পুতুলের সংসার
বিজন মজুমদার
কল্যাণীতে
স্ত্রী পুত্রকে ডাক্তার দেখিয়ে কল্যাণী রোড ধরে ইছাপুরের বাড়িতে ফিরছি ।
দীর্ঘ ছয়মাস ধরে করোনা সংক্রমণ ও লকডাউনের জেরে ট্রেন চলাচল বন্ধ, তাই ভাড়া
গাড়িই অগতির গতি । অনেকদিন ঘর বন্দি হয়ে থাকার পর এটাই প্রথম বাইরে পা
ফেলা । তাই গাড়িতে ফিরতে ফিরতে কল্যাণী রোডের দুই ধারের প্রাকৃতিক দৃশ্য
উপভোগ করছিলাম । আমাদের গাড়ি যখন মাঝপথে, এক নতুন দৃশ্য আমাদের দৃষ্টি
আকর্ষণ করল । দেখলাম, রাস্তার দুই ধার দিয়ে বসে গেছে লম্বা পুতুলের মেলা ।
পুতুল গুলো বেশ সুন্দর, বেশ মেম মেম গড়ন । এই অসময়ে কিসের মেলা? আরও
আশ্চর্য, এই মেলায় পুতুল ছাড়া অন্য কিছু নেই । তাছাড়া, ক্রেতাদের ভিড়ও তেমন
নেই । পুতুলের পসরা সাজিয়ে কেবল দোকনদাররা বসে আছে, দোকানের সামনে হাতে
গোনা ক্রেতা । একটু অবাকই হলাম! পুতুল গুলো কিন্তু সত্যিই মনোহরনকারী ।
এতদিন বড় বড় মেলায় এত পুতুল দেখেছি, কিন্তু কেনার বা গভীর মনোযোগ দিয়ে
দেখার ইচ্ছে জাগে নি । আজ জাগল । চলন্ত গাড়ির জানালা দিয়ে দেখেই পুতুল গুলো
এত ভালো লাগছে, কাছে গেলে না জানি কত ভালই না লাগবে! আমাদের গাড়ির
ড্রাইভার আমাদের পাশের বাড়িতে থাকে। তাকে বললাম, ভাই, গাড়িটা একটু সাইড করে
দাঁড় করাও তো । ওই যে পুতুল গুলো দেখছ, ওখানে যাবো ।
চালক ভাইটি হাসিমুখে গাড়ি দাঁড় করালো । আমরা সকলে পুতুলের কাছে
গেলাম । দেখলাম, পুতুল গুলো বেশ সুন্দর করে সাজিয়ে রাখা হয়েছে । দোকানের
সামনে রয়েছেন এক বয়ষ্ক মহিলা ।
কাছে যেতেই হাসিমুখে মাসিমা বললেন, পুতুল নেবেন? আমি বললাম, তা নেব ।
কিন্তু আপনি আমার চেয়ে বয়সে অনেক বড় । আমাকে আপনি বলে সম্বোধন করবেন না ।
আগে বলুনতো, এখানে কিসের মেলা শুরু হয়েছে? এখন তো ক্যালেন্ডারে মেলার কোন
সূচীপত্র নেই!
মাসিমা বললেন, বাবা তুমি ঠিকই বলেছ । এখন মেলার সময় নয় । কিন্তু
যেদিন থেকে কড়াকড়ি লকডাউন একটু একটু করে শিথিল হয়েছে, সেদিন থেকেই কল্যাণী
রোডের দুই ধারে অলিখিত মেলা বসে গেছে, শুধুই পুতুলের মেলা । কী করব বাবা,
লকডাউনে বাড়ির কর্তা ও ছেলেদের তো সব কাজ চলে গেছে । সংসার তো চালাতে হবে ,
বসে থাকলে চলে না । তাই এই পুতুলের সংসার সাজিয়ে বসা ।
আমি বলি, এখান থেকে কি পুতুল বিক্রি হয়? ক্রেতা তো খুব কম। তা কেমন বিক্রি এখানে ?
মাসিমা বললেন,খুব খারাপ হয়না । তবে দামও বেশী পাইনা । দেখেছেন তো,
যতদূর চোখ যায় , পুতুল আর পুতুল! চাহিদার চেয়ে উত্পাদন বেশি । তা বাবা ,
তোমরা পুতুল কিনবে তো?
কিনব বইকি! তার আগে আপনার সাথে একটু কথা বলে নি। তা আপনার কয় ছেলে মেয়ে? স্বামী কী করেন ?
কী আর বলব বাবা! আমার স্বামী একটি বেসরকারি কারখানায় কাজ করতেন ।
কিন্তু লকডাউন চলায় কারখানা বন্ধ, তাই বেতনও বন্ধ । ওদিকে আমার দুই ছেলে
মুম্বইতে সোনার দোকানে কাজ করত । তারাও কাজ হারিয়ে বাড়ি ফিরে এসেছে । এখন
হাতে একদম কাজ নেই । একদম বেকার হয়ে আছে । তবুও দুই ছেলে বিকেলের দিকে
ঘুগনির দোকান দেয় । ঘুরে ঘুরে বিক্রি করে । কী আর বলব, এখন ঘুগনি খেতেও
লোকে ভয় পায়, যদি করোনা চলে আসে ।তাই বাধ্য হয়ে এই অশক্ত শরীরেও পথে নেমেছি
জীবিকার সন্ধানে ।
তা মাসিমা, এই সুন্দর সুন্দর পুতুল গুলো কোথা থেকে আসে?
মাসিমা বললেন, এই পুতুল গুলো আমাদের এলাকাতেই এখন তৈরি হচ্ছে ।
বাইরের রাজ্য থেকে আনতে হয়না । পরিবহনে খরচ কম থাকায় আমরা সামান্য লাভ রেখে
অল্প দামে পুতুল গুলো বিক্রি করি ।
কিন্তু ক্রেতা কোথায়?
মাসিমা বললেন, এই পথ দিয়ে সকাল থেকে রাত পর্যন্ত অনেক গাড়ি চলাচল
করে । ঠিক আপনাদের মতই কৌতুহল বশতঃ অনেকেই পুতুল গুলো দেখে দাঁড়িয়ে পড়ে ।
নিজের পুতুল বলে বলছি না, পুতুলের গড়ন আমরা এত নিখুঁত করেছি যে, চোখ ফেরানো
যাবে না । একবার দেখলেই কিনতে ইচ্ছে করবে ভালবেসে ।
তা ঠিক বলেছেন মাসিমা । এইতো আমাদেরই পুতুল কিনতে মন চাইছে । তা দাম কত?
এই পঞ্চাশ টাকা । তবে একসাথে বেশী নিলে কম দামে দিয়ে দিই । বুঝতেই পারছ বাবা, সংসার তো চালাতে হবে ।
ঘর সাজানোর জন্য আমাদের দুটি পুতুলই যথেষ্ট । তাছাড়া এই পুতুল গুলো
আরও বেশী করে পছন্দ হয়েছে এই জন্য যে,আমাদের শখ ছিল আমাদের ঘরে একটি ছোট্ট
ফুটফুটে মেয়ে থাকবে। কিন্তু সব ইচ্ছে তো আর আমাদের হাতে নেই । মেয়ের
পরিবর্তে ঘরে চলে এল পুত্র সন্তান । আর এই পুতুল গুলো যেন আমাদের সেই
স্বপ্ন দেখার প্রতিমূর্তি ।
আমি ভাবলাম, আমি যদি একসাথে অনেকগুলো পুতুল কিনে নি, তাহলে মাসিমারই
ভালো হবে । আর আমিও একটু কম দামে পাব । মাসিমার কাছে আমি চল্লিশ টা পুতুল
চাইলাম।
মাসিমা শুনে অবাক । উনি ভাবলেন, আমি বুঝি মজা করছি । এত পুতুল বাড়ির
জন্য কেউ কেনে নাকি? মাসিমার চোখে বিস্ময় বোধক চিহ্ন দেখে বললাম, হ্যাঁ
মাসিমা, আমার চল্লিশটা পুতুলই দরকার ।
মাসিমা পুতুল গুলো প্যাকিং করে দিলেন । সঙ্গে চার চাকা যখন রয়েছে,
বহন করতে কোন অসুবিধা নেই । আমার দেখাদেখি চালক ভাইটিও কয়েকটি পুতুল নিয়ে
নিল।
মাসিমা খুব খুশি হলেন । এক সঙ্গে এর আগে এত পুতুল তার বিক্রি হয়নি ।
আজ তাড়াতাড়ি বাড়ি ফিরতে পারবেন, এই আনন্দ তার চোখে মুখে ফুটে উঠল ।
মাসিমাকে বিদায় জানিয়ে গাড়িতে চেপে বসলাম । তার আগে তাকে পুতুলের
দাম ছাড়াও আরও কিছু টাকা হাতে তুলে দিলাম । তিনি নিতে চাইছিলেন না । কিন্তু
তাকে বললাম, আজ আমি এই পুতুল গুলোর মধ্যে আমাদের স্বপ্নের রাজকন্যা খুঁজে
পেয়েছি । সেই খুশিতে আমি তোমাকে এই উপহার দিলাম ।
আমার কথা শুনে মাসিমার চোখে জল চলে এল । আমরা ফিরে আসছি । উনি
তাকিয়ে আছেন আমাদের গাড়ির দিকে । রাস্তার দুদিকের পুতুলের মেলা কেমন সাই
সাই করে যেন ছুটে চলেছে । মনে হল, পুতুল গুলো যেন আমাদের টা টা বাই বাই
করছে ।
বাড়ি ফিরে ভাবছি, কিনে তো ফেললাম, কিন্তু এত পুতুল দিয়ে আমি কি করব ?
হঠাত্ মাথায় এল, সামনের জানুয়ারিতেই তো পাড়ার ক্লাবের শিশু উত্সব শুরু হবে
। তখন না হয় সফল প্রতিযোগীদের হাতে এই মিষ্টি পুতুল গুলো তুলে দেওয়া যাবে ।
লকডাউনের চিন্তায় রাত্রে অনেকদিন ভালো ঘুম হয়নি । আজ কিন্তু দারুণ ঘুম হল । এক ঘুমেই মিষ্টি সকাল!
No comments:
Post a Comment