বালায় অবসন্ন দেহ রেললাইনের ধারে লুটিয়ে পড়ল,
কেউ কেউ পড়ল ঘুমিয়ে ।তাদের বিশ্বাস ছিল, এখন তো লকডাউন চলছে, নিশ্চয় কোন
ট্রেন চলবে না, সুতরাং রেললাইনের জমিতে একটু বিশ্রাম নেওয়া যেতেই পারে
।কিন্তু কে জানত, সেই রাতই তাদের জীবনের শেষ রাত? কোথা থেকে বিনা নোটিশে
একটি মালবাহী ট্রেন চলে এল, ক্লান্ত শ্রমিকের দেহ ছিন্নভিন্ন হয়ে পড়ে রইলো
রেললাইনে, আর পুঁটলিতে থাকা রুটি তরকারির সাথে মিশে গেল চাপচাপ রক্ত!
না, লকডাউনের পর সবজিওয়ালীকে আর দেখা গেল না আনন্দমঠ বাজারে ।সময়ের
সাথে সাথে স্মৃতিও ধূসর হতে লাগলো, মন থেকে মুছে গেল মাসিমার ছবি ।লকডাউন
ধাপে ধাপে বেড়ে আট নয়মাস হতে চলল ।মাঝে মাঝে দেখি, রেললাইনে দুই একটি ট্রেন
চলাচল করছে ।প্রায় ফাঁকা ট্রেনই বলা যায় ।প্রতি কামরায় চার পাঁচজন করে
যাত্রী! ওই ভাগ্যবান যাত্রীরা হলেন রেলকর্মী! সাধারণ মানুষের সেখানে প্রবেশ
নিষেধ ।
একদিন বাজারে গিয়ে ভূত দেখার মতো অবস্থা হল ।নিজের চোখকে বিশ্বাস
করতে পারছিলাম না ।দেখি, মাসিমা দোকান খুলে সবজি সাজিয়ে বসে আছেন! সবজি
বলতে সামান্য কটা বুনো কচু, বুনো লতি, বুনো শাক আর কয়েকটি লেবু ।আমি চোখে
ভুল দেখছি নাতো? চোখদুটি ভালো করে রগরে নিয়ে তাকিয়ে দেখি, হ্যাঁ, এই তো সেই
সবজিওয়ালা মাসিমাই!তবে চেহারা যেন অনেকটা ভেঙে পড়েb!আমি অবাক হয়ে প্রশ্ন
করলাম, আরে মাসিমা, আপনি কেমন করে এলেন? ট্রেন তো এখনও চালু হয়নি! উনি
বললেন, কি আর করব বাবা! একদিন ট্রেনের গার্ডকে আমার দুরবস্থার কথা বললাম
।উনি শুনে বললেন, এমনিতে তো সাধারণ যাত্রীদের ওঠার নিয়ম নেই, তবে আপনাকে
বারণ করব না ।তাইতো আসতে পারলাম ইছাপুরে ।
মাসিমা যে সবজি নিয়ে বসেছেন, তার একটিও তিনি কিনে আনেননি । মাসিমা
বললেন, দেখো বাবা, এইতো কটা মাত্র সবজি এনেছি ।এগুলো আমার বাড়ির
আনাচেকানাচে হয়ে ছিল, সেগুলোই তুলে নিয়ে এলাম ।বাজার থেকে সবজি কিনে এনে
বিক্রি করব, সেই পয়সা এখন আর নেই ।লকডাউন তো সব শেষ করে দিয়েছে ।বলতে বলতে
মাসিমা একটু চুপ করে গেলেন ।ভাবা যায়, এই সামান্য কয়টা সবজি বিক্রি করতে
উনি সেই চাকদহ থেকে ইছাপুরে এসেছেন! অবস্থা কোথায় গিয়ে নেমেছে তাহলে!
তারপর কেটে গেছে তিন থেকে চারটি দিন ।একটি বিশেষ কাজে ইছাপুর
প্লাটফর্মের উপর দিয়ে যাচ্ছি ।তখন বেলা প্রায় সাড়ে বারোটা হবে ।প্লাটফর্মের
বসার জায়গায় চোখ যেতেই দেখি, বসার জায়গায় টান টান হয়ে শুয়ে আছেন মাসিমা
।মাসিমা বলে ডাকতেই চোখ মেলে তাকালেন, কিন্তু উঠে বসলেন না ।আমি তাকে
বললাম, এখনও আপনি বাড়ি যাননি? মাসিমা বললেন, কি করব বাবা, ট্রেন তো সেই
বেলা তিনটেয় ।এতক্ষণ আমাকে এখানে বসে থাকতে হবে ।কতক্ষণ আর বসে থাকা যায়,
বলো! নির্জন স্টেশনে তাই একটু ঘুমিয়েই পড়লাম ,শরীর আর দিচ্ছে না বাবু!আজ
যদি ঠিকঠাক ট্রেন চলত, তাহলে কি আমার এই অবস্থা হত? কে বুঝবে আমাদের কথা?
একেবারে ধনে প্রাণে শেষ হয়ে গেলাম!
আমি ভাবছি অন্য কথা ।সেই কোন সকালে চাকদা থেকে ইছাপুরে এসেছেন সবজি
বিক্রি করতে । বাড়ি ফিরতে ফিরতে হয়তো চারটে বেজে যাবে ।এই সময়ের মধ্যে
ওনার কিছু খাওয়া দাওয়া হয়েছে কিনা কে জানে! স্টেশনের সব দোকানপাট সেই
লকডাউনের পর থেকে তো বন্ধ রয়েছে ।খাবার পাওয়ার কোন সম্ভাবনাই নেই!
তবু তাকে বললাম, এত বেলা হল, কিছু খেয়েছেন মাসিমা? উনি বললেন, কি
আর খাব, ওই চায়ের সাথে দুটি বিস্কুট খেয়ে এখনও পর্যন্ত টিকে আছি ।জানিনা,
এভাবে আর কতদিন চলবে! সত্যি বলছি, আর কিছুদিন যদি এইভাবেprg ট্রেন
স্বাভাবিক না হয়, ঠিক মরে যাব!
খুব খারাপ লাগল ওনার কথা শুনে ।নিজেকে খুব লজ্জিত মনে হল ।সত্যি
কথা বলতে কি, যারা দিন এনে দিন খাওয়া মানুষ, তাদের জীবন লকডাউনে একেবারে
শেষ হয়ে গেছে!
অভিশপ্ত করোনা, অভিশপ্ত লকডাউন মানুষের জীবন একেবারে ব্রেক ডাউন করে
দিয়েছে ।এখনও যদি ট্রেন না চালু হয়, এই ধুক ধুক করা প্রাণ গুলোর যে কি
পরিণতি হবে, কে জানে!
উপরতলার মনুষ্য করোনাকে ভয় পাচ্ছে, কিন্তু নিচুতলার মানুষ করোনার
রক্ত চক্ষু উপেক্ষা করে বলছে, আমাদের বাঁচতে দিন, ট্রেন চলতে দিন, নইলে
করোনা নয়, আমরা না খেতে পেয়েই চলে যাবো ।
No comments:
Post a Comment